ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত কেন রাশিয়ার পাশে ?

ভারতের কাছে রাশিয়া শুধুই অস্ত্র বিক্রেতা নয়- বরং আন্তর্জাতিক ফোরামে তার পাশে থাকা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চিরস্থায়ী এক বন্ধু। - ছবি : সংগ্রহীত

  • আলতাফ পারভেজ
  • ২১ মার্চ ২০২২, ১৯:১২

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিশ্ব জনসমাজও এখন দুই শিবিরে ভাগ হয়ে আছে। কেউ রাশিয়ার সমর্থক- কেউ সহানুভূতি দেখাচ্ছে ইউক্রেনবাসীকে। ডিজিটাল জগতের বিভিন্ন উপাত্তে নজর বুলিয়ে অনেকে জানাচ্ছে- যেসব দেশের নাগরিকদের মাঝে রাশিয়ার প্রতি বেশ সমর্থন দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে আছে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানও।

 

রাশিয়ার বিমানহানায় বাংলাদেশের মতোই ইউক্রেনে ভারতের একজন নাগরিক মারা গেছেন; কিন্তু তারপরও ভারত এখনও রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করেনি। জাতিসংঘে এ আগ্রাসন বন্ধে এ পর্যন্ত নানান উপলক্ষ্যে পাঁচ দফা ভোটাভুটি হলো। কোন ভোটাভুটিতে রাশিয়া-বিরোধী অবস্থান নেয়নি ভারত। রাশিয়ার নিন্দা জানানোর সকল কূটনৈতিক আয়োজনে ভারতকে অনুপস্থিত থাকতে দেখা যাচ্ছে।

ভারতের এরকম অবস্থান নিয়ে কূটনীতির জগতে চলছে তুমুল আলোচনা । প্রশ্ন উঠেছে, কেন ভারতের এই নিরপেক্ষতা? ঠিক কী কারণে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারত চুপ থাকার নীতি নিয়েছে?

ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত অন্তত চার ভাবে আক্রান্ত হয়েছে। প্রথমত ঐ দেশে ভারতের বিপুল শিক্ষার্থী ছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এরকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত বলা হয়। ইউক্রেনের বিদেশী শিক্ষার্থীদের চার ভাগের এক ভাগই ভারতীয়। বহুকাল ধরে ইউক্রেনের মেডিক্যাল কলেজগুলো ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণ করছে; কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসনে এরকম শিক্ষার্থীদের এখন লণ্ডভণ্ড অবস্থা। অনেক কষ্ট করে তারা দেশে ফিরতে পারলেও- তাদের ক্যারিয়ারের কী হবে সেটা বড় এক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

রাশিয়াতে থাকা ভারতীয় শিক্ষার্থীরাও এই যুদ্ধে সংকটে আছে নগদ অর্থের অভাবে। সেখানে আছে ভারতের ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী। রাশিয়ায় বসে ভারতীয় ব্যাংক ব্যবস্থায় সংযুক্ত হয়ে অর্থ যোগাড় করতে অসুবিধায় পড়ছে তারা।

ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি এ যুদ্ধের মাঝে ভারত বড় উদ্বেগে আছে অস্ত্র, জ্বালানী ও খাদ্যশস্য নিয়ে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার কারণে ভারতের অস্ত্রপাতির ক্ষুধা বিপুল। সে-ই ক্ষুধার প্রায় অর্ধেক মেটায় রাশিয়া। ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত- পাঁচ বছরে ভারতকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়েছে রাশিয়া। অগ্রামীতেও এই সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে হবে ভারতকে।

রাশিয়া থেকে ভারত কিনেছে এস-৪০০ মিসাইল ব্যবস্থা। অত্যাধুনিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চুক্তিমতো পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বিঘ্ন চাইছে না ভারত। ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দামের এসব সরঞ্জাম ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে ভারতে আসতে শুরু করেছে। চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা বাড়ার পর রাশিয়ার মিসাইল প্রযুক্তি হাতে পাওয়াকে অপরিহার্য ভাবছে ভারত।

