উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার

-

  • রায়হান আহমেদ তপাদার
  • ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:৫০

উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। মূলত, এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশেই উইঘুর সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে। সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক অনুযায়ী চীনের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ২ শতাংশ মুসলিম। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মুসলিমরা চীনা জনসংখ্যার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, এসব দেশের মধ্যে চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজারের মতো উইঘুর লোক বসবাস করে। কাজাখস্তানে ২ লাখ ২৩ হাজার, উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার, কিরগিজস্তানে ৪৯ হাজার, তুরস্কে ১৯ হাজার, রাশিয়ায় ৪ হাজার, ইউক্রেনে ১ হাজারের মতো উইঘুর লোক বাস করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও প্রাচীন এ সম্প্রদায়ের লোকদের উইঘুর না বলে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। মূলত, ১৯২১ সালে উজবেকিস্তানে এক সম্মেলনের পর উইঘুররা তাদের পুরোনো পরিচয় ফিরে পায়। ভাষাবিদ ও ইতিহাসবেত্তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন যে ‘উইঘুর’ শব্দটি ‘উয়্যুঘুর’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ সংঘবদ্ধ। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে ১ কোটি ২৬ হাজারের মতো উইঘুর লোক বসবাস করে। এদের অধিকাংশই মুসলমান। অর্থাৎ জিনজিয়াং প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৮% শতাংশই মুসলমান। উল্লেখ্য যে, এ প্রদেশের মোট জনসংখ্যা হলো ২ কোটি ২০ লাখ।

জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানরাই সর্বাধিক অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হচ্ছে চীনা সরকার দ্বারা। উইঘুর মুসলমানদের ধর্মান্তকরণে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদের ভাষা শিক্ষা নিষিদ্ধ করে মান্দারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা হচ্ছে। পুন:শিক্ষা শিবিরে এসব মুসলিমদের আটক রেখে মূলত: ধর্মান্তকরণের কাজটিই করা হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা শিবিরের পাশাপাশি উইঘুর শিশুদের ক্যাম্প ও স্কুল রয়েছে, যেখানে তাদের পরিবার, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। ইউঘুর মুসলমানদের দাড়ি রাখা ও রমজান মাসে রোজা রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং এভাবে মুসলমানদের ধর্ম পালনের ওপর বিধি নিষেধ জারী করে চীন মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার কেড়ে নিয়েছে। উইঘুর নারী মিহিরগুল তুরসুন ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা সরকারের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং তাঁর ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে তার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, তাঁর জন্ম উইঘুর প্রদেশে। উচ্চ শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন মিশরে এবং তিন সন্তানকে সাথে নিয়ে ২০১৫ সালে জন্মস্থানে ফিরে আসার পর তাঁকে সন্তানদের থেকে আলাদা করে ফেলা হয় এবং নিয়ে যাওয়া হয় চীনা বন্দী শিবিরে। তিনি বলেন, তাঁকে তিন দফায় গ্রেপ্তার করে বন্দী শিবিরে নিয়ে অমানবিক এবং নারকীয় নির্যাতন করা হয়। মিহিরগুল বলেন, একদিন তাকে ন্যাড়া করে হেলমেটের মতো কিছু একটা পরিয়ে একটা চেয়ারে বসানো হয়। এ সময় তাকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারপর আর কিছু মনে পড়েনি তার।

গত বছরের আগস্টে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানদের চীনের সরকারী ‘সন্ত্রাসবাদ’ নামক বন্দী শিবিরে আটক করে রাখা হয়েছে। আর ২০ লাখ মানুষকে রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনর্বিবেচনার শিবিরে বসবাস ও অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়েছে। চীনা সরকার অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে বরাবরই। কিন্তু চীনের অস্বীকার করাকে আমলে নিচ্ছে না বিশ্ব মিডিয়াগুলো বা মানবাধিকার সংগঠনগুলো। বরং এই চলিত ২০১৯ সালেও যে উইঘুরদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান অব্যাহত আছে সেটি প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে বিশ্বের নানান মিডিয়াতে।প্রসঙ্গক্রমে, উইঘুরদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা আবশ্যক বলে মনে করছি। ইতিহাস থেকে এটি জানা যায় যে, উইঘুরদের রয়েছে প্রায় চার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। মূলত: স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী হলো উইঘুর মানুষেরা। পরবর্তীতে এরা পার্শ্ববর্তী অনেক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এর মধ্যে চীন, পাকিস্তান, ভারত, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া এবং রাশিয়ায় উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকেরা বসতি স্থাপন করেছিলো।
মুসলমানদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণ হিসেবে চীন দাবি করছে, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থার মোকাবিলা করার জন্যই তারা উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানান পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। চীনা সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী উইঘুর মুসলমানরা সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় চরমপন্থী কর্মকান্ডে জড়িত।

