ফিলিপাইনের বিমান বাহিনী সম্প্রতি তুরস্ক নির্মিত দুটো টি-ওয়ান টুয়েন্টি নাইন এ্যাটাক হেলিকপ্টার গ্রহণ করেছে। ফিলিপাইনের ন্যাশনাল ডিফেন্সের সেক্রেটারী ডেলফিন লোরেনজানা হেলিকপ্টার দুটি গ্রহনের সময় দিনটিকে ফিলিপাইনের বিমান বাহিনীর জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন বলেও আখ্যায়িত করেন। তুরস্কের সমরাস্ত্রের বিষয়ে ফিলিপাইনের এই আগ্রহের নেপথ্য কারণ ও তুরস্কের এ্যাটাক হেলিকপ্টার নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন।
দীর্ঘদিন ধরেই ম্যানিলা প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। দক্ষিন চীন সাগরে চীনের সাথে ফিলিপাইনের উত্তেজনা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অনেক বেড়ে গেছে। ফিলিপাইন দেশকে বহি:শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমন থেকে রক্ষা করার জন্য নানা ধরনের উন্নত অস্ত্র ক্রয় করার চেষ্টা করছে। ফিলিপাইনের এই কৌশলের অংশ হিসেবেই এবার তুরস্ক থেকে হেলিকপ্টার সংগ্রহ করলো।
হেলিক্টার দুটো গ্রহনের সময় এক অনুষ্টানে দেশটির ডিফেন্স সেক্রেটারি ডেলফিন লোরেন জানান ফিলিপাইন বিমান বাহিনীর দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন পুরন হলো। তুরস্কের টিওয়ান টোয়েন্টি নাইন এ্যাটাক হেলিকপ্টারকে বর্তমান সময়ের হেলিকপ্টারের মধ্যে সবচেয়ে আগ্রাসী ও কার্যকর হেলিকপ্টার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই হেলিকপ্টারের জন্য প্রয়োজনীয় সিরিয়াল ডোকশনের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ যন্ত্রাংশই তুরস্কেই তৈরি করা হয়। এই হেলিকপ্টার হলো ভবিষ্যত প্রজন্মের একটি হেলিকপ্টার। দুই সিট এবং দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই হেলিকপ্টারগুলো বহুবিধ ভুমিকা পালন করতে পারে।
প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমন, নজরদারি, অগ্নি নির্বাপনে সহায়তা, আকাশ নিরাপত্তা, প্রতিপক্ষের স্থাপনা সঠিকভাবে সনাক্ত করতে পারে। শত্রুর সীমানার ভেতর গিয়ে হামলা, সশস্ত্র নিরাপত্তা এবং শহুরে যুদ্ধসহ নানা ক্ষেত্রে এই হেলিকপ্টারটি খুবই কার্যকর।
প্রতি ঘন্টায় এই হেলিকপ্টারগুলো ২৮১ কিলোমিটার স্পিডে উড়তে পারে। প্রতিবারে সর্বোচ্চ ৫৩৭ কিলোমিটার পথও উড়তে পারে। একবার টেক অফ করার পর টিওয়ান টোয়েন্টি ওয়ান এ্যাটাক হেলিকপ্টার তিন ঘন্টা একটানা উড়তে পারে। একইসঙ্গে ৫ টন ওজন বহন করে ৪৫৭২ মিটার উচ্চতা দিয়ে পরিভ্রমন করতে পারে। এই হেলিকপ্টারগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে এগুলো বেশি উচ্চতায় এবং উচ্চ তাপমাত্রায় দিনে ও রাতে যেকোনো সময় একইভাবে কার্যকর থাকতে পারে। এই হেলিকপ্টারগুলো দিয়ে ভৌগলিকভাবে দুর্ভেদ্য এলাকাতেও খুব সহজেই মিশন পরিচালনা করাও সম্ভব।
সক্ষমতা, সহজ সক্রিয়তা এবং পরিবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এই হেলিকপ্টারগুলোর নকশা প্রনয়ণ করা হয়। এ কারণে টি ওয়ান টোয়েন্টি নাইন প্রতিপক্ষের নজরে না পড়েও উচ্চ গতিতে যাতায়াত করতে পারে।
এই হেলিকপ্টারগুলো শত্রুপক্ষের অগোচরে মিশন সম্পন্ন করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করায় উড়ার সময় তেমন কোনো শব্দ হয় না। প্রতিপক্ষের রাডারেও এর অস্তিত্ব ধরা পড়ে না। এই হেলিকপ্টারের সাথে উচ্চমাত্রার ব্যালিস্টিক অস্ত্র বহণ করা যায়। একইসঙ্গে, এতে ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমও উন্নত করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে এই হেলিকপ্টারের পারদর্শিতা অন্য যেকোনো হেলিকপ্টারের তুলনায় অনেক বেশি।
এই এ্যাটাক হেলিকপ্টারে আরো আছে এডভান্সড ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং কাউন্টার মেজার সিস্টেম। এতে সংযোজন করা হয়েছে রাডার ওয়ার্নিং, রাডার ফ্রিকুয়েন্সি মিক্সিং, লেজার গাইডেন্স কাউন্টার মেজার্স এবং রাতের বেলায় যাতায়াতের জন্য ইনফ্রাড ইলেক্ট্রো-অপটিকস।
আক্রমন ও নজরদারির সক্ষমতা সম্বলিত এই হেলিকপ্টারে আরো আছে তিন ব্যারেলের ২০ মিলিমিটার ঘূর্নায়মান ক্যানন বুলেটস। যেখানে ৭৬টি আনগাইডেড রকেটস অথবা ৫শটি স্বল্পপাল্লার সহায়ক যুদ্ধাস্ত্র লাগানো যাবে। সাথে সমরাস্ত্র হিসেবে আরো আছে ৮টি ইউএমটিএএস এন্টি ট্যাংক মিসাইল, ১৬টি সিআইআরআইটি লেজার-গাইডেড মিসাইল এবং ৮টি স্টিনজার এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল।
