ইউক্রেন যুদ্ধে আসলে কত মানুষ মারা গেছে?

-

  • হায়দার সাইফ
  • ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১৪:২৭

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাদের হতাহতের সংখ্যা নিয়ে নানা রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা নিয়েও নানা হিসেব দেখানো হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত নিহতের সংখ্যা আসলে কতো? যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা গণনা করা আসলে যথেষ্ট জটিল। নানা কারণে প্রকৃত সংখ্যা বের করা প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হতাহতের যে সংখ্যার কথা বলছে, সেটা অসম্পূর্ণ। যুদ্ধরত বিভিন্ন পক্ষ ইচ্ছা করেই প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করছে না। কারণ, এতে তাদের সেনাবাহিনী ও জনগণ নৈতিক মনোবল হারাতে পারে। হামলাকারী দেশ অনেক সময় নিহত বেসামরিক নাগরিকদেরকেও যোদ্ধা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। সেই সাথে রয়েছে পরোক্ষ মৃত্যু , যে হিসেব যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে বলা যায়, হতাহতের যে সংখ্যা বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাস্তব সংখ্যা তার চেয়ে যথেষ্ট বেশি। বিস্তরিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে।


যারা যুদ্ধ শুরু করে, তাদের সবসময় একটা ইতিবাচক ধারণা থাকে। যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং হতাহত হবে সামান্য। কিন্তু যখন বহু লাশ ঘরে ফিরতে শুরু করে, অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকে, তখন বোঝা যায় যুদ্ধটা ঠিক হিসেব কষে হয় না।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা নিয়ে ক্রেমলিন প্রথম বিবৃতি দিয়েছিল ২ মার্চ। তারা বলেছিল, যুদ্ধে তাদের ৪৯৮ জন সেনা মারা গেছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৫৯৭ জন। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার মিডিয়া কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না বলে শুধু বলে গেছে যে, ইউক্রেনে সেনাদের নিহত ও আহত হওয়ার সংখ্যা অনেক কম।
কিন্তু ২১ মার্চ রাশিয়ান ট্যাবলয়েড পত্রিকা কোমসোমোলস্কায়া প্রাভদা জানায়, যুদ্ধে রাশিয়ার ৯ হাজার ৮৬১ জন সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৬ হাজার ১৫৩ জন। সামান্য কিছু সময়ের জন্য রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছিল। এরপর সেটা আবার সরিয়ে নেয়া হয়। সরকারপন্থী সংবাদপত্র জানিয়েছে যে, ওই সংখ্যা সঠিক ছিল না। এর কয়েক দিন পরে ক্রেমলিন তাদের নতুন হতাহতের হিসাব জানায়। সেখানে বলা হয় রাশিয়ার এক হাজার ৩৫১ জন সেনা নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে তিন হাজার ৮২৫ জন।
এদিকে, ২৪ মার্চ ন্যাটোর কর্মকর্তারা জানায় যে, তাদের হিসেবে সাত থেকে ১৫ হাজার রাশিয়ান সেনা যুদ্ধে নিহত হয়েছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলেছেন, আসল সংখ্যাটা হলো ১৫ হাজার।


এই সব বিভিন্ন হিসাব থেকে বোঝা যাচ্ছে, যুদ্ধে বহু সামরিক ও বেসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে। তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত - সেটা আমরা জানি না। যুদ্ধে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সব সময় যুদ্ধ চলাকালে এবং যুদ্ধের পরে এই বিতর্ক চলে যে কতজন সেনা ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। যুদ্ধের কারণ হিসেবে সবসময় যেমন বিভিন্ন ইস্যুর কথা বলা হয়, হতাহতের সংখ্যা নিয়েও তেমনি নানা রকম তথ্য দেয়া হয়। কিন্তু যুদ্ধে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা বের করাটা কেন এত কঠিন? আর ইউক্রেনের যুদ্ধের অবস্থানটাই বা কোথায়?


যুদ্ধের প্রাথমিক কৌশলগত লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষের সেনাদের যত বেশি পারা যায় হত্যা করা। আরেকটি লক্ষ্য থাকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক হতাহত এড়ানো। কিন্তু সেটা নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করাটা সহজ নয়। সে কারণে যুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক হতাহতের আসল অঙ্কটা সবসময় হিসাবের বাইরেই থেকে যায়।
এমনকি সামরিক বাহিনী যখন তাদের নিজেদের আহত নিহতের ভালোমতো হিসেব রাখে, তখনও সেখানে অনিশ্চয়তা থেকে যায়। ইউনাইটেড নেশান্স হিউম্যান রাইটসের হাই কমিশনের অফিস থেকে নিয়মিত ইউক্রেনে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা জানানো হচ্ছে। তারা জানিয়েছে, যুদ্ধের প্রথম মাসে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ মার্চের মধ্যে এক হাজার ৩৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৬৫০ জন।
তবে জাতিসংঘ এটাও বলেছে, আসল হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, যে সব জায়গায় সঙ্ঘাত তীব্র ছিল, সেখান থেকে তথ্য পেতে সময় লেগেছে তাদের। এছাড়া, অনেক তথ্য যাচাইয়ে দেরি হওয়ায় সেটা গণনায় ধরা হয়নি।
জাতিসংঘ বলেছে যে, তাদের হিসেবে প্রকৃত সংখ্যা আসেনি। মার্চের শেষ দিকে, মারিউপোলের মেয়রের অফিস থেকে জানানো হয়, শুধুমাত্র সেখানেই প্রায় ৫ হাজার মানুষ মারা গেছে। রাশিয়া সেখানে একটি প্রসুতি হাসপাতালে বোমা ফেলেছে বলে অভিযোগ করে ইউক্রেন।


