আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে ইউরোপ। ইউক্রেনে যে যুদ্ধ চলছে, সেটা মূলত রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর যুদ্ধ। এখানে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউক্রেন। এই যুদ্ধের পেছনে ন্যাটোর উদ্দেশ্য হলো রাশিয়াকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া। সম্ভব হলে মস্কোতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটানো। তারা মনে করছে, এটা করা গেলে চীনের উত্থান ঠেকানো সম্ভব হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত দেশ জার্মানিকে জোর করে মাথা নত না করানোর ব্যাপারে অনেকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু সে কথায় কেউ কান দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই জার্মানি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে ফিরে এসেছিল। এখন রাশিয়াকেও একইভাবে দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে। একটি যুদ্ধে ইউরোপ হয়তো জিততে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের জন্য ভয়াবহ পরাজয় অপেক্ষা করছে। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একশ বছরেরও বেশি সময় পরে ইউরোপের নেতারা এখন প্রায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নতুন একটা বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ১৯১৪ সালে ইউরোপের সরকারগুলো ভেবেছিল যুদ্ধ তিন সপ্তাহের মতো স্থায়ী হবে। সেই যুদ্ধ চার বছর দীর্ঘ হয়েছিল। মারা গিয়েছিল ২০ মিলিয়নের বেশি মানুষ। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও সেই একই ধরণের উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে।
সবচেয়ে প্রচলিত ভাবনা হলো যে আগ্রাসন চালাবে তাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে এবং মাথা নত করতে বাধ্য করা হবে। সে সময়, হেরে যাওয়া দেশটি ছিল জার্মানি। জন মেইনার্ড কেইনেসের মতো কিছু ভিন্ন মতের মানুষ বলেছিলেন, জার্মানিকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা হলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। তার কথা কানে তোলেনি কেউ। একুশ বছর পরে আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইউরোপ। এবার যুদ্ধ স্থায়ী হলো ছয় বছর। আর মারা গেলো ৭০ মিলিয়ন মানুষ।
ইতিহাসের ঠিক পুনরাবৃত্তি হয় না। আর সেখান থেকে কেউ কিছু শেখে বলেও মনে হয় না। তবে বিভিন্ন ঘটনার মিল অমিল নিয়ে কিছু ছবি পাওয়া যায়। ১৯১৪ সালের আগের একশ বছর মোটামুটি শান্তিতেই কাটিয়েছে ইউরোপ। যে সব ছোট খাটো যুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো ছিল স্বল্পস্থায়ী।
এই শান্তি বজায় ছিল 'কংগ্রেস অব ভিয়েনার' কারণে। স্থায়ী শান্তির জন্য কংগ্রেস অব ভিয়েনার অধীনে নেপোলিয়নের সময়ের যুদ্ধের বিজয়ী ও পরাজিতদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছিল। কংগ্রেসের চেয়ারম্যান ছিলেন ক্লেমেন্স ভন মেত্তেরনিশ। তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যাতে পরাজিত শক্তি ফ্রান্স তার পরাজয়ের মূল্য হিসেবে কিছু ভূখন্ড ছেড়ে দেয়। একই সাথে শান্তি ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে তারা যাতে অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, প্রুশিয়া এবং রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
