যুক্তরাষ্ট্র একসময় সৌদি আরবকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের চোখ আর কানের মতো মনে করত। দুই দেশের সম্পর্কে সবসময়ই সামান্য টানাপড়েন থাকলেও রিয়াদ কখনও ওয়াশিংটনের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়নি। কিন্তু সেই সময় পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সৌদি আরবের বর্তমান নেতারা তাদের স্বাধীনতাকে এখন অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। নিজেদের স্বার্থে যেকোনো পক্ষের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে তারা এখন আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে অসন্তুষ্ট হলো কিনা, সেটা তাদের বিবেচ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র এখন সৌদি আরবের কাছে কোনো কিছু চাইলে প্রতিদানে তাদেরকেও রিয়াদের শর্ত মানতে হবে। ইসরাইলের সাথে রিয়াদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে যে প্রচেষ্টা শুরু করেছে ওয়াশিংটন, সেখানেও এই বাস্তবতাই দেখা গেছে।
বছরপাঁচেক আগে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস কঠিন সময় পার করেছেন। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যা প্রক্রিয়ায় পেছনে প্রতারণা যেমন ছিল, তেমনি ছিল বর্বরতা। হত্যাকাণ্ডের পর তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরব পুরো পশ্চিমা বিশ্বেই এক ধরনের অস্পৃশ্য হয়ে ওঠে। হত্যার বিষয়টি আড়াল করার জন্য রিয়াদের কোনো চেষ্টাই খুব একটা কাজ দেয়নি। রিয়াদ শুরুতে বলার চেষ্টা করেছিল যে, ইস্তান্বুল কনস্যুলেটের ভিতরে অপরাধমূলক কিছুই ঘটেনি। কিন্তু তুরস্কের পুলিশ যখন হত্যাকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট অডিও প্রকাশ করে, তখন রিয়াদের অবস্থান পুরোটাই ধসে পড়ে।
ওই ঘটনার পাঁচ বছর পরে এসে এখন দেখা যাচ্ছে, এমবিএস তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সঙ্কটটি বেশ অক্ষতভাবেই পার করে এসেছেন। বড় জোর তার মর্যাদায় দু- একটা সামান্য আঁচড় লেগেছে মাত্র। এটা অর্জনের জন্য তিনি তার দেশকে কিছু মানুষের কাছে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন। আর অন্য কিছু দেশের কাছে দেশকে উপকারী হিসেবে হাজির করেছেন।
খুব বেশি দিন হয়নি যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন , মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সৌদি আরবকে তিনি বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন। এখন তার আচরণে মনে হবে, এ ধরনের কথা যে তিনি এক সময় বলেছিলেন, সেটা তার মনেই নেই। যুক্তরাষ্ট্র- সৌদি আরবের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে গেছে, এবং এভাবেই বেশ কিছুকাল ধরে চলছে। একেবারে অতি সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এমবিএসের সাথে বৈঠক করার জন্য সৌদি আরব সফরও করেছেন।
কঠোর সমালোচকদেরকেও এই কৃতিত্বটুকু এমবিএসকে দিতে হবে , হাতের কার্ডগুলো তিনি দুর্দান্তভাবে খেলেছেন। এই যাদুকরি ভেলকি দেখানোর জন্য এমবিএসকে তার নিজের ভুল থেকে শিখতে হয়েছে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র সম্পর্কের বলয়কে তিনি প্রসারিত করেছেন। সেই সাথে আঞ্চলিক যে সব প্রতিপক্ষ নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তাদের সাথেও দূরত্ব কমিয়ে এনেছেন তিনি।
ইরানের সাথে বোঝাপড়ার পথে হেঁটেছে রিয়াদ। এরই পরিণতিতে ইরান আর সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা সাত বছর বিরতির পর দুই দেশের মধ্যে আবার স্বাভাবিক কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তেহরান এরই মধ্যে রিয়াদে তাদের দূতাবাস পুনরায় চালুর ঘোষণা দিয়েছে। এই অর্জনকে সৌদি আরবের সকল কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে বলা যায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সাথে কার্যকরভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি সম্ভবত আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের নীতি হলো সিরিয়া সরকার কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় না আসলে দামেস্ককে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হবে। রিয়াদ বাশার আল- আসাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে কার্যত ওয়াশিংটনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
সিরিয়া ইস্যুতে সৌদিরা ওয়াশিংটনকে কোনো পাত্তাই দেয়নি, এবং বাইডেন প্রশাসন বা মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের যে উদ্বেগই থাক, তাকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা নিজের পথে হেঁটেছে। সৌদি আরবের যুক্তি হলো, আসাদকে বিচ্ছিন্ন রাখলে সিরিয়াতে ইরানের অবস্থান আরও মজবুত হচ্ছে, এবং সৌদি বাজারে অবৈধ মাদক প্রবেশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই যুক্তি পছন্দ হয়নি। কিন্তু তাতে সৌদি আরবের খুব একটা যায় আসে না।
