ভারত-যুক্তরাষ্ট্র মূল্যবোধ: পুরোটাই ফাঁপা বুলি


  • হায়দার সাইফ
  • ২৭ অক্টোবর ২০২১, ২২:১০

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এই সফর একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে। সেটা হলো- ইউরোপ থেকে মনোযোগ এশিয়াতে সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পেছনে অবশ্য ভারতের অব্যাহত চাপ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কোয়াডে যুক্ত করতে চায়। ভারতও সেখানে যোগ দিতে আগ্রহী। তবে এ জন্য এশিয়াতে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। কোয়াড হলো চীনকে মোকাবিলার জন্য গঠিত একটি গ্রুপ। এদিকে, কাবুলের পতনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও বিব্রত। ভারত চাচ্ছে, অধিকৃত কাশ্মীরে যে ত্রাসের রাজত্ব চলছে, সে ব্যাপারে চোখ বন্ধ রাখবে তালেবানরা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আচরণও হতাশাজনক। ভারতের ইঙ্গিতে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সবকিছুই তারা করছে।

বাইরে থেকে যেমনই দেখাক, বাস্তবে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক অবশ্য অতটা মধুর নয়। ভেতরে কিছু টানাপড়েনও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনা বাতিল করুক ভারত। দিল্লিকে এ ব্যাপারে সতর্কও করেছে তারা। জানানো হয়েছে, এটা বাতিল না করলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। তবে ভারত আশায় আছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে ছাড় দেবে। তাদের আশার কারণও আছে। নন-প্রলিফারেশান ট্রিটি বা অস্ত্র-বিস্তার রোধে চুক্তি না করেও পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য হয়েছে ভারত।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ্যও ভারত কম হয়নি। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে সহায়তার জন্য ১৭ হাজার সেনা পাঠাতে বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভারত তাতে কান দেয়নি। ইরানের সরকার পতনের ব্যাপারেও ভারতকে পাশে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও সাড়া দেয়নি দিল্লি। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে রাশিয়ার কূটনীতির পক্ষে ছিলেন মনমোহন। চীনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির ২০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। এরপরও চীনকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণটা পরিস্কার। শিগগিরই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে চীন।

মোদির সাথে বৈঠকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আর ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। বিজেপি সরকারের অসহিষ্ণুতার দিকে ইঙ্গিত করে মহাত্মা গান্ধীর কথা স্মরণ করিয়ে দেন বাইডেন। হ্যারিস বলেন, গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে গণতান্ত্রিক নীতি আর প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করতে হবে। ভারতে গণতন্ত্রের অবনতি নিয়ে অনেক দিন ধরেই উদ্বেগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে হ্যারিসের মন্তব্যকে কূটনৈতিক চাপ বলা যায়। মোদির সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসার আগে বাইডেন যে কথা বলেছেন, সেখানেও এটাই উঠে এসেছে।

হোয়াইট হাউজে বৈঠকে বসার আগে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন নরেন্দ্র মোদি আর কমলা হ্যারিস। সেখানেও গণতন্ত্রের কথা বলেন হ্যারিস। তিনি বলেন, সারা বিশ্বেই গণতান্ত্রিক দেশগুলো হুমকিতে আছে। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করাটা খুবই জরুরি। সারা বিশ্বে গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে আমাদেরকে নিজের দেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে। এর আগে, টুইটারে জয়শঙ্করের সাথে প্রকাশ্যে দ্বিমত জানিয়েছিলেন হ্যারিস।

যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সাথে বৈঠকে বসতে অস্বীকার করেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর। কারণ কমিটি থেকে কংগ্রেস সদস্য প্রমিলা জয়পালকে বাদ দিতে বলেছিল ভারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটা করেনি। ভারতের দাবির কারণ হলো,জয়পাল সব সময় মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতির সমালোচনা করে এসেছেন।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ওই আলোচিত টুইট করেছিলেন হ্যারিস। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মার্কিন কংগ্রেসকে এটা বলা সাজে না যে, ক্যাপিটল হিলের বৈঠকে কোন সদস্য থাকবেন।’ ভারতের গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার অবস্থা কী? ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধেছে। বন্দুকের নলের মুখে এই অঞ্চল শাসন করেছিল ব্রিটিশরা। স্বাধীন ভারত সরকারও ব্রিটিশদের পথে হেঁটেছে। বিভিন্ন কালো আইন জারি করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের দমন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সবচেয়ে কুখ্যাত আইন হলো ১৯৫৮ সালের আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট। পরে এই আইন জম্মু ও কাশ্মীরেও প্রয়োগ করা হয়।

