ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা সর্বাত্মক অবস্থান নিলেও গত ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসনের পক্ষ নিয়েছে জোরালোভাবে। কাশ্মীরে ভারতীয় বর্বরতার বিরুদ্ধেও তারা কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য ইউরোপ সদর দরজা খুলে দিলেও মুসলিম শরণার্থীদের ব্যাপারে ছিল খুবই অনুদার।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। মস্কোর ওপর তাৎক্ষণিকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে। ইউরোপ ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের নিঃশর্ত স্বাগত জানায়। তবে ইহুদিবীদী ইসরাইল ফিলিস্তিনে ৭০ বছর ধরে আগ্রাসন চালালেও এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পাশ্চাত্য। বরং ইসরাইলকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার সময়ও যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলের বর্বরতার পক্ষে সাফাই গাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে স্কুল, হাসপাতাল এবং আবাসিক ভবন ধ্বংস করেছে। শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। রাশিয়ার হামলা বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে অবশ্যই কঠোর বার্তা পাঠাতে হবে।
একই বক্তৃতায় ব্লিঙ্কেন অধিকৃত অঞ্চলে ইসরাইলি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের চলমান তদন্তকে পরিষদের বিশ্বাসযোগ্যতার উপর একটি দাগ বলে অভিহিত করেন। তিনি মানবাধিকার কাউন্সিলের এ কাজ বন্ধ করার আহ্বান জানান।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক সারাহ লিয়াহ হুইটসন বলেন, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন নিয়ে রাশিয়া এবং ইসরাইলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য করছে আমেরিকা। আমরা দেখতে পাচ্ছি মার্কিন সরকারের পাশাপাশি তাদের কোম্পানিগুলো রাশিয়াকে বয়কট করছে। বিপরীতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য ইসরাইলকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত অবস্থান তাদের। ইসরাইলকে বয়কট করলে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন পাস করছে তারা।
ফাউন্ডেশন ফর মিডল ইস্ট পিসের প্রেসিডেন্ট লারা ফ্রিডম্যান বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা যা করছে, ইসরাইলের ক্ষেত্রে নিচ্ছে তার ঠিক বিপরীত পদক্ষেপ।
ওয়াশিংটনে আরব আমেরিকান ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট জেমস জোগবি বলেন, ইউক্রেনীয়দের পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করার চিত্রকে বীরত্বপূর্ণ হিসেবে দেখাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। অথচ ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের লড়াইকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ফিলিস্তিনিদের যোদ্ধাদের সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। পশ্চিমা গণমাধ্যমের দৃষ্টিভংগীও একই রকম।
ভন্ডামির এ অভিযোগের মুখোমুখি শুধু যুক্তরাষ্ট্র একা নয়। যুক্তরাজ্য ও কানাডা ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অথচ গত বছর দুটি দুটি বলেছিল, এ আদালতের উচিত ইসরাইলের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করা।
আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থাগুলো একই চরিত্রের। উয়েফা স্কটিশ প্রিমিয়ার লিগের দল সেল্টিকের ভক্তরা আন্তর্জাতিক খেলায় ফিলিস্তিনের পতাকা উড়ালে তারা দাবি করে ওই পতাকা রাজনৈতিক প্রতীক। এজন্য জরিমানা করেছে সংস্থাটি। কিন্তু সাম্প্রতিক ম্যাচে সংস্থার অনুমোদন নিয়েই ইউক্রেনের পতাকা ব্যাপকভাবে ওড়ানো হয়েছে।
ফিলিস্তিন লেখক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ রফিক মাহাবিশ আল-জাজিরাকে জানান, ইউক্রেনের মানুষ রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে মলোটোভ বোমা নিক্ষেপ করলে বলা হবে হবে বীরত্ব। আর ফিলিস্তিনিরা সেটা করলে হবে সন্ত্রাস। এই বাস্তবতা শুধু ফিলিস্তিনের একার নয়। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, ইরাক, সোমালিয়া কিংবা কাশ্মীরসহ যেখানেই এ ধরনের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতার অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানকার জনগণেরও একই অনুভূতি হচ্ছে।
গত কিছু দিনের সংবাদপত্র, ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভরে উঠছে ইউক্রেনের জনগণের ‘বীরত্ব ও প্রতিরোধের গল্পে। রাশিয়ার ট্যাংকবহরের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে কীভাবে সেনারা ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছে। হাতের কাছে যা কিছু পাচ্ছে, তা-ই দিয়ে কীভাবে বেসামরিক নাগরিকেরা সশস্ত্র যানবাহনে হামলা চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষ কীভাবে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। পরিখা খুঁড়ছে। এসব বীরত্বপূর্ণ কাহিনি আমরা জানতে পারছি। ইউক্রেনের বদলে ফিলিস্তিনের কোথাও যদি এমন একটি ঘটনা ঘটত, তাহলে সেটা আর বীরত্বের কাহিনি থাকত না। সেটাকে স্রেফ সন্ত্রাস বলে দায়ী করা হতো।
