ইউক্রেন কি পুতিনের জন্য আফগানিস্তান হবে?

বাইডেন প্রশাসনও ইউক্রেনে দখলদার রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের সেই কৌশলই নিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা - ছবি : সংগ্রহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১০ মার্চ ২০২২, ১১:৫৭

ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন আলব্রাইট বলেছিলেন, ইউক্রেনের আরও কিছু অংশ দখল করে নেবে রাশিয়া। আর এ কাজ করতে গিয়ে রাশিয়া তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮০’র দশকে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে যে অবস্থায় পড়েছিল, ইউক্রেনে রাশিয়াও সেই পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন কিছু বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক। আসলে কী ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য আফগানিস্তান হচ্ছে?

 

আফগানিস্তানে পরাজয়ের পরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্য রাশিয়ার ভাঙ্গন না হলেও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বড় ধরণের বিপাকে পড়তে পারেন। ইউক্রেন তার জন্য আরেকটি আফগানিস্তান হতে যাচ্ছে।

আবার এর বিরুদ্ধ মতও আছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, আফগানিস্তান ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি এক নয়। আফগানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও সামরিক সহায়তায় সোভিয়েত বাহিনীকে বিতাড়িত করতে পারলেও ইউক্রেনের জনগণের সে ধরণের সক্ষমতা আছে কি না তা নিয়ে তারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর পরাজয়ের কারণে দুটি ঘটনা ঘটেছিল। একটি হল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন, দ্বিতীয়টি হল মস্কোর নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ওয়ারশ চুক্তির বিলুপ্তি। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ‘শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয়’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই পরাজয়ের পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা ও আফগান মুজাহিদদেরকে গেরিলা যুদ্ধে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল। এখন ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে একই ধরণের ভূমিকা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও একই ধরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, পুতিন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতা পেলেও এই আগ্রাসনের জন্য তাঁকে দীর্ঘ মেয়াদে চড়া মূল্য দিতে হবে। মার্কিন কংগ্রেসে বাইডেন তার প্রথম স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এই হুঁশিয়ারি দেন।

বাইডেন বলেন, পুতিন যুদ্ধক্ষেত্রে হয়তো সফলতা পেতে পারেন; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তাকে ক্রমাগত চড়া মূল্য দিতে হবে। সামনে কী আসছে, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। বার্ষিক এই ভাষণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও ঘোষণা দেন বাইডেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় রাশিয়ার বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন। ভবিষ্যতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে বেকায়দায় ফেলতে আরও পদক্ষেপ নেয়ারও ইঙ্গিত দেন বাইডেন।

প্রযুক্তি খাতে রাশিয়ার প্রবেশাধিকার কেড়ে নিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। বাইডেন বলছেন, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সামনের বছরগুলোতে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কমে যাবে। দেশটির সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়বে। এ যুগের ইতিহাস লেখা হলে দেখা যাবে, ইউক্রেনে পুতিনের চালানো হামলা রাশিয়াকে দুর্বল করেছে। আর বাকি বিশ্বকে করেছে শক্তিশালী।

ভাষণ দেয়ার আগে সেদিন সকালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন বাইডেন। এসময় তিনি ইউক্রেনে মার্কিন সেনাদের সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দেন। স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণেও বাইডেন স্পষ্ট করে বলেন, ইউক্রেনে রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়াতে যাবে না মার্কিন সেনারা। ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে ইউরোপে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়নি। বরং ন্যাটো মিত্রদের রক্ষায় এই সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

জো বাইডেন আসলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারে বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করেছেন। আজ থেকে ৪২ বছর আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একই ধরণের হুশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনিও ১৯৮০ সালের ২৩ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দেয়া ষ্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের নিন্দা করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, সোভিয়েত এই আগ্রাসনের লক্ষ্য হচ্ছে সর্বদা স্বাধীনচেতা ও গভীরভাবে ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন আফগান জনগণকে দমন করা। এই আগ্রাসনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে তুলনা করেন জিমি কার্টার। তিনি বলেন, আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সামরিক আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আমরা শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এই হুমকির মোকাবেলা করবো।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একই ধরণের বক্তব্য দিয়েছেন তার ষ্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তির জন্য সবচেয়ে মারাত্বক হুমকি তৈরি করেছে। তিনিও জিমি কার্টারের মতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ বেছে নিয়েছেন। এই পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দিয়েছে তার মিত্ররাও।

