ভোটে নির্বাচিত হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কেউ গণতান্ত্রিক নেতা মনে করেন না। তিনি ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু বানিয়েছেন। ভিন্নমত দমন করছেন কঠোরভাবে। দেশটির মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ওপর নিপীড়ন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সেই মোদি যখন যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে গণতন্ত্র, সংখ্যালঘুর অধিকার আর আইনের শাসনের জয়গান করেন, তখন তা ভূতের মুখে রামনাম মনে হতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চাপে পড়ে মোদি ভালো মানুষ সাজার ভান করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির যে বৈঠক হয়েছে, তার মুখ্য বিষয় ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর। বৈঠক শেষে মোদি ও বাইডেনের যৌথ সংবাদ সম্মেলনেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
বৈঠক শেষে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন নীতির মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় মার্কিন-ভারত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করা হয়। বিবৃতির শুরুতেই বলা হয়, ‘একত্রে আমরা একটি আরও শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় মার্কিন-ভারত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলব; যা মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের নীতির ওপর ভিত্তি করে উজ্জ্বল এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য আমাদের জনগণের আকাক্সক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
হিন্দুত্ববাদী মোদি গণতন্ত্রের লেবাস ব্যবহার করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চান। মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন তার সত্যিকার আদর্শ নয়। উগ্র হিন্দুত্ববাদে এসবের স্থান নেই। ফলে যৌথ বিবৃতিতে কার্যত পরাজয় ঘটেছে মোদির আদর্শের।
লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ মিয়ানমার, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। কোনো কোনো মহল বলেছিল, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে মোদি কথা বলবেন। তবে বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো মোদিকে গণতন্ত্রের জয়ধ্বনি করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে মোদি কার্যত বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন করেছেন।
প্রায় ৬ হাজার ৫০০ শব্দের ৫৮ দফার যৌথ বিবৃতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। দুই ঘণ্টা একান্তে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন বলেন, বৈঠকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মোদি বলেন, আমাদের ডিএনএ-তে গণতন্ত্র রয়েছে। আমাদের আত্মায় গণতন্ত্র রয়েছে। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনজুড়েই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়েই নানা প্রশ্নের উত্তর দেন দুই রাষ্ট্রপ্রধান। মোদি বলেন, মানবিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না।
বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মোদি প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি তার ৯ বছরের শাসনামলে কখনও এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেননি। সিএনএন জানিয়েছে, যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভারতের কর্মকর্তাদের জোর আপত্তি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ভারত শেষ পর্যন্ত রাজি হয়।
সংবাদ সম্মেলন নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে লেখা হয়েছে, সফরের জন্য বিমানে ওঠার আগে পর্যন্ত মোদি সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তাকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে ভারতের গণমাধ্যম জানায়, এই সফরেও সাংবাদিক সম্মেলন হোক, এটা একেবারেই চায়নি ভারতের সাউথ ব্লক। তবে মোদিকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করানোর জন্য নাছোড়বান্দা ছিল বাইডেন প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হয় মোদিকে। এ সময় তাঁর সরকারের সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগও সামলাতে হয়। কূটনৈতিক সূত্রের মতে, এই অভিযোগ আসবে জেনেই সাংবাদিক সম্মেলনে রাজি ছিল না সাউথ ব্লক।
সংবাদ সম্মেলনে মোদিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকি প্রশ্ন করেছিলেন, মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার উন্নত করতে এবং ভারতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কী কী পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত মোদি সরকার? জবাবে মোদি বলেন, আমরা গণতন্ত্রে বাস করি। ভারতে সরকার চলে সংবিধানের ভিত্তিতে। এখানে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। আপনি যখন গণতন্ত্র বলেন এবং গণতন্ত্রকে মেনে নেন, তখন বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। ভারত সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে বিশ্বাস করে। ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য নেই।
