ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতিসহ তুরস্কের অর্থনীতি এখন নাজুক অবস্থায়। দেশের জনগণের মধ্যে নিজের ও দলের জনসমর্থন কমে যাওয়াসহ বেশকিছু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ আশেপাশের বিভিন্ন দেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি এরদোয়ানকে বড় ধরণের চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও এগিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে ঘরে-বাইরে নিজের অবস্থান সংহত করার জন্য তৎপর হয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তিনি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এজন্য তাকে বেশ কিছু ছাড় দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কতটুকু সফল হবেন এরদোয়ান তা নিয়ে থাকছে মোতালেব জামালীর প্রতিবেদন।
উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ২০১১ সালে শুরু হওয়া ‘আরব বসন্ত’ নামের গণআন্দোলনের প্রতি তুরস্কের সমর্থনের কারণে এই অঞ্চলের অনেক দেশের সাথেই তুরস্কের সম্পর্কের অবণতি ঘটে। আরব সরকারগুলো মনে করে এই গনআন্দোলনের সাথে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে আরব সরকারগুলো তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
এরদোয়ানের সরকার ও তার দল একে পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিয়ে থাকে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে তুরস্কের সম্পর্কের চরম অবণতি ঘটে। রাজতন্ত্র শাসিত এসব দেশের শাসকরা মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক দর্শনকে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার জন্য বড় বড় হুমকি হিসেবে দেখে। তবে কাতারের উপর থেকে জিসিসি অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়ার পর এরদোয়ান মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কন্স্যুলেটে দেশটির নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাড়ায়।
২০১৮ সালে তুরস্ক প্রবাসী সৌদি সাংবাদিক ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিষ্ট জামাল খাশোগির হত্যাকান্ডের জেরে তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সৌদি আরবকে কাবু করতে এই ইস্যুটি জোরালো ভাবে তুলে ধরে তুরস্ক। নিজের দেশে আলাদা বিচারের সিদ্ধান্তও নেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। দুই দেশের মধ্যে বিরোধের জেরে সৌদি আরবে তুর্কি পণ্য বয়কট করা শুরু হয়। সৌদি ব্যবসায়ীদের এমন সিদ্ধান্তে তুরস্ক থেকে আসা পণ্যের পরিমাণ ৯৮ ভাগ কমে গিয়েছিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে দু’দেশের মধ্যে আবারো সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
জামাল খাশোগিকে হত্যা নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেডিসেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ছাড় পেয়ে আসছিল সৌদি আরব। তবে বাইডেন ক্ষমতায় এসেই সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানকে এ হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করেন। অপরদিকে তুরস্কের শাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও চাপ প্রয়োগের কথা বলে আসছেন বাইডেন। ধারণা করা হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতেই নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে তুরস্ক ও সৌদি আরব। এরদোয়ানের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন জানিয়েছেন, দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হবে। এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন এরদোয়ান। গত বছর মার্চ থেকেই মিসরের আথে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার কথা বলে আসছে তুরস্ক।
কাতার ইউনিভার্সিটির ইবনে খালদুন সেন্টারের অধ্যাপক আলি বাকির মনে করেন, সৌদি আরব ও তুরস্কের সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগের মূল কারণ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে হেরে যাওয়া ও জো বাইডেনের ক্ষমতায় আসা। দুই দেশই স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে , বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নীতির বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ইরানকে মোকাবিলায় ট্রাম্পের নীতির বদল ঘটতে যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন যদি রিয়াদের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে তাহলে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের তাগিদও তারা অনুভব করতো না।
২০১৭ সালে সৌদি নেতৃত্বে কাতারের উপর উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ট্রাম্পের সমর্থনের কারণেই উপসাগরীয় অঞ্চলে বড় ধরণের সংকট দেখা দিয়েছিল। কাতারের সঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর জোট জিসিসি’র বিরোধ মিটে যাওয়ার পর তুর্কি-সৌদি সম্পর্কের উন্নতির পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে জিসিসি’র বৈঠকে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা কাতারের উপর আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহার ও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক পুন:স্থাপন করতে সম্মত হয়। দোহার সঙ্গে আকাশ ও সীমান্তও উন্মুক্ত করা হয় তখন। এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। তিনি বলেন, আমরা আশা করি উপসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতায় আমাদের সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হবে। এতে সহযোগিতা আরও জোরদার হবে।
তুরস্কের এই অবস্থানকে আরও গতি দিয়েছে আঙ্কারা ও রিয়াদের মধ্যে কাতারের মধ্যস্থতার প্রস্তাব। কাতারের বিশেষ দূত মুতলাক আল-কাহতানি বলেন, দুই দেশ যদি মনে করে মধ্যস্থতায় কাতারের ভূমিকা রয়েছে তাহলে আমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব। এটি হবে সবার জন্যই উপকারী।
জিসিসি’র বৈঠক ছাড়াও তুর্কি-সৌদি সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে জি-২০ সম্মেলনের শুরুতে এরদোয়ান ও সৌদি বাদশাহ ফোনালাপ করেছেন। উভয় নেতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধি ও অমীমাংসিত ইস্যু সমাধানের কথা বলেছেন। এছাড়াও সৌদি ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ওআইসির সম্মেলনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকের পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টুইটারে জানিয়েছিলেন, তাদের সম্পর্ক শুধু দুই দেশের নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই উপকারী হবে। এরপর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে ২০২১ সালের ৬ মে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সাথে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান টেলিফোনে আলাপ করেছেন। তুরস্কের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এ খবর জানানো হয়।
সৌদি বাদশাহ ও তুর্কি প্রেসিডেন্টের মধ্যে সে সময় এক মাসের মধ্যে দুই দফা ফোনালাপ হয়। এরদোয়ান এ সময় সৌদি বাদশাহকে ঈদুল ফিতরের আগাম শুভেচ্ছ জানান। জবাবে সৌদি বাদশাহও তুরস্কের জনগণ ও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে শুভেচ্ছা জানান। তুরস্কের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দু’দেশের সম্পর্ক কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায় তা নিয়ে দুই নেতা আলোচনা করেছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তুরস্কের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল , ফেব্রুয়ারি মাসেই সৌদি আরব সফরে যাবেন এরদোয়ান। কিন্তু সেই সফর আর বাস্তবায়িত হয়নি। সৌদি আরবের পরিবর্তে এরদোয়ান ফেব্রুয়ারি মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যান। সেখান থেকে দেশে ফিরে এরদোয়ান জানান, তার দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যেতে চায়। এরদোগান বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের ইতিবাচক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কে অগ্রগতির জন্য অপেক্ষা করছি।
এরদোগানের সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে দুই দেশ প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে ১৩টি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এরদোগান তুরস্কে বিনিয়োগের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সৌদি আরব সফরে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বি দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে এরদোয়ান যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার মধ্যে সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগানোই তার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এই পথ সুগম করতেই তুরস্কে সৌদি কন্স্যুলেটে জামাল খাসোগি হত্যাকান্ডের বিচার বাতিল করে দিয়েছে তুরস্কের একটি আদালত। এই হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত ২৬ সৌদি নাগরিকের অনুপ¯ি’তিতে দেশটিতে এই বিচার কার্যক্রম চলছিল। গত ৮ এপ্রিল তুর্কি আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, মামলাটি সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সৌদির সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যেই এরদোয়ান সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানবাধিকার গ্রুপগুলোর সতর্কতা সত্ত্বেও তুরস্কের আদালত এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
মানবাধিকার গ্রুপগুলোর দাবি, তুর্কি আদালতের এমন সিদ্ধান্তে সৌদি আরব মামলাটি গোপন করার সুযোগ পাবে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়া তুরস্ক এখন সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চায়। বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, তুরস্কে সৌদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা বাতিলের শর্তে আঙ্কারার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সম্মতি দিয়েছে রিয়াদ।
আঙ্কারায় ওরসাম সেন্টার ফর মিডিল ইষ্টার্ন ষ্টাডিজের উপপচিালক ইসমাইল নুমান টেলসি মনে করেন, সৌদি আরবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আসন্ন সফর হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সফর দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার পরিবেশকে অনেকটাই সামনে এগিয়ে নেবে। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের দুটি বৃহৎ দেশের রাজনৈতিক ওজন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব দুই দেশের সম্পর্ককে আরো কাছাকাছি আনবে।
তুরস্কে সৌদি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এই সফরের অন্যতম লক্ষ্য। একাজে তিনি সফল হলে তুরস্কের মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিও কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে। এতে ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের বিজয়ের পথ কিছুটা হলেও সহজ করে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।