তবে ভারতের কাছে রাশিয়া শুধুই অস্ত্র বিক্রেতা নয়- বরং আন্তর্জাতিক ফোরামে তার পাশে থাকা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চিরস্থায়ী এক বন্ধু। জাতিসংঘে রাশিয়ার ‘ভেটো’ ক্ষমতা বহু বার নয়াদিল্লীর স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

অস্ত্রের মতো, জ্বালানি নিয়েও ভারতের পুরানো নির্ভরতা আছে রাশিয়ার উপর। ১৪০ কোটি মানুষের দেশটি জ্বালানি খাতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক। তেল-গ্যাস খাতে রাশিয়ার সাথে ভারতের বছরে লেনদেন ১১ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে ভারতের সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার প্লান্টটি বানাচ্ছে রাশিয়া। এরকম দরকারি সহযোগীকে নয়াদিল্লী কোনভাবেই হঠাৎ চটাতে পারে না। ভারতের কূটনীতিক সিদ্ধান্তে তারই ছাপ পড়ছে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব হারানো নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাতে পারছে না তারা।

তবে রাশিয়ার আগ্রাসন ভারতের খাদ্যশস্য বাজারে অনেক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ইউক্রেনের চাষীরা যুদ্ধের কারণে এবং রাশিয়ার সরবরাহকারীরা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ববাসীকে আর আগের মতো গম দিতে পারছে না। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে গমের দাম বাড়ছে হু হু করে। ভারত গম ও চাল উৎপাদনে স্বনির্ভর হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে গমের চাহিদা বাড়ায় ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও তার দাম বাড়ছে। একইভাবে সয়াবিন তেলের বাজারও উর্ধ্বমুখী। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়ার সারের যোগানেও সমস্যা হবে। এর বাইরে ভারত সরকারকে জ্বালানি তেলের দামও শিগগির বাড়াতে হবে বলে আশঙ্কা চলছে। সেরকম হলে বাজারের সব পণ্যে দাম এক দফা বাড়বে।

এতসব কিছুর পরও ভারতের পক্ষে পুতিনের নিন্দা করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং তাদের মূল দল আরএসএসে পুতিনের সমর্থক কম নয়। ভারতে এরকম পোস্টার দেখা গেছে, যেখানে হিন্দুত্ববাদীরা বলছেন, পুতিন ‘অখণ্ড রাশিয়া’ গড়তে নেমেছেন- আর তাঁরা ‘অখণ্ড ভারত’ গড়তে চায়। টুইটারে ভারতীয়দের মাঝে ‘স্ট্যান্ড-উইথ-পুতিন’ হ্যাশট্যাগও বেশ সমর্থন পেয়েছে।

কেবল ইউক্রেন আগ্রাসন নয়- আফগানিস্তানে রেডআর্মি ঢুকে পড়ার সময়ও ভারত রাশিয়ার নিন্দা জানায়নি। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছিল তখনও নয়াদিল্লী জাতিসংঘে চুপচাপ ছিল। ইতিহাসে বরাবরই ভারতের ‘বিশেষ বন্ধু’ হয়ে থেকেছে রুশরা । ১৯৭১ থেকে এর কোনো ব্যতয় চোখে পড়েনি।

রাশিয়ার প্রতি পুরানো সমর্থনের পাশাপাশি এবার ভারতে আরেকটি নতুন প্রবণতা দেখা গেছে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ইগর পোলিখার এক মন্তব্যে হিন্দুত্ববাদীদের পাশাপাশি মুসলমানদের অনেকেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরুপ মন্তব্য করেছেন । পোলিখা ইউক্রেনে ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা বোঝাতে রাশিয়ার অভিযানকে রাজপুত অঞ্চলে মোগলদের অভিযানের সঙ্গে তুলনা করেন। বিজেপি সমর্থক প্রচারমাধ্যমে তাঁর এই মন্তব্য বেশ গুরুত্ব দিয়ে ঠাঁই পেয়েছে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন বিজেপি সরকারের সহানুভূতি পেতে ইগর পোলিখা এরকম মন্তব্য করেছেন ।