প্রধানমন্ত্রী মোদির উত্তরের পরে কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরার মন্তব্য, টেলিপ্রম্পটার থাকা সত্ত্বেও এমন নিস্প্রভ, মধ্যমেধার উত্তর! আন্তর্জাতিক মঞ্চে এমন মধ্যমেধা মানা যায় না। দেশেও কেন প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন এড়িয়ে যান বোঝা গেল। এর আগে মোদির হোয়াইট হাউসে প্রবেশের সময় সেখানে বিক্ষোভ করেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। তারা ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান।
সফরকালেই মোদির সঙ্গে মানবাধিকার ইস্যুতে আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ৭৫ জন আইন প্রণেতা। চিঠিতে তারা ভারতের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লঙ্ঘন, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে রাখা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে সহিংস আচরণের বিষয়ে উদ্বেগ জানান।
আমেরিকার ডেমোক্র্যাট পার্টির দুই কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর এবং রাশিদা তালেব মোদির যৌথ অধিবেশনের বক্তৃতা বয়কট করেন। দুই মুসলিম নেত্রীরই বক্তব্য, মোদির সরকার ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন করে থাকে। মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের আক্রমণ করে। রাশিদা বলেছেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র-বিরোধিতার দীর্ঘ ইতিহাস যাঁর রয়েছে, আমাদের দেশের রাজধানীতে সেই মোদিকে একটা মঞ্চ দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার।’
মোদির উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। তিনি বলেছেন, কূটনৈতিক আলোচনায় ভারতে মুসলমান সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরা প্রয়োজন। আমার যদি মোদির সঙ্গে কথা হত, তাকে আমার এটাই বলার থাকত যে, আজ যদি আপনি সংখ্যালঘুদের না দেখেন, তা হলে দেশটা টুকরো হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তা ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী।’ ওবামা বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উচিত মোদির কাছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি উত্থাপন করা।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ওবামাকেই প্রজাতন্ত্র দিবসে দাওয়াত বিরল সম্মান দিয়েছিলেন মোদি। প্রথমবারের মত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছিল ভারত। মোদির শাসন নিয়ে সেই ওবামার বিশ্লেষণ ছিল গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের বাজার এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতকে পাশে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই সামরিক, বেসামরিক, গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে সফরে চুক্তি হয়েছে। তবে মোদির শাসনকালে ভারতে যেভাবে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে, বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন বেড়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে আফগানিস্তানেরও বেশে নীচে চলে গেছে, সেইসব প্রশ্ন বেসরকারি মহল এবং রাজনীতিবিদদের তুলতে বাধা দেয়নি বাইডেন প্রশাসন।
পশ্চিমবঙ্গের বহুল প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকায় মোদির দ্বিচারিতার বিষয়টিকে দারুণভাবে তুলে ধরেছে। ‘মোদিকে প্রশ্নবাণ, আশ্রয় গণতন্ত্রেই’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পত্রিকাটি বলেছ, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হননি কোনও দিন। আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে কিন্তু প্রশ্ন নিলেন এবং গণতন্ত্রের জয়গানই গাইলেন নরেন্দ্র মোদি। বললেন, ভারতের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে গণতন্ত্র। ভারত বাঁচে গণতন্ত্রে। পূর্বসূরিরা গণতন্ত্রের বয়ানেই লিখেছিলেন সংবিধান। মোদি সরকারও গণতন্ত্রেরই উপাসক। জাতি, ধর্মের কোনও বৈষম্য সেখানে নেই।
আনন্দবাজার লিখেছে, মোদির সফরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট সরকারের উপরে চাপ ছিল মনে করছে কূটনৈতিক মহল। ভারতে মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘুর অধিকারের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে রিপোর্ট জমা দিয়েছে আমেরিকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা।
বিমানবন্দরে মোদিকে স্বাগত জানাতে ছিলেন না কোনও শীর্ষ নেতা। মোদির সফর নিয়ে ঢাকঢোল বাজানোর পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের উপরে দায়ও তৈরি হয়েছিল, নিজের দেশে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সামনে মোদিকে দাঁড় করানোর। বৈঠক শুরুর আগেই মোদিকে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিয়েছিলেন বাইডেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে বাইডেনের কাছেও জানতে চাওয়া হয়, মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় বৈষম্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মতো অভিযোগ তার দলের সদস্যরাই করছেন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। এনিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কি কোনও কথা বলতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে? বাইডেন জবাবে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার গণতন্ত্র নিয়ে ভাল আলোচনা হয়েছে। আমাদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়ে থাকে। আমরা দুই দেশই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।