বাংলাদেশের সংবাদপত্র এখন অন্ধকার সময় পার করছে। সব দেশে এবং সব সময় এক নায়কত্ববাদী শাসনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে । স্বাভাবিক ভাবে এর প্রভাব পড়ে সংবাদ মাধ্যমের ওপর। সেলফ সেন্সরশিপের কারনে সাংবাদিকরা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে সংবাদপত্রের ওপর সাধারন মানুষের আস্থা কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে একজন সংবাদ কর্মী ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মনের মাধুরী মিশিয়ে যে গল্প লিখে থাকে তার সাথে বাস্তবের কোনো মিল থাকে না। মানুষ চারপাশে যা দেখে তার প্রতিফলন গনমাধ্যমে দেখতে চায়। সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে যখন সাধারন মানুষের দেখা বা উপলদ্ধির প্রকাশ থাকে না , তখন এমন খবরকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না। খবরকে নিছক রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচারনা হিসাবে দেখে থাকে। এভাবে দীর্ঘ সময় চলার কারনে সাধারন মানুষের সাথে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের দূরত্ব তৈরি হয়। সংবাদমাধ্যম আর মানুষের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠে না। ঘুম থেকে উঠে সংবাদপত্র পড়ার যে তাগিদ তা আর বোধ করে না।
ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে মানুষের সম্পৃক্ততার ফলে সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব আরো প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। এজেন্ডা নির্ধারন করে জনমত তৈরি করার যে কৌশল সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিয়ে থাকে তাতে বড় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর প্রভাবে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওপর সাধারন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস যে কতটা নষ্ট হতে পারে সে ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যম গুলো আগাম ধারনা করতে পারেনি, এমনকি এখনও পারছে না। বাংলাদেশসহ বিশে^র বহু দেশে তরুনরা সংবাদপত্রের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
ভারতে এক জরিপে দেখা গেছে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সের ১৮ শতাংশ ছেলে মেয়ে ছাপা সংবাদপত্র পড়ার প্রয়োজন বোধ করে না। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়স এমন ১২ শতাংশ মানুষ সংবাদপত্র পড়ে না। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মানুষের মধ্যে সংবাদপত্র পড়ে না এমন সংখ্যা ৮ শতাংশ।
সংবাদপেত্রর সার্কুলেশন দিন দিন কমে যাচ্ছে। পত্রিকার বাজেট যেমন কমছে, তেমনি এর পৃষ্টা সংখ্যা ও জনবলও কমানো হচ্ছে। পশ্চিমা বিশে^ ছাপা সংবাদপত্রের পাঠক কমে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। ২০১৬ লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা ৩০ বছরের ছাপা প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে শুধূমাত্র অনলাইন সংস্করনে চলে গেছে। নিউজ উইক ও ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরের মতো ম্যাগাজিন ছাপা বন্ধ করে দিয়েছে। শুধুমাত্র অনলাইনে চলছে।
সার্কুলেশনের দিক বিচেনায় বাংলাদেশের সংবাদপত্র আরো বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) সংবাদপত্রের সার্কুলেশন সংক্রান্ত যে অডিট রিপোর্ট ( এবিসি) প্রকাশ করে তা যে বাস্তবতা বিবর্জিত সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টরা জানেন। এই রিপোর্ট দিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সার্কুলেশনের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। বরং আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেখে নিতে পারি।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাব বলছে, দেশে ৯ কোটি পাঁচ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এর মধ্যে আট কোটি ৪৭ লাখ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটি পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
পৃথিবীর যেসব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ঢাকা হচ্ছে দ্বিতীয়। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথভাবে চালানো এক বৈশ্বিক জরিপে এ চিত্র পাওয়া গেছে। জরিপটি চালিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল’ আর কানাডাভিত্তিক ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান হুটস্যুইট। অনলাইনে প্রকাশিত ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন ব্যাংকক শহরে, তিন কোটি। এর পরই রয়েছে ঢাকা। এখানে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২ মিলিয়ন বা দুই কোটি ২০ লাখ। তৃতীয় স্থানে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা।