তবে ইউক্রেন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে রাশিয়ার পাশে থাকার বিষয়ে বিজেপির সঙ্গে ভারতের বিরোধী দলগুলোর বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। শশী থারুর, মনিষ তেওয়ারির মতো কংগ্রেসের দু’তিন জন নেতা ব্যক্তিগত মতামতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; কিন্তু তাঁদের দল আনুষ্ঠানিকভাবে এমন কিছু বলছে না- যা রাশিয়ার জন্য নিন্দাসূচক। এমনকি বিজেপির বিপরীত আদর্শের দল স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলোরও ঐক্যমত দেখা যাচ্ছে মোদি সরকারের ইউক্রেন নীতির সঙ্গে।

সাধারণভাবে ভারতীয়রা মনে করে তাদের দেশের প্রধান প্রতিপক্ষ চীন ও পাকিস্তান। এই দুই শক্তিকে মোকাবেলায় রাশিয়াকে পাশে রাখতেই হবে। সুতরাং এমুহূর্তে ইউক্রেনে বোমাবাজির জন্য রুশদের নিন্দা করা হলে পুতিনকে চীনের দিকে আরও ঠেলে দেয়া হবে মাত্র। এটা দীর্ঘমেয়াদে বহুমুখী ক্ষতি করবে। ভারতীয়রা মনে করছে, চীন-রাশিয়ার বন্ধন ভাঙ্গতে না পারলেও এটাকে শক্তি যোগানো বোকামি হবে। একইভাবে রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের কাছাকাছি আসার চেষ্টায়ও মদদ দেয়া যাবে না।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার আগে বিশ্ব উত্তেজনার বড় ভরকেন্দ্র ছিল চীনকে ঘিরে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে মিলে নতুন জোট ‘কোয়াড’ গড়ায় যুক্ত হয়েছিল ভারত। ঐ জোটে ভারত এখনও আছে; কিন্তু ইউক্রেন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থেকে তাদের অবস্থান একদম আলাদা। ভারতের এরকম আচরণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্ষুব্ধ হলেও আপাতত কিছু বলার সুযোগ নেই তাদের। কারণ, চীনের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে ভারতকে খুব দরকার তাদের।

বিজেপি-আরএসএসের শাসনামলে ভারতকে বাড়তি কাছে পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। ওয়াশিংটন ও ইইউ’র এসব বিবেচনা ভারতীয় কূটনীতিবিদদের ভালোই জানা আছে। সুতরাং তারা এই দুই শক্তিকে খেপিয়ে হলেও রাশিয়ার পাশে থাকার ঝুঁকি নিতে পারছে। ‘কোয়াড’-এর বিনিময়ে পুরানো-নির্ভরযোগ্য-বন্ধু রাশিয়াকে মনক্ষুন্ন করায় লাভ আছে বলে মনে করছে না ভারত। এমনকি জাতিসংঘে ভারতের নীরবতায় ইউক্রেনের নাগরিকদের মাঝে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সেটাও আপাতত বেশি আমলে নিতে অনিচ্ছুক নয়াদিল্লী।

রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাৎসরিক বাণিজ্যের কয়েকগুণ বেশি বাণিজ্য হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে; কিন্তু ইউক্রেন বিষয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি নয়াদিল্লী। কারণ, বাণিজ্যের চেয়েও তার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে সামরিক নিরাপত্তার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য- যাকে বলা হচ্ছে ‘জাতীয় স্বার্থ’।

ইউক্রেন ইস্যুতে এসে আবারও দেখা গেল, ভারতের বিদেশনীতি পুরোপুরি চীন ও পাকিস্তানকে মাথায় রেখে পরিচালিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রেরও বিদেশ নীতিও তাই। পুতিনের চলতি অভিযান সাময়িকভাবে বিশ্ব দৃষ্টি কেড়ে নিলেও ক্রমে চলতি ঠাণ্ডাযুদ্ধ আবার তার আপন চেহারায় হাজির হবে। সেখানে থাকবে একপক্ষে চীন- আরেক দিকে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতকেও তখন হয়তো আজকের অবস্থান পাল্টে ফেলতে হবে।