অনেক বলছেন এখন ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, লিবিয়া কিংবা ইরাক নিয়ে কথা বলার সময় নয়। তারা বলছেন, এখন ভিন্ন কোনো প্রশ্ন তোলা মানে রাশিয়ার হাতকে শক্তিশালী করা। বাস্তবতা হলো বিশ্বব্যাপী সামরিক আগ্রাসন, দখলদারি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার এখনই উপযুক্ত সময়। এখন পশ্চিমের সব শক্তিশালী রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং এমনকি ইসরায়েলের শাসকেরা প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, আগ্রাসন ও দখলদারি খারাপ। তারাই এখন বলছেন, প্রতিরোধের অধিকার শুধু বৈধ নয়, সম্মানজনকও।
পাশ্চাত্যের আরেক কপটতা দেখা যায় শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও। ইউরোপের দেশগুলো লাখ লাখ ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুকে উষ্ণ সমাদরে গ্রহণ করেছে। অথচ মাস কয়েক আগেও আফগান শরণার্থীদের মুখের ওপর তারা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। পোল্যান্ডের সরকারি নিরাপত্তাকর্মী ও সেখানকার মানুষ বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। ইউক্রেন থেকে তাড়া খেয়ে আসা মানুষগুলোর মধ্যে যাদের গায়ের রং ইউরোপীয়দের মতো নয়, অর্থাৎ শেতাঙ্গ নয়, তারা তাদের ঢুকতে দিতে চাইছে না। এর আগে সিরীয় শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ইউরোপ কঠোর অবস্থান নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা শ্বেতাঙ্গ হওয়ার কারণে তাদের স্বাগত জানানো হয়। অন্যদিকে মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি তারা খুবই বৈরী।
মাইগ্রেশন পলিসি সেন্টারের ডিরেক্টর অ্যান্ড্রু গেডেস এবিসি নিউজকে বলেছেন, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করলেও ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ইউরোপ। উভয়ের মধ্যে রাত আর দিনের তফাত। তিনি বলেন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া এবং চেক রিপাবলিক সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের প্রতি খুবই নির্দয় ছিল। তারাই এখন ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য অনেক বেশি উদার-হৃদয়।
সিরিয়ার ৬৬ লাখ শরণার্থীর অর্ধেকই আশ্রয় নিয়েছে তুরস্কে। বিপরীতে ১০ লাখের কিছু সিরীয়কে নিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলি। তাদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ জার্মানিতে এবং ১১ শতাংশ সুইডেনে ঠাঁই পেয়েছে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুসারে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসাদের বেশিরভাগই পোল্যান্ডে আশ্রয় পেয়েছে। সম্প্রতি পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা একটি সীমান্ত ফ্যাসিলিটি পরিদর্শন করেছেন। সেখানে তিনি ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, পোল্যান্ড তাদের উন্মুক্ত হৃদয়ে স্বাগত জানাবে।
এর আগে সিরিয়ার আশ্রয়প্রার্থীদের নেওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপকেও পোল্যান্ড ক্রমাগত উপেক্ষা করেছে। পোল্যান্ডের ডানপন্থী দলের নেতা এবং বর্তমান উপ- প্রধানমন্ত্রী জারোস্তো কাকজিনস্কি ২০১৭ সালে বলেছিলেন তারা বিপজ্জনক। সিরীয়দের মুসলিম পরিচয়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছিলেন, তারা পোল্যান্ডের সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার জন হুমকি।
২০২১ সালের নভেম্বরে পোল্যান্ড আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের সীমান্তে আটকে দেয়। এজন্য বেলারুশের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জানুয়ারিতে পোল্যান্ড অভিবাসীদের আটকাতে বেলারুশ সীমান্তে ধাতব প্রাচীর নির্মাণ শুরু করে।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলেছেন, তারা ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের অবাধে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। অথচ এর আগে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, অ-খ্রিস্টান বা মুসলিম অভিবাসীদের আগমন তাদের সংস্কৃতির জন্য হুমকি। স্লোভাকিয়া এখন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৫ সালে দেশটির সরকার বলেছিল তারা শুধুমাত্র সিরিয়া থেকে আসা খ্রিস্টানদের গ্রহণ করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের শরণার্থীরা যদি রাশিয়ার নির্মমতার প্রমাণ হয়ে থাকে, তাহলে আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে প্রাণভয়ে আসা শরণার্থীরাও যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিষ্ঠুরতার বড় প্রমাণ। তবে এশিয়া ও আফ্রিকার শরণার্থীদের সঙ্গে ইউরোপের আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে পশ্চিমের আচরণ একেবারেই ভিন্ন ধরনের।