ইউরোপর সাথে চীনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রায় ৫০ বছর আগে। ১৯৭৫ সালে দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ এই সময়ে চীন ও ইউরোপের মধ্যে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে চীনের অবস্থান গ্রহণ, তাইওয়ান ইস্যুতে চীন-মার্কিন উত্তেজনা ও চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে চীনের সাথে ইউরোপের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর পর থেকে গত ১৫ মাসে চীনের সাথে ইউরোপের সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। দুই পক্ষের সম্পর্কে অবনতির আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লংঘনের কারণে ২০২১ সালে কিছু চীনা কর্মকর্তা এবং সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বেইজিং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই সময় থেকে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বড় একটি বিনিয়োগ চুক্তি স্থগিত রয়েছে। এছাড়া লিথুয়ানিয়ায় তাইওয়ানের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি অফিস খোলার অনুমতি দেওয়ার জন্য ইউরোপের এই দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীন। এ নিয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অসন্তুষ্ট চীনের ওপর।
চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ২০২২ সালে চীন ছিল ইউরোপের রফতানির তৃতীয় বৃহত্তম গন্তব্য। চীন বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। এর বছর চীনের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৫ বিলিয়ন ইউরো। ফলে দু’পক্ষই পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ ও চীনের রাশিয়ার পক্ষে যাওয়া চীন-ইউরোপ সম্পর্কে ফেলছে বিরূপ প্রভাব।
অর্থনৈতিক, সামরিক ও আধুনিক প্রযুক্তির শক্তিধর দেশ হিসেবে চীনের উত্থান আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের মৈত্রীর সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে চীনের অবস্থান গ্রহণ ইউরোপকে ক্ষুব্ধ করেছে। ইউরোপ নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে চাইছে। কিন্তু চীন সেখানে রাশিয়াকে সমর্থন করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর সাম্প্রতিক মস্কো সফরের সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন চীন-রাশিয়া সম্পর্কে ‘নো লিমিট’ বা ‘সীমাহীন’ অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে। এর প্রকৃত অর্থ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রেসিডেন্ট শি’র বক্তব্যে। তিনি পুতিনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘বর্তমানে বিশে^ এমন সব পরিবর্তন ঘটছে, যা আমরা গত ১০০ বছরেও দেখিনি। এবং এই পরিবর্তনে আমরা একত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছি।’ এর মাধ্যমে তিনি বিশে^ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান বিশ^ ব্যবস্থায় পশ্চিমাদের আধিপত্য খর্ব করার ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়ার যৌথ নেতৃত্বের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বেইজিং সফরে যান। তাদের সফরের লক্ষ্য ছিল চীনের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখা। পরে বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উরসুলা ফন ডার লিয়েন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করার বিরুদ্ধে চীনকে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, এটি সত্যিই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে। যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং ইইউ আশা করে, চীন তার ভূমিকা পালন করবে যা ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সহায়ক হবে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর রাশিয়ার সাথে চীনের সম্পর্কে এই ‘নো লিমিট’ কথাটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট শি’র এ কথাটির ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘নো লিমিট’ কথাটি নিতান্তই আলঙ্কারিক।’ ফু’র এই বক্তব্যের বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল ফন ডের লেইনের মন্তব্যের জবাব দেওয়া।
চীনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের ওপর বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমানোর ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধভাবে অভিন্ন কোনো অবস্থান নিতে পারেছে না। বর্তমানে চীনের বিভিন্ন ধরনের পণ্যের বৃহত্তম বাজারে পরিণত হয়েছে ইউরোপ। চীনের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে এসব পণ্য পাওয়ার কারণে দেশটির ওপর বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমানো সম্ভব হচ্ছে না ইউরোপের পক্ষে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গাটছড়া বেঁধে চীনের সাথে সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ারও বিরোধী ইউরোপের কিছু দেশ।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক বিষয়ে মতবিরোধ আছে। ইউরোপের অন্য যেকোনো নেতার তুলনায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সেটা খোলাখুলিই প্রকাশ করেন। গত বছরের শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ইউরোপে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মার্কিন নীতির সমালোচনা করেছিলেন। ফ্রান্স মনে করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ইউক্রেন নীতির কারণে ইউরোপ নানাভাবে চাপে পড়েছে।
ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ব্রুনো ল্য মায়েরও একই ধরনের কথা বলেছেন।
ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যখন বাড়ছে, সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের দেশগুলোকে চীনের অর্থনীতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করার পরামর্শ দিচ্ছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে বলেন, অন্যান্য শক্তি যখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করছে, তখন আমাদের সেটা করার অধিকার থাকবে না কেন?
ইউরোপের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির ফলে তারা তাদের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন কিছুটা হারিয়েছে কি না। ইউরোপের বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা গিয়েছে , ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত প্রশ্নে এই জোট অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এর ফলে চীনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু এরপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের মতপার্থক্য সরিয়ে রেখে ইউক্রেনকে সহায়তা করার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে দুই ধারার একটি কৌশল ও অবস্থান গ্রহণ করেছে। এই সম্পর্ককে একদিকে সহযোগিতা ও অন্যদিকে প্রতিযোগিতা- এই দুই অংশে ভাগ করেছে। এই দ্বৈত নীতিই প্রমাণ করে , ইইউ চীনের সাথে কীভাবে তাদের সম্পর্কের বিন্যাস করতে চায়। পশ্চিমা এই জোট চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী নীতির সাথেও সংগতি রেখে বেইজিংবিরোধী অবস্থান ধরে রাখতে চায়।
চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ তাদের চীনবিরোধী এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন সম্প্রতি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধে চীন যেভাবে ভূমিকা রাখবে তার নিরিখেই বেইজিং-এর সাথে ইউরোপের সম্পর্ক সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
চীনের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে কোনো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ না করা। কিন্তু চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের পক্ষে প্রকাশ্যেই চীনের অবস্থান নেওয়া বেইজিংয়ের সেই নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন রাশিয়াকে সরাসরি সামরিক সহায়তা না দিলেও সামরিক গোয়েন্দা তথ্য প্রদান ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে সহায়তা করছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর চীনা প্রেসিডেন্টের মস্কো সফর পুতিনের প্রতি বেইজিংয়ের দৃঢ় সমর্থনেরই ইঙ্গিত বহন করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মনে করে, চীনের এই সমর্থন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ইউক্রেনে হামলা জোরদারে উৎসাহিত করেছে। সে কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট শি’র মস্কো সফরের কঠোর ভাষা নিন্দা করে তার উত্থাপিত ১২ দফা শান্তি প্রস্তাবকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেনি।
জাপানের হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত বিশে^র বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির জোট জি-৭ এর বৈঠকেও বাণিজ্য, প্রযুক্তি, ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি ও সরবরাহ চেইনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন জোটের নেতারা। চীনের অবকাঠামোগত আন্তঃমহাদেশীয় বিনিয়োগ প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর বিরুদ্ধে এই বৈঠকে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ইনভেস্টমেন্ট নামের এই প্রকল্পে অবকাঠামো খাতে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমাদের এই উদ্যোগ চীনের বিআরআই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে কি না তা নিয়ে এখনই চূড়ান্ত কোনো কথা বলার সময় আসেনি। এক্ষেত্রে চীনের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।