এমবিএস সৌদি আরবকে কূটনৈতিক হেভিওয়েট করে তুলছে। এর অংশ হিসেবে আঞ্চলিক অতিরিক্ত কিছু কূটনীতিতে জড়াচ্ছে রিয়াদ। গত মে মাসে, সৌদিরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকিকে আরব লীগ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যুদ্ধের ব্যাপারে জেলেন্সকির দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছিল তারা। এর তিন দিন পরে, রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদিমির কোলোকোলশেভকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কোলোকোলশেভের উপর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সব নিষেধাজ্ঞাকে একেবারেই বিবেচনায় নেয়নি রিয়াদ।
গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব কিয়েভ আর মস্কোর মধ্যে বন্দি বিনিময়ে মধ্যস্থতা করেছিল। ডিসেম্বরে ডাব্লিউএনবিএ তারকা ব্রিটনি গ্রিনারকে রাশিয়ার কারাগার থেকে বের করে আনার পেছনে সুস্পষ্টভাবে সৌদি আরবের হাত ছিল। বন্দি বিনিময় আর শান্তি আলোচনা যদিও এক বিষয় নয়, তবু সৌদি আরব তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে, এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে। এর মাধ্যমে তারা সব পক্ষের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রকে দেখাচ্ছে, আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে তাদের গুরুত্ব কম নয়।
যুক্তরাষ্ট্র এক সময় সৌদি আরবকে এই অঞ্চলে তাদের চোখ আর কানের মতো মনে করতো। সেই দিন চলে গেছে। সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে সবসময়ই কিছু ঝামেলা ছিল। তবে, সৌদি কর্মকর্তাদের মাথায় একটা বিষয় সবসময় ছিল, অংশীদার হিসেবে ওয়াশিংটনের জায়গা কেউ নিতে পারবে না।
বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের পূর্বসুরী আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সমস্যা ছিল। বিশেষ করে ইসরাইল-ফিলিন্তিন দ্বন্দ্ব ও ইরান ইস্যুতে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ফাঁস হওয়া মার্কিন নথিপত্রে দেখা গেছে , আব্দুল্লাহ ২০০৮ সালে ইরানের পারমানবিক প্রকল্পে হামলা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপও দিয়েছিলেন। এরপরও দুই পক্ষের মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল, বিদ্যমান সমস্যাগুলো যা কখনও ছাপিয়ে যায়নি।
কিন্তু সৌদি আরবের আজকের নেতৃত্বের ব্যাপারে এ কথা বলার উপায় নেই। তারা নিজেদের স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। নিজের দরকার মতো বিভিন্ন পক্ষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। এবং তারা মনে করে না যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা আছে। আগের সৌদি রাজ পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে উদাসীন থাকতো। কিন্তু এমবিএস উদাসীনতাকে দুর্বলতা মনে করেন। এখন কাউকে আলাদা করে সুবিধা দেয়ার কোনো নীতি নেই। ওয়াশিংটন যদি সৌদি আরবের কাছে কোনো সহায়তা চায়, তাহলে সৌদি আরব সেটাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাল্টা প্রতিদান পাওয়ার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে।
সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য বাইডেন প্রশাসনের নানা ধরনের প্রচেষ্টা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এ ধরনের সম্ভাব্য চুক্তিকে শুধু বড় ধরনের কূটনীতিক অর্জন হিসেবেই দেখছে না, বাইডেন নিজে এটাকে পররাষ্ট্র নীতির বড় অর্জন মনে করছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে এটাকে তিনি প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কথা ভাবছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজন জেইক সালিভানের ভাষায়, ‘দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক করার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের অংশ। আমরা এটা স্পষ্ট করে বলেছি।’ আগামী ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে ইসরাইল ও সৌদি আরবের মধ্যে একটা চুক্তি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে হোয়াইট হাউজ।
সৌদি- ইসরাইল সর্ম্পক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে এমবিএস নিজেও আগ্রহ জানিয়েছেন। সৌদি আরব এ ব্যাপারে প্রাথমিক পদক্ষেপও নিয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে এবং ২০২২ সালের জুলাই মাসে এমবিএসের সাথে সম্ভবত গোপন বৈঠক করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। যদিও ২০২০ সালের বৈঠকের বিষয়টি সৌদি আরব স্বীকার করে না।
বৈঠকের পরে, সৌদির আকাশ দিয়ে ইসরাইলের বেসামরিক বিমান চলাচলের অনুমতিও দিয়েছে রিয়াদ। সৌদিরা অবশ্য এটা জানে , ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ তাদের চেয়ে আমেরিকানদের অনেক বেশি। সে কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতার পূর্বশর্ত হিসেবে তারা কতগুলো দাবি সামনে রেখেছে। এর একটি হলো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, অন্যটি হলো সৌদি আরবের নিজস্ব ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি। ওয়াশিংটনের কাছে তারা বার্তা দিয়ে দিয়েছে, কিছু পেতে হলে আগে মূল্য পরিশোধ কর।
ওয়াশিংটনের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সবই বেশ উদ্বেগের বিষয়। সেটাই হয়তো সত্যি। কিন্তু এটা এখন নতুন বাস্তবতা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।