উইঘুর মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের প্রায় ৯০% শতাংশই থেকে যাচ্ছে বিশ্ববাসীর অগোচরে, কেননা দেশটির প্রচার মাধ্যমগুলোতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কঠোর এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও যে সকল সংবাদ পাওয়া যায় তা থেকে দেখা যায় ১৮ বছরের নীচে কোনো উইঘুর বালক মসজিদে যেতে পারে না সরকারি বিধি নিষেধের কারণে। সন্তানদের মুসলিম নামকরণেও রয়েছে বিধি নিষেধ। আর ৫০ বছরে কম বয়সী কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে পারে না। নামাজ পড়ার কারণে অনেক চাকুরীজীবী মুসলমানের চাকুরি চলে গেছে। অনেকগুলো মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জাতিসংঘে প্রতিবেদন পাঠিয়ে বলেছে যে, চীনের বিভিন্ন শিবিরে উইঘুরদের ব্যাপক হারে আটক করে রাখা হয়েছে। দ্য ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস অভিযোগ করেছে, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই উইঘুরদের আটক করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের কমিউনিস্ট শ্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এজন্য তাদেরকে শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ২য় বার আটকের পর তাকে টানা চারদিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং তাঁকে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি। মেডিকেল ট্রিটমেন্টের নামে যৌনাঙ্গে যন্ত্র ঢুকিয়ে নির্মম অত্যাচার করা হতো তাঁকে।প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, মিহিরগুলের ন্যায় অসংখ্য নারীদের ক্যাম্পে আটক করে বর্বর নির্যাতন করে তাদেরকে ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করা হচ্ছে; তাদেরকে মার্কসবাদে দীক্ষিত করার জন্য চেষ্টা করা হয়ে থাকে। নারীদের হিজাব ব্যবহার থেকে বিরত রাখার জন্য বলা হচ্ছে। হিজাব সরাতে অনিচ্ছুক নারীদের চিকিৎসা সেবা দিতে ডাক্তারদের নিষেধ করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমই উইঘুর মুসলমানদের ওপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশ করছে।
চীনা কর্তৃপক্ষ যতই অস্বীকার করুক না কেন, বিশ্ববাসী তা আমলে নিচ্ছে না। বরং গণহারে উইঘুর মুসলমানদের পুনঃশিক্ষার নামে বন্দি শিবিরে জোর করে আটক রাখা, আকটকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন করা, তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্ম বিশ্বাস পরিবর্তনে বাধ্য করার মতো জঘন্য অমানবিক কর্মকান্ডের জন্য মুক্ত বিশ্ব জোরালোভাবে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে চীনা সরকারের প্রতি এবং অবিলম্বে তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধের জন্য চীনের প্রতি আহবান জানিয়ে আসছে।হিউম্যান রাইটস গ্রুপ, চীনের এই জঘন্য অমানবিক কর্মকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানিয়েছে। চীনের এই ব্যাপকমাত্রায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বিশাল পরিমাণের নির্যাতনের বিষয়টি অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি রাখে, জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর নির্বাহী পরিচালক রুথ কেনেথ।
অন্যদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারী জেনারেল কুমি নাইডুর মতে, ‘জিনজিয়াং একটি কারাগারে পরিণত হয়েছে, যেখানে উইঘুর মুসলমানদের ওপর নজরদারির জন্য উচ্চ প্রযুক্তির নজরদারি ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে উইঘুরদের নতুন করে রাজনীতি শেখানো হচ্ছে; তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বদল করে চীনা সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদেরকে বিনা কারণে বিধিবহির্ভুতভাবে যখন-তখন গ্রেফতার করে বন্দি শিবিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এসব কিছু প্রমাণ করে যে, উইঘুর সংখ্যালঘু মুসলমানরা যেন নিজভূমে পরবাসী।

এমনকি ধর্মীয় ক্ষেত্রে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন সরকারের নীতির কঠোর সমালোচনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ২০০৯ সালের দাঙ্গার পর চীনা সরকারের সমালোচনা করে শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশের দায়ে চীন সরকার গোপনে বেশ কয়েকজন উইঘুর মুসলিম বুদ্ধিজীবীর বিচার করেছে। তারা আরও বলেছে, ধর্ম নিয়ন্ত্রণ এবং সংখ্যালঘুদের ভাষাশিক্ষা নিষিদ্ধ করার চীনা নীতি জিনজিয়াংয়ে অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ। জিনজিয়াংয়ে স্থানীয় আইন পরিবর্তন করে শিক্ষা শিবিরের ‘চরমপন্থী মতাদর্শিক শিক্ষা’ বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়েছে চীন। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এসব শিবিরে বন্দীদের মান্দারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসার কথা বলা এবং তাদের সঠিক আচরণ পরিচালনার নিয়মগুলো কঠোরভাবে মনে রাখতে বাধ্য করা হয়। এ অভ্যাসগুলোর অংশ হিসেবে চীন সরকার সাংঘর্ষিকভাবে জিনজিয়াংয়ের উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই শিক্ষাশিবিরের পাশাপাশি উইঘুর শিশুদের ক্যাম্প ও স্কুল রয়েছে, যেখানে তাদের পরিবার, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। চীনের অর্থনীতির রমরমা অবস্থা এবং তাদের কাছ থেকে নানান সুবিধা পেয়ে অধিকাংশ মুসলিম দেশ এসবের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। আসল কথাটি হলো বলতে চায় না। বুদ্ধিজীবীরাও কথা বলেন না। কারণ, এঁদের অনেকেই মার্ক্সীয় তত্ত্ব, মাও তত্ত্ব ভর করে আছেন। আর মুসলিমদের ব্যাপারে বরাবরই মুসলিম সুশীল সমাজ বা আমরা একরকম অন্ধ। এসব মানুষের কান্না তাদের কানে যায় না।

ইমেইল : [email protected]