জিমি কার্টার তার পোলিশ বংশোদ্ভূত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিবিগনিউ ব্রেজিনস্কির পরামর্শে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে আফগান মুজাহিদদের সহযোগিতা দিতে শুরু করেন। পরে তার উত্তরসূরি রোনাল্ড রিগ্যানও এক দশক ব্যাপি এই প্রতিরোধ যুদ্ধে গোপন মার্কিন সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখেন।

বর্তমান বাইডেন প্রশাসনও ইউক্রেনে দখলদার রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের সেই কৌশলই নিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাবেক কর্মকর্তা জেমস ব্রুনো ১৯৮০’র দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের সহায়তার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে যে অপরাধ করেছে সেজন্য দেশটিকে মূল্য পরিশোধ করার এখনই সময়। আমরা আগেও এটা করেছি, আবারও আমরা এটা করতে পারি। তিনি আরো বলেন, রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি বাইডেন প্রশাসন মস্কোর কান্না আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থনৈতিক যুদ্ধ, মনস্তাত্বিক তৎপরতা ও ইউক্রেনের জনগণের গেরিলা তৎপরতায় গোপন সামরিক সহায়তা জোরদার করতে পারে বাইডেন প্রশাসন।

রাশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফল তার এক টুইটে বলেছেন, ইউক্রেন হতে যাচ্ছে পুতিনের আফগানিস্তান। মার্কিন সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা চাক শুমারও ইউক্রেন নিয়ে একই ধরণের মন্তব্য করেছেন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন রুশদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। সশস্ত্র প্রতিরোধ তাদেরকে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য করেছিল।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরু হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ধারণা করা হয়েছিল, এরপর পরবর্তী দুই তিন দিনের মধ্যেই পুরো দেশ দখল করে নেবে রুশ বাহিনী; কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের মুখে অনেক রুশ সেনার প্রাণহানি ও সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি স্নাইপার হামলায় রুশ জেনারেল পর্যন্ত নিহত হয়েছেন।

দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য মেইলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হাতে আটক রুশ সেনাদের বক্তব্যের বরাত দিয়ে বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক রুশ সেনারা জানিয়েছেন, তাদেরকে উর্ধতন কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছিলেন যে, ইউক্রেনের মানুষ সেদেশের নাৎসীবাদী শাসকদের হাত থেকে মুক্তি চায়। সেজন্য রুশ সেনারা সেখানে গেলে দেশটির জনগণ তাদেরকে মুক্তিদাতা হিসেবেই দেখবে। ফুল দিয়ে অভ্যর্থণা জানাবে। দুই তিন দিনের বেশি লাগবে না পুরো ইউক্রেন দখল করতে। সেজন্য সেনারকে দুই তিন দিনের খাদ্য ও রসদ সাথে দিয়ে দেয়া হয়।

বাস্তবে হয়েছে উল্টো চিত্র। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে হতবিহবল হয়ে পড়ে। তারা দুই তিন দিন যুদ্ধের পর খাদ্য ও রসদ সংকটে পড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে অনেক সেনাই যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলে।

রুশ বাহিনীর এই প্রাথমিক বিপর্যয়ের পরেও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সহজেই ইউক্রেন ছেড়ে যাবেন না বলেই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। তারা আরো মনে করেন, আফগানিস্তান ও ইউক্রেনের পরিস্থিতিও এক নয়। ইতিহাসবিদ জেফ রগ সম্প্রতি লস এঞ্জেলস টাইমসে এক নিবন্ধে বলেছেন, ইউক্রেনের জনগণ যে রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। অথবা প্রতিরোধের মুখে যে রুশ বাহিনী পিছু হটবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

এখানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, মার্কিন সমর্থিত গেরিলা যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাশিয়া কী ধরণের পাল্টা ব্যবস্থা নেবে সে ব্যাপারেও আমাদের কোন কিছু জানার উপায় নেই। এছাড়া রাশিয়ার পরমাণু হামলার হুমকিও এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাশিয়া এক্ষেত্রে আসলেই কী ধরণের পদক্ষেপ নেবে তা ধারণা করাও কঠিন। কেননা পুতিন ইতিমধ্যেই তার সেনাবাহিনীর পরমাণু অস্ত্র ইউনিটকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছেন। বিশ্লেষকদের পরামর্শ হচ্ছে সামরিক সংঘাতের দিকে না গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর উচিত হবে রাশিয়ার সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করা।