হেলিকপ্টারের পাইলটেরা ভরসা রাখছেন বিশেষভাবে নকশাকৃত হান্টার হেলমেটের ওপর। এই হেলমেটগুলোর কারণে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো সহজে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। পাইলটরা লাইন অব সাইটের মাধ্যমে খুব সহজে প্রতিপক্ষের স্থাপনাও সনাক্ত করে নিতে পারেন।
ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই অধিকাংশ হেলিকপ্টারগুলো ক্রয় করতো। ইতোমধ্যেই তাদের হাতে থাকা ভিয়েতনাম যুগের বেল হুয়ি হেলিকপ্টারগুলোর আবেদন ফুরিয়েছে। এগুলোর মেয়াদও নেই। বর্তমান সময়ের যুদ্ধ কৌশলে তেমন একটা আবেদনও নেই।
ফিলিপাইনের বুকিডনে গত বছর একটি বেল-ইউএইচ ওয়ানডি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ৭ জন নিহত হওয়ার পর এই হেলিকপ্টারের অকার্যকারিতা আরো বেশি করে প্রমাণিত হয়। এরপর চলতি বছরের শুরুতে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে এই হেলিকপ্টারগুলো ডি-কমিশন করার নির্দেশনা দেন। ২০১০ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত ৬টি বেল হেলিকপ্টার কারিগরি ত্রুটি ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে আরো ৭টি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। তখন থেকেই ফিলিপাইনের হেলিকপ্টার সক্ষমতা বৃদ্ধি করার বিষয়টি জোরেশোরে সামনে চলে আসে।
২০১৭ সাল থেকে এ্যাটাক হেলিকপ্টারের দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিলিপাইন। হালকা মানের সশস্ত্র হেলিকপ্টারের তুলনায় নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত এ্যাটাক হেলিকপ্টারের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি হয়। আর তখন থেকেই দৃশ্যপটে চলে আসে তুরস্ক ।
যুদ্ধক্ষেত্রে এমডি-ফাইভ টোয়েন্টি এমজি ডিফেন্ডার এবং এডব্লিউ-হান্ড্রেড নাইন-ই পাওয়ার হেলিকপ্টার- এ দুটো হেলিকপ্টারের মধ্যেই ফায়ার পাওয়ারের যথেষ্ট রকমের ঘাটতি রয়ে গেছে। এ কারনে ফিলিপাইনের বিমান বাহিনীর টেকনিকাল ওয়ার্কিং গ্রুপ মার্কিন হেলিকপ্টারের চেয়ে তুরস্কের টাই- টিওয়ার টোয়েন্টি নাইন এ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলোকে এগিয়ে রাখেন।
ফিলিপাইনের নীতি নির্ধারকরা বাজার যাচাই করে দেখেন, তারা যে দামে ৫টি বেল-এএইচ-আইজেড ভাইপার বা চারটি বোয়িং এএইচ-সিক্সটি ফোর এ্যাপাচি ক্রয় করবে, তার চেয়ে অনেক কম দামে তারা ৬টি টাই- টিওয়ার টোয়েন্টি নাইন এ্যাটাক হেলিকপ্টার কিনতে পারবে। দাম ও কার্যকারিতা- দুক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হেলিকপ্টারের চেয়ে তুরস্কের এ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলো অধিক উপযোগী।
মার্কিন হেলিক্টারের সাথে তুরুস্কের হেলিকপ্টারের পর্যালোচনার পর ফিলিপাইন তুরস্ক থেকে ৬টি টিওয়ার টোয়েন্টি নাইন এ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার জন্য চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী তুরস্কের এ্যারোস্পেস ইন্ড্রাস্ট্রিজ এই বিমানগুলোর নির্মাণ শুরু করে। ৬টি টাই- টিওয়ার টোয়েন্টি নাইন এ্যাটাক হেলিকপ্টারের দাম নির্ধারন হয় ২৬৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, যদি ফিলিপাইন ৫টি বেল-এএইচ-আইজেড ভাইপার ক্রয় করতো তাহলে তাদের খরচ হতো ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যদি ফিলিপাইন ৬টি এএইচ-ওয়ান সুপারকোবরা কিনতে চাইতো, তাহলে দেশটিকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হতো। ফিলিপাইনের নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন, তুরস্ক থেকে ৬টি টাই- টিওয়ার টোয়েন্টি নাইন এ্যাটাক হেলিকপ্টার কিনে তারা সবদিক থেকেই লাভবান হয়েছেন।
আগামীতেও উন্নত ও সর্বাধুনিক সমর প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র ক্রয় করার জন্য ফিলিপাইন হয়তো তুরস্কের ওপর অনেকটা ভরসা রাখবে। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে তুরস্কের এরোস্পেস ইন্ড্রাস্টি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। তুরস্কের বায়রকতার ড্রোন এখন দুনিয়া জুড়ে আলোচিত। নাগারনো কারবাখের পর ইউক্রেন যুদ্ধ এই ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। ধারনা করা হয় তুরস্কের অ্যাটাক হেলিকপ্টারের বাজারও সম্প্রসারিত হবে।