নেপোলিয়নের সময়ে যুদ্ধ হয়েছিল ইউরোপিয় শক্তিগুলোর মধ্যে। কিন্তু এখন যে যুদ্ধ চলছে, সেটার এক পক্ষে রয়েছে ইউরোপিয় শক্তি রাশিয়া, অন্যদিকে অ-ইউরোপিয় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র। এটা একটা প্রক্সি যুদ্ধ। উভয় পক্ষই এখানে তৃতীয় একটি দেশ ইউক্রেনে নিজেদের ভূ কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য লড়ছে, যে লক্ষ্য এই দেশ বা মহাদেশের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধ করছে, কারণ এটা আসলে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশান বা ন্যাটোর সাথে যুদ্ধ। আর এই ন্যাটোর কমান্ড দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত স্বার্থে কাজ করে এসেছে।
রাশিয়া একসময় জনগণের স্বাধিকারের প্রশ্নে চ্যাম্পিয়ন ছিল। এখন তারা নিজেদের নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে সেই নীতিগুলো ছেড়ে দিয়েছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর তারা এখন যুদ্ধে নেমেছে।
অন্যদিকে, প্রথম শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার পরাজয়ের ক্ষতকে আরও গভীর করার চেষ্টা করে গেছে। রাশিয়ার এই পরাজয়ের বেশির ভাগই অবশ্য তাদের নিজেদের কারণে হয়েছে। প্রতিপক্ষের শক্তির ভূমিকা ছিল সেখানে ছিল খুবই সামান্য।
ন্যাটোর দৃষ্টিকোণ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের লক্ষ্য হলো রাশিয়াকে শর্তহীন পরাজয় মানতে বাধ্য করা। সম্ভব হলে এই পরাজয়ের মাধ্যমে মস্কোতে ক্ষমতার বদল ঘটানো। যুদ্ধ কতদিন চলবে, সেটা নির্ভর করছে এই লক্ষ্য অর্জনের উপর।
যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে রাশিয়া কেন উৎসাহী হবে, যেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন বলেই দিয়েছেন , যুদ্ধের ব্যাপারে রাশিয়া যে সিদ্ধান্তই নিক, তার উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন সরে গেলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? নাকি ন্যাটো দেশগুলো চায়, খোদ রাশিয়াই যাতে দৃশ্যপট থেকে সরে যায়, যাতে চীনের সম্প্রসারণকে ঠেকানো যায়।
১৯১৮ সালে জার্মানিকে যখন মাথা নোয়াতে বাধ্য করা হয়েছিল, তখন সেখানেও ক্ষমতার পালাবদল হয়েছিল। কিন্তু জার্মানিতে পরে ক্ষমতায় আসে এডলফ হিটলার, এবং তার সাথে আসে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়কর যুদ্ধ।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকির সামনে এখন দুটো বিকল্প। একটি হলো, তার ইমেজ গড়ে উঠবে একজন সাহসী দেশপ্রেমিক হিসেবে, যিনি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশকে রক্ষার জন্য লড়ে গেছেন। আরেকটি ইমেজ হতে পারে, তিনি সাহসী দেশপ্রেমিক, এবং দেশের অগণিত নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে তিনি মিত্রদেরকে জড়ো করে সমঝোতায় নেমেছেন, যাতে একটা মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে শান্তি আনা যায়। বাস্তবতা হলো, প্রথম বিকল্পটাই এখন বেশি দৃশ্যমান। খুব সম্ভবত সিদ্ধান্তগুলো প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকির ব্যক্তিগত পছন্দের ভিত্তিতে হচ্ছে না।
বিংশ শতকে যে দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, সে সময় ইউরোপ ছিল স্বঘোষিত পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে। এ জন্যই আমরা এই যুদ্ধ দুটোকে বিশ্বযুদ্ধ বলি। অথচ ইউরোপিয় সেনাদের মধ্যে প্রায় চার মিলিয়ন ছিল আফ্রিকান আর এশিয়ান। এই দুই যুদ্ধে যে হাজার হাজার অ-ইউরোপিয় নিহত হয়েছে, তাদেরকে আনা হয়েছিল দূরবর্তী সব ঊপনিবেশ থেকে। এই ভাবে প্রত্যন্ত সেই দেশগুলোও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। যাদের আসলে যুদ্ধের সাথে সরাসরি কোন সম্পৃক্ততা ছিল না।
এখন ইউরোপ বিশ্বের একটা ছোট্ট অংশ মাত্র। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেটা হয়তো আরও ছোট হয়ে যাবে। বহু শতক ধরে ইউরোপ ছিল মূলত ইউরেশিয়ার পশ্চিম প্রান্ত। এই ইউরেশিয়ার বিস্তৃতি ছিল চীন থেকে নিয়ে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ পর্যন্ত। এই বিস্তৃত অঞ্চলের এ মাথা ও মাথা তখন জ্ঞান, পণ্য, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন, এবং সংস্কৃতির লেনদেন হতো।
ইউক্রেন যুদ্ধ যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলে, তাহলে ইউরোপ শুধু তাদের ঐতিহাসিক এক শক্তি রাশিয়াকেই হারাবে না, একইসাথে রাশিয়া বাকি বিশ্ব থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, এমনকি চীন থেকেও।
ইউরোপিয় বা উত্তর আমেরিকার চশমা দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, বিশ্বের ব্যাপ্তি তার চেয়েও অনেক বড়। এই চশমা দিয়ে দেখার কারণেই ইউরোপিয়ানরা নিজেদের এত শক্তিশালি মনে করে। অংশীদারদের তারা আশেপাশেই দেখতে পায়। তাদের বিশ্বাস, তারা ইতিহাসের সঠিক পক্ষে রয়েছে। পুরো বিশ্ব এখন উদারতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা চালিত হচ্ছে। বিশ্বকে অনেক শক্তিশালী মনে হচ্ছে। তাদের চশমা দিয়ে মনে হচ্ছে, চীনের প্রধান অংশীদার রাশিয়াকে ধ্বংস করার পর শিগগিরই এক পর্যায়ে চীনকেও কাবু করে ফেলা যাবে।
অন্যদিকে, অ-ইউরোপের চশমা দিয়ে দেখলে মনে হয় ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র পুরো একাকি হয়ে পড়েছে। হয়তো একটা যুদ্ধ তারা জিততে পারবে। কিন্তু এই যাত্রাপথে ইতিহাসের বড় ধরণের পরাজয় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। জাতিসংঘের বহু সদস্য দেশ ইউক্রেনে অভিযানের বিপক্ষে তাদের ভোট দিয়েছে, সেটা তারা দিয়েছে তাদের অভিজ্ঞতার কারণে। এদের মধ্যে বহু দেশ আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। কিন্তু সেখানে আগ্রাসী দেশ রাশিয়া ছিল না। তাদের উপর আগ্রাসন চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর ইসরাইল।
বিশ্বের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা যে সব দেশে বাস করছে, সেই দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ভোটে অংশ নেয়নি। তারা কোন মুর্খতা থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং সতর্কতা থেকে এটা করেছে।
তারা কিভাবে সেই দেশগুলোকে বিশ্বাস করবে, যে দেশগুলো সুইফট তৈরি করেছে, যেটি তৈরির উদ্দেশ্যই ছিল আর্থিক লেনদেনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের হাত থেকে রক্ষা করা। অথচ সেই রাজনৈতিক কারণেই তারা একটি দেশকে সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
সেই দেশগুলোকে কিভাবে বিশ্বাস করা যায়, যারা অন্য সার্বভৌম দেশের আর্থিক সম্পদ আর সোনার রিজার্ভ জব্দ করে সেটা নিয়ে গর্ব করে। আফগানিস্তান, আর ভেনেজুয়েলার সম্পদ জব্দ করার পর এবার রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যে দেশগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সার্বজনিন মূল্যবোধ হিসেবে ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ায়, সেই দেশগুলোই আবার অন্যদের কণ্ঠরোধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে, যখন তাদের নিজেদের আসল চেহারা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে।
যে দেশগুলোর গণতন্ত্রকে উদযাপন করার কথা, সেই দেশগুলোই আবার অন্য দেশে ক্যু সাজায়, যখন সেখানে তাদের স্বার্থের বিরোধী কোন সরকার আসে। এই দেশগুলো এমনই যে, পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় রাতারাতি নিকোলাস মাদুরো একনায়ক থেকে তাদের বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে ওঠে। বিশ্ব এখন আর মোটেই নিষ্পাপদের জায়গা নেই। যেটুকু বা ছিল, সেটা অতীত হয়ে গেছে।