যুদ্ধরত এলাকায় মৃতের সংখ্যা হিসাব করাটা যথেষ্ট কঠিন। কারণ, সেখানকার মৃতদেহগুলো সময়মতো উদ্ধার করা যায় না। অনেক মৃতদেহ এমনকি কখনই উদ্ধার হয় না। যখন গণনার চেষ্টা করা হয়, তখন অনেক কারণে সংখ্যা বাদ পড়ে যায়। এমনও হতে পারে যে, কোন সেনাকে মৃত ভেবে ফেলে যাওয়া হলো। পরে সে হয়তো আহত অবস্থায় বন্দি হলো। এবং তাকে হয়তো হাসপাতালে বা অন্য কোথাও নেয়া হলো। এরপরের সমস্যা হলো কাকে কোন শ্রেণীতে ফেলা হবে। বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা অনেক সময় সরাসরি অস্বীকার করা হয়। সিরিয়াতেও এমনটা হয়েছে। আবার অনেক সময় বেসামরিক মানুষদেরকে যোদ্ধা হিসেবে গণনা করা হয়।


যে সব দেশ যুদ্ধে বেপরোয়া আচরণ লুকাতে চায় এবং বেসামরিক নাগরিকদেরকে টার্গেট আড়াল করতে চায় তারা দাবি করে থাকে, হতাহতের সবাই আসলে যোদ্ধা ছিল। আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক বাহিনী এবং আফগান সেনারা মাঝে মাঝেই দাবি করতো , হামলায় যারা নিহত হয়েছে, তাদের সবাই ছিল জঙ্গি। কিন্তু পরে তদন্তে দেখা গেছে, হতাহতের একটা অংশ বা সবাই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
এ ধরণের বহুল আলোচিত একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে। জার্মান বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল , দুটো তেলের ট্যাঙ্কার তালেবানরা চুরি করেছে। সেগুলোকে মানুষ ঘিরে রেখেছে এবং সেখান থেকে তারা তেল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে বিমান হামলা চালানোর আহ্বান জানায় জার্মান বাহিনী। ন্যাটো জানায়, সেখানে হামলায় যারা মারা গেছে, তাদের বেশির ভাগই জঙ্গি। পরে তদন্তে দেখা যায় যে, সেখানে হামলায় ৯১ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছে।
যুদ্ধে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা থাকে। এর বাইরে অনেক সরকারই কৌশলগত বা রাজনৈতিক কারণে হতাহতের ভুল সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে। সেনা ও জনগণের নৈতিক মনোবল ধরে রাখার জন্য যুদ্ধরত বিভিন্ন দেশ দাবি করে থাকে তাদের সেনা মারা গেছে কম। প্রতিপক্ষের সেনা মারা গেছে বেশি।


রাশিয়ার ব্যাপারে এ ধরণের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাদের সেনাবাহিনী জ্বালানি ও খাবার সঙ্কটে ভুগছে। প্রতিপক্ষের দিক থেকে যে প্রতিরোধের আশা করেছিল তারা, তার চেয়ে বেশি বাধার মুখে তারা পড়েছে। এ অবস্থায় নৈতিক মনোবল সামলানো তাদের জন্য কঠিন হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার মোট কত সেনা মারা গেছে, তার চেয়ে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের বড় উদ্বেগ হলো কারা মারা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ইউক্রেনে কমবেশি ২০ জন জেনারেল পাঠিয়েছে রাশিয়া। তাদের মধ্যে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সেনাদের কমান্ড করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সক্ষমতার উপর এটা বড় ধরণের একটা আঘাত।


ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। যুদ্ধের শুরুর দিকে, প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি ইঙ্গিত দেন যে, ১৩০০ এর মতো ইউক্রেনিয় সেনা নিহত হয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেন সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করা হবে না।
যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনে আরেকটি সুক্ষ্ম সমস্যা রয়েছে। সেটা হলো যুদ্ধের মাঠে সরাসরি নিহতের সংখ্যা গোনা। আর পরোক্ষভাবে নিহতের সংখ্যা গোনা। সরাসরি নিহত ধরা হয় তাদেরকে, যারা প্রত্যক্ষ সহিংসতার কারণে মারা যায়। বোমা হামলা, বুলেটের আঘাত, বা ভবন ধসে এ ধরণের মৃত্যু হতে পারে।

পরোক্ষ মৃত্যুর ব্যাপ্তি আরও বড় হতে পারে। যুদ্ধের কারণে খাবার, পানি, ওষুধ, ও চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হলে, অথবা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতাসহ পালাতে গিয়ে মৃত্যু হলে সেগুলোকে পরোক্ষ মৃত্যু হিসেবে ধরা হয়।
আবার অনেক সময় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও যুদ্ধের ধকল চলতে থাকে। এবং সে রকম পরিস্থিতিতেও অনেকে মারা যায়। সেই হিসেবে যুদ্ধে পরোক্ষ নিহতের সংখ্যা আরও বেশি।
যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিহতের সংখ্যা কমবেশি হয়ে থাকে। যেখানে অবকাঠামোর বড় ধরণের ক্ষতি হয়, সেখানে পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা প্রত্যক্ষ মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে।