ফিলিস্তিনের বড় বন্ধু হিসেবে সামনে আসছে চীন

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ২১ জুন ২০২৩, ১৪:১৯

অধিকৃত ফিলিস্তিন নিয়ে ২৪ মে জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত জেং শুয়াং যে মন্তব্য করেছেন, সেটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দেশটি যে অবস্থান নিয়েছে, তা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ঐতিহাসিকভাবেই আইনত ন্যায্য অবস্থানে ছিল চীন। তবে, ইসরাইলের সাথে বাণিজ্য স্বার্থের কারণে, সম্প্রতি তারা দুই দিকে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু যখনই চীন শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে, ইসরাইল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরাইল যে মার্কিন প্রভাব থেকে বের হতে পারবে না, সেই উপলব্ধিও তাদের হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেই বিবেচনা থেকেই চীন তার ন্যায্য অবস্থান বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার যুদ্ধক্ষেত্র মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, চীনের যে রাজনৈতিক বয়ান, সেখানে আইনের প্রতি যথেষ্ট সৎ থাকার চেষ্টা রয়েছে। তাদের অবস্থান থেকে এটাও বোঝা গেছে , বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কেও তারা ভালোভাবেই অবগত।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনি প্রশ্নসহ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উপর যখন ব্রিফিং হয়, সেখানে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার ক্ষেত্রে চীনা রাষ্ট্রদূত জেং কোন ধরণের ভনিতার আশ্রয় নেননি। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার একটা 'সামগ্রিক ও ন্যায্য সমাধান' দরকার। যার কোন বিকল্প নেই। এমন একটা সমাধান হতে হবে, যার মধ্য দিয়ে জেরুসালেমে ইসরাইলের 'উসকানিমূলক' আচরণের অবসান ঘটবে, এবং 'মুসলিম নামাজিদের' অধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করা হবে। একই সাথে এই শহরের পবিত্র স্থানগুলোর অভিভাবকত্ব তিনি জর্ডানের হাতে তুলে দেয়ার কথাও বলেন।

ফিলিস্তিনে সাম্প্রতিককালের সহিংসতা, এবং গাজায় ৯ মে ইসরাইলের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে জেং বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে যে অবস্থান তুলে ধরেন, তা তেল আবিব ও ওয়াশিংটন উভয়ের জন্যই ছিল আপত্তিকর। কোন রাখঢাক না রেখে তিনি অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বসতি সম্প্রসারণ, এবং ইসরাইলের 'একতরফা কর্মকান্ডের' জোর নিন্দা করেন। শুধু তাই নয়, অবৈধ কর্মকান্ড এখনই বন্ধ করার জন্য তিনি তেল আবিবের প্রতি জোর দাবি জানান। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদেরকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।

এই বক্তৃতার মধ্য দিে জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত জেং শুয়াং ফিলিস্তিনে একটা ন্যায্য সমাধানের ব্যাপারে চীনের রাজনৈতিক ভিশন তুলে ধরেছেন। যার ভিত্তিমূলে রয়েছে ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও তেল আবিবের সম্প্রসারণবাদী নীতির অবসান, এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো।

এটা সত্য যে, ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের ব্যপারে চীনের অবস্থান ঐতিহাসিকভাবে সব সময় আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষেই ছিল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সেখানে উভয় দিকেই কিছুটা ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছিল, যাতে ইসরাইলের সাথে তাদের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত না হয়। বিশেষ করে অত্যাধুনিক মাইক্রোচিপস প্রযুক্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য রয়েছে। তবে, চীন-ইসরাইল সম্পর্কের পেছনে শুধু যে বাণিজ্য আছে, তা নয়। সেখানে অন্য বিষয়ও রয়েছে।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই বেইজিংয়ের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা প্রতীক । এই প্রকল্পের সাথে প্রায় দেড়শ দেশ জড়িত। এর লক্ষ্য হলো স্থল ও সাগর পথ দিয়ে এশিয়ার সাথে ইউরোপ ও আফ্রিকার সংযোগ স্থাপন। যেহেতু ইসরাইলের অবস্থান ভূমধ্যসাগরের তীরে, সে কারণে চীনের কাছে ইসরাইলের কৌশলগত গুরুত্ব দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বহু বছর ধরেই চীন ইসরাইলের বন্দরগুলো ব্যবহারের সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করেছে।

স্বাভাবিকভাবেই বেইজিংয়ের এই ধরণের উচ্চাকাঙ্খা ওয়াশিংটনের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছে। কারণ মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলো মাঝে মাঝেই ইসরাইলের হাইফা বন্দর ব্যবহার করে।

বেইজিংয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর ব্যপারে ওয়াশিংটন বার বার তেল আবিবকে সতর্ক করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ২০১৯ সালের মার্চে ইসরাইলকে এমনকি হুমকিও দিয়েছিলেন। পরে তেল আবিব চীনের সাথে সহযোগিতার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে তাদের গোয়েন্দা তথ্য ও নিরাপত্তা সুবিধা বিনিময় কমিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল।

চীনের বৈশ্বিক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে ইসরাইলও একটা ভারসাম্যের অবস্থান খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা করা যায়। আবার, চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে তাদের থেকে আর্থিক ও কৌশলগত সুবিধা নেয়া যায়।