বাংলাদেশের মানুষ এখন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল প্রচারিত সংবাদের চেয়ে ফেসবুকে, ইউটিউেবে কিংবা এসএমসে পাওয়া খবর বা তথ্যর ওপর বেশি আস্থা রাখছে। সাংবাদিকরা যে নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশনে সক্ষম নয় তা সাধারন পাঠকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। যেমন ধরা যাক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক আন্দোলনে টেলিভিশন চ্যানেল বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের চেয়ে ছাত্র বিক্ষোভের ভিডিও কিংবা ছাত্র নেতাদের বক্তব্যর ভিডিও ফেসবুকে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়েছে। এমনকি এসব সমাবেশ বা মিছিলের দৃশ্য সরাসরি লাইভ প্রচার করা হয়েছে। যা লাখ লাখ লোক দেখেছে। ছাত্র আন্দোলনের একই খবর যখন মতলবি কায়দায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করছে তা থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের সম্পৃক্ততার কারনে বিজ্ঞাপন দাতারা এখন ফেসবুক বা ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দিতে বেশি আগ্রহী। পন্য প্রচারের স্বাভাবিক নিয়মে যে মাধ্যমে বেশি লোকের কাছে পৌছানো যাবে সেখানে বিজ্ঞাপন দেবে। অনলাইন ভিত্তিক বিজ্ঞাপনের বাজার ধরার জন্য দেশে অসংখ্য ওয়েব পোর্টাল তৈরি হয়েছে। কিন্তু ওয়েব পোর্টালগুলোতে খবরের নামে যা প্রকাশ করা হয়, তার না আছে কোনো মান, না আছে বিশ^াসযোগ্যতা। এসব ওয়েব পোর্টালে সাংবাদিক হিসাবে যারা কাজ করেন তাদের বেতন দেয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
আবার প্রতিষ্টিত সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ওয়েব পোর্টাল চালু করে বিজ্ঞাপন ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও একই সমস্যা থেকে যাচ্ছে। খবরের বিশ^াসযোগ্যতা নেই। আবার চটকদার শিরোনাম দিয়ে পাঠককে সাইটে নিয়ে যাওয়া হলেও শিরোনামের সাথে যখন বাস্তবের মিল থাকে না, তখন পাঠক দ্বিতীবার আর সাইটে ঢুকছে না। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো শেষ পর্যন্ত ফেসবুকে তিন মিনিটের নাটকের ক্লিপ প্রচার করে আয় করছে। মানুষ এখন এই নাটকগুলো দেখে, সংবাদ নয়।
আয়ের জন্য অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রিত সবাদপত্রের ওয়েব পোর্টালেও যৌন সুরসুরি মুলক শিরোনাম দিয়ে খবর প্রকাশ করছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ফেসবুক এবং ইউটিউবের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন লঙ্ঘন করার কারনে বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ওয়েব পোর্টাল থেকে আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। দেশীয় বিজ্ঞাপন দাতারাও সরাসরি নিউজ ওয়েব পোর্টালগুলোকে বিজ্ঞাপন না দিয়ে গুগল ও ফেসবুকের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এতে বিজ্ঞাপন দাতাদের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার যেমন সহজ একই সাথে কম টাকায় বেশি প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্র যে এক ধরনের দুর্যোগময় সময় পার করছে এর পেছনে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রভাব যেমন আছে, তেমনি সংবাদপত্রগুলোর প্রাতিষ্টানিকীকরনের অভাবও অন্যতম কারন। দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় প্রতিষ্টান বলে এখন আর কিছু নেই। দেশের ব্যবসায়ীরা যেসব সংবাদপত্র প্রকাশ করছেন তার গুটি কয়েক ছাড়া বাকি সংবাদপত্রগুলোতে সম্পাদকের পাশাপাশি একজন করে প্রধান নির্বাহী (চিফ এক্্িরকিউটিভ অফিসার) বসানো হয়েছে। যারা সম্পাদকের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। এর মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা এমনকি কাপড়ের ব্যবসায়ী বা দোকানদারও রয়েছে। এরা দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম যে কাজটি করে থাকেন তা হলো সম্পাদককে ঠুটো জগন্নাথ বানানো। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল গুলোর সাংবাদিকদের একটি অংশ মালিকদের এ কাজে সহায়তা করে থাকে। সাংবাদিকদের দিয়ে সম্পাদকের ক্ষমতা খর্ব করা এমনকি লাঞ্চিত করার ঘটনাও ঘটে থাকে। প্রাতিষ্টানিকতা ও মর্যাদাহানিকর কাজের সাথে সাংবাদিকদের সংশ্লিষ্টতা শেষ পর্যন্ত মালিকদের কাছে সাংবাদিকদের অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলে। যারা এমন কাজ করে থাকেন তাদেরকেও শেষ পর্যন্ত একই পরিনতি ভোগ করতে হয়।
বাস্তবতা হচ্ছে রাজধানী থেকে প্রকাশিত হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্র ছাড়া সবগুলোতে ৩ মাস থেকে এক বছরের বেতন বকেয়া রয়েছে। এই বকেয়া বেতন সাংবাদিকরা আদৌ পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আজকে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকদের ভাবার সময় এসেছে যে শত শত তরুন সংবাদমাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কর্ম জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান সময় দিচ্ছেন, তাদের ভবিষ্যত কী? জীবন যাপনের নুন্যতম নিশ্চয়তা যদি না থাকে তাহলে এরা কিভাবে ভালো সাংবাদিক হবে? বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে বেতন ছাড়া কতটা ভালো সাংবাদিক হওয়া সম্ভব? কিভাবে তার পেশার প্রতি মনোযোগি হবে? সাংবাদিকদের জীবনমানের উন্নতির দিকে মনোযোগি হতে না পারলে মেধাবী তরুনরা শুধু এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না, সাংবাদিকদের সামাজিক মর্যাদা আরো ভুলুন্ঠিত হবে। সাংবাদিকদের এখন আতœ সমালোচনার সময় এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে প্রবল প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে সাংবাদিকদের সত্য উচ্চারনে যেমন সাহসী হতে হবে তেমনি গনমাধ্যমে প্রাতিষ্টানিকতা ফিরিয়ে আনার দিকে মনোযোগী হতে হবে।