ভারতের সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জীবন ধারণ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা, অবাধ চলাফেরা, পেশাগত চর্চা, যথেচ্ছাচার গ্রেফতার থেকে সুরক্ষা এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। সংবিধানের ২১, ১৪, ১৯, ২২ এবং ২৫ ধারায় এ সব অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ১৯৫৮ সালের কালো আইনে এই মৌলিক মানবাধিকারগুলো লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই আইন ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আটক অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে, নির্যাতন হয়েছে, সাধারণ নাগরিকদের অবরুদ্ধ করা হয়েছে, চিরুনি অভিযান চালানো হয়েছে, নাগরিকের সম্পদ লুট করা হয়েছে। হাজার হাজার যুবক উধাও হয়ে গেছে।

এই কালো আইনে অভিযুক্তকে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যতক্ষণ না সে নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছে। সমস্ত আইনের যে মৌলিক নীতি, তার সম্পূর্ণ বিপরীত এটা। প্রচলিত নিয়ম হলো, দোষি প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে হবে।

জরুরি শাসনের মতো বিধান রয়েছে এখানে। যে কোনো রাজ্যের গভর্নর আইনসভার সাথে কথা না বলেই রাজ্যকে অস্থিতিশীল ঘোষণা করতে পারবে। এই আইনে সশস্ত্র বাহিনীর কোনো দায়বদ্ধতা রাখা হয়নি। বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার জন্য এই আইন নয়। বরং বেসামরিক প্রশাসনকে সরিয়ে দিয়ে এই আইনে কর্তৃত্ব করবে সশস্ত্র সেনারা।

সামরিক কর্মকর্তাদেরকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এই আইনে। ৪ নং অনুচ্ছেদে সশস্ত্র বাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার, ওয়ারেন্ট অফিসার বা কমিশনবিহীন অফিসারদের বেশ কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সমাবেশের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে পাঁচজন বা তার বেশি মানুষ সমাবেশ করলে, কেউ অস্ত্র বহন করলে, বা এমন কিছু বহন করলে- যেটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তাহলে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অফিসার যদি প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে গুলি চালাতে পারবেন। এমনকি গুলি করে হত্যাও করতে পারবেন।

অফিসার যদি মনে করেন কোথাও অস্ত্রের মজুদ রয়েছে, কোন জায়গা থেকে হামলা হতে পারে, বা কোন জায়গায় অপরাধীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, তাহলে ওই জায়গায় তারা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করতে পারবেন।

কেউ কোনো অপরাধ করেছে মনে হলে, কোন ধরনের ওয়ারেন্ট ছাড়াই তাকে গ্রেফতার করা যাবে এবং গ্রেফতারের জন্য প্রয়োজনে যে কোনো শক্তি প্রয়োগ করা যাবে।

কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের জন্য, কোনো আটকে রাখা ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য, কোনো অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য যে কোনো জায়গায় কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশি ও অভিযান চালাতে পারবে সশস্ত্র বাহিনী।

এই আইন জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এটা প্রয়োগের জন্য কোনো ঘটনা ঘটা শর্ত নয়। বরং ঘটনা ঘটতে পারে বা কিছু একটা হতে যাচ্ছে - শুধু এটুকু ধারণা থেকেই এই কালো আইন প্রয়োগ করা যাবে। সাধারণত যুদ্ধ ক্ষেত্রে এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কমিশন প্রাপ্ত বা কমিশনবিহীন যে কোনো কর্মকর্তাকে একজন বিচারকের মতো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার সেটাকে বাস্তবায়নও করতে হয়। কারণ, সেখানে অন্যের পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ থাকে না।

কালো আইনে সশস্ত্র বাহিনীকে অপরিসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারা গ্রেফতারের জন্য গুলি চালাতে পারবে। তল্লাসি চালাতে পারবে। অবরোধ করতে পারবে। এমনকি গুলি করে হত্যা পর্যন্ত করতে পারবে। ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে জীবনের যে অধিকার দেয়া হয়েছে, সেটাকে এই আইনে সম্পূর্ণ ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য যে আন্তর্জাতিক আইন বা আইসিসিপিআর রয়েছে, সেটাও লঙ্ঘন করা হয়েছে কালো আইনে। অথচ, ১৯৭৮ সালে ভারত আইসিসিপিআরে স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে সকল নাগরিকের প্রতিশ্রুতি অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। আইসিসিপিআরের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে নাগরিকের জীবন রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, এই কালো আইন সেটাকে ছুড়ে ফেলেছে।

পশ্চিমারা ভারতকে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলে থাকে। পশ্চিমা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হলো, এটা এমন একটা সরকার ব্যবস্থা, যেটা জনগণের সরকার, যেটা জনগণের জন্য কাজ করে, এবং যেটা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। বাস্তবতা হলো ভারতে নামেই মাত্র গণতন্ত্র আছে। কাজে কিছুই নেই। পশ্চিম ও ভারতের নেতারা অভিন্ন মূল্যবোধের যে শ্লোগান দেন, তার পুরোটাই আসলে ফাঁপা বুলি।