ইসরাইলের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা দেখে চীন উৎসাহিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যে অর্থনৈতিক শক্তি রয়েছে, সেটাকে তারা এখন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিনিয়োগ হিসেবেও দেখতে শুরু করেছে। ২০১৭ সালে চীন একটা শান্তি পরিকল্পনার ধারণা দিয়েছিল। এর অধীনে শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল চীন।

ফিলিস্তিনি নেতারা চীনকে তখন স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু ইসরাইল প্রত্যাখ্যান করেছিল। চীন সরকারের জন্য সেটা ছিল বিব্রতকর। কারণ, ভূরাজনীতির সব ক্ষেত্রেই আসলে তখন তাদের প্রভাব ও স্বীকৃতির জায়গাটা বাড়ছিল। ভারসাম্যের ভূরাজনীতি তখন যতটুকু বা সম্ভব ছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তা হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে। নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এখন কোন পর্যায়ে গেছে, তার ধারণা পাওয়া যাবে ন্যাটোতে নিযুক্ত ইটালির সাবেক কূটনীতিক স্টেফানো স্টেফানিনির লেখা থেকে। লা স্টাম্পা-তে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষার যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন আর 'নিরাপত্তা জাল' বলে কিছু নেই।

সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ৬ এপ্রিল ঐতিহাসিক চুক্তি করার ক্ষেত্রে সফল মধ্যস্থতা করেছে চীন। এর পরপরই ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে মধ্যস্থতার ধারণাটি আবার তারা সামনে আনে। চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গাং শান্তি চুক্তি আবার শুরুর ব্যাপারে দুই পক্ষের সাথেই কথা বলেছেন বলে শোনা গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের মধ্যস্থতা মেনে নিলেও ইসরাইল আবারও বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।

ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যপারেও চীন কেন হতাশ, তার একটা ধারণা এখান থেকে পাওয়া যাবে। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত হিসেবে জেং ভালো করেই জানেন, ইসরাইলের ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব আছে। গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং-এর কথাতেও বিষয়টি উঠে এসেছিল। ১৪ মে হুয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এটা বোঝা উচিত , ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জীবনও সমান মূল্যবান।

ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি নিয়ে চীন যে ভাষায় কথা বলেছে, সেই কথার অন্তর্নিহীত বয়ান বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, অব্যাহত সঙ্ঘাতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা সরাসরি যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছে চীন। একই কারণে, সেখানে ন্যায্য কোন সমাধানও সম্ভব হচ্ছে না।

চীনা রাষ্ট্রদূত জেং অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে মন্তব্য করেছেন, সেখানেও একই মনোভাবের প্রতিফলন রয়েছে। সেখানে তিনি 'অল্প অল্প করে সঙ্কট ব্যবস্থাপনা' কৌশলের কড়া সমালোচনা করেছেন। এখানে কার্যত তিনি ওই অঞ্চলে মার্কিন কূটনীতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বিকল্প হিসেবে চীনের পক্ষ থেকে 'সামগ্রিক ও ন্যায্য সমাধানের' প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীন যে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে আরব দেশগুলোর মনোভাবের প্রতিফলন আছে। আরব বিশ্বের রাজনৈতিক নীতির মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যুটি যত কেন্দ্রে থাকবে, চীন তাদের পররাষ্ট্র নীতির এজেন্ডাতে এই ইস্যুকে তত গুরুত্ব দেবে।

জেদ্দাতে সম্প্রতি যে আরব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে ফিলিস্তিনকে প্রধান আরব ইস্যু হিসেবে অগ্রাধিকার দিয়েছে আরব সরকারগুলো। চীনের মতো মিত্র, যার অর্থনৈতিক স্বার্থ এই অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে, তারা তাৎক্ষণিকভাবে আরবদের এই অগ্রাধিকারের ইঙ্গিতটি বুঝতে পেরেছে। চীনের এই সব তৎপরতার অর্থ এটা নয় যে, তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এর অর্থ হলো ফিলিস্তিনের ব্যপারে চীন তাদের নৈতিক অবস্থানে অটল রয়েছে। আর এই অবস্থাটা বহু দশক ধরে চলে আসছে।

চীন আর ইসরাইলের সম্পর্ক শিগগিরই লিটমাস পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। এতে প্রধান ফ্যাক্টর হবে মার্কিন চাপ ও আল্টিমেটামের মোকাবেলা করা। ইসরাইলের কাছে যেহেতু ওয়াশিংটনের গুরুত্ব অপরিসীম, এবং চীনের কাছে আরব-মুসলিম বিশ্বের গুরুত্ব বেশি, সে কারণে বোঝাই যায় ভবিষ্যতে কি হতে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিন নিয়ে চীন যে রাজনৈতিক বয়ান তুলে ধরেছে, আন্তর্জাতিক ও মানবিক আইনের সীমার মধ্যে থেকে তারা যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে এটা বেশ পরিস্কার , চীন তাদের পছন্দ এরই মধ্যে বেছে নিয়েছে, এবং বেশ সুস্পষ্টভাবেই তারা সেটা করেছে। আগামি দিনে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলোকে সাথে চীন আরো বেশি সক্রিয় হবে। এর আলামত এখন খুবই দৃশ্যমান। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আববাস বেইজিং সফর করছেন। ইরানের সাথে সৌদি আরবের সর্ম্পকে মধ্যস্থতা করার পর মধ্যপ্রাচ্যে নীতিতে চীন আরো বেশি সক্রিয় হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।