ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাশিয়ার সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ওয়াগনার বাহিনীর ওপর হামলা করেছে- এমন অভিযোগ করে তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন। প্রিগোঝিনের ভাষায় তিনি ন্যায়বিচার চান। আর সেটাই শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত বেলারুশের প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে মধ্যস্থতার পর অভ্যুত্থান তুলে নেন প্রিগোঝিন। এই মধ্যস্থতার আগে ওয়াগনার গ্রুপ রোস্তোভ-অন-ডন এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলোর দখল নিয়েছিল বলে দাবি করেছিল। রোস্তোভ-অন-ডন রাশিয়ার দক্ষিণের সামরিক জেলার সদর দপ্তর।
ওয়াগনার গ্রুপ আর রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ নতুন কিছু নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দুই পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করেছে। একে অন্যের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণও দেখিয়েছে তারা।
ওয়াগনার গ্রুপ যে সশস্ত্র বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিল তার কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ কৌশল নিয়ে মতবিরোধ। রাশিয়ান সেনাবাহিনী আর ওয়াগনার গ্রুপ উভয়েই ইউক্রেনে যুদ্ধ করেছে। এছাড়া কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েও ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ ছিল বলে ধারণা করা হয়।
রাশিয়ার সেনাবাহিনী আর ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ঠিক পরপরই তা নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধের আগেও ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় স্বার্থে কাজ করেছে। যদিও সেটা হয়েছে অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
যেসব জায়গায় রাশিয়ার স্বার্থ ছিল, কিন্তু রাষ্ট্র সরাসরি জড়াতে চায়নি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ওয়াগনার গ্রুপ যথেষ্ট সাহায্য করেছে। এর অন্যতম উদাহরণ হলো সিরিয়া ও সুদান। এই দুই দেশেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে ওয়াগনার গ্রুপ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
২০১৪ সালে মস্কো যখন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করে, তখনও ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়াকে সাহায্য করেছে। ২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চলে রাশিয়াপন্থী গোষ্ঠির সমর্থনে মাঠে ছিল ওয়াগনার গ্রুপ। রাশিয়ার সেনাবাহিনী সরাসরি সেখানে না থাকায় রাশিয়া ওই ঘটনায় তার রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়টি অস্বীকার করে। অন্যভাবে বললে, ওয়াগনার গ্রুপ আর রাশিয়ার সামরিক বাহিনী নিজেদের ক্ষেত্র ভাগ করে নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করেছে, এবং একে অন্যকে সাহায্য করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই পক্ষের সম্পর্কের সমীকরণ উল্টে দিয়েছে। রাশিয়ান সেনাবাহিনী আশা করেছিল, ইউক্রেনে তারা দ্রুত সামরিক জয়লাভ করবে। কিন্তু যে ভাবে তারা আশা করেছিল, সেভাবে সবকিছু ঘটেনি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সামরিক বাহিনীর অভিযানকে সরাসরি সহায়তার জন্য এখানে ওয়াগনার গ্রুপকে নিয়ে আসা হয়।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়াগনার গ্রুপকে মোতায়েনের মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযানের ক্ষেত্রে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছে। ২০২২ সালে, রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে বাধ্য হয়ে অনেক আধা-প্রশিক্ষিত সেনাদেরকে ফ্রন্টলাইনে পাঠাতে হয়। অন্যদিকে, ওয়াগনার গ্রুপের যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের সবাই ছিল উচ্চ প্রশিক্ষিত। রাশিয়া শুরুর দিকে যে সব সাফল্য পেয়েছে, তার অনেক ক্ষেত্রেই ওয়াগনার গ্রুপের সেনাদের ভূমিকা ছিল। এর মধ্যে অন্যতম হলো সাইভিয়েরোডোনেটস্কের যুদ্ধ।
এই সব অভিযানের জন্য মূল্যও দিতে হয়েছে। হতাহত হয়েছে ওয়াগনার গ্রুপেরও বহু সেনা। সে কারণে তারা যে ট্র্যাডিশনাল কৌশলে কাজ করে, সেই কৌশল শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। এক পর্যায়ে ওয়াগনার গ্রুপকেও গণহারে সেনা নিয়োগ দিতে হয়। রাশিয়ার বিভিন্ন কারাগার থেকেও তারা সদস্য বাছাই করেছে বলে জানা যায়। হতাহত সেনাদের শূন্যস্থান পূরণে এ ছাড়া তাদের উপায় ছিল না।
এই নতুন সদস্য নিয়োগের পর ওয়াগনার গ্রুপ আর রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অবস্থা একই পর্যায়ে নেমে আসে। আগে দুটো সংস্থার আলাদা প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই বাহিনীই কনভেনশনাল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
রাশিয়ান সেনাবাহিনী আর ওয়াগনার গ্রুপের প্রভাবের জায়গা ইউক্রেন যুদ্ধ এক হয়ে গেছে। দুই বাহিনীকেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। অন্তত ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়াগনার গ্রুপকে আলাদা কোন মর্যাদার চোখে দেখেনি রাশিয়া। রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থারও একটা ভূমিকা আছে এই অবস্থার পেছনে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন।
অধীনস্থদের মধ্যে বিবাদ হলে একমাত্র ভøাদিমির পুতিনই সেখানে মধ্যস্থতা করতে পারেন। এই সিস্টেমের কারণে পুতিনের অধীনস্থরা তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোন ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তুলতে পারে না। একই সাথে এই সিস্টেমের কারণে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে তার গুরুত্ব অনেক বেশি।
শান্তিপূর্ণ সময়ে রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকটি খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের প্রভাব ও ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এই ব্যবস্থা যথেষ্ট সহায়ক। তবে, সঙ্ঘাত বা সরাসরি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থা সমস্যা তৈরি করছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ ভিন্নধর্মী কার্যকারিতার কলকাঠি সব প্রেসিডেন্টের কাছে থাকার কারণে সেটা তার জন্য দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে পুতিনের অধীনস্থ অনেকেই তাকে সঠিক ও সুস্পষ্ট তথ্য দেয়নি। ইউক্রেনের বাহিনীর সক্ষমতা বা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর তাৎক্ষণিক অবস্থা সম্পর্কে তাকে বিশদভাবে জানানো হয়নি।
সঙ্ঘাতের সময় রাশিয়ান সেনাবাহিনী আর আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে ছিলো সমন্বয়ের অভাব। তাদের পরস্পরের মধ্যে বরং প্রতিযোগিতার মনোভাব ছিল সবসময়। খারাপ সময়ে, দুই গ্রুপের ভেতরের এই উত্তেজনা রুপ নিয়েছে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে। ওয়াগনার গ্রুপ আর রাশিয়ান সেনাবাহিনীর মধ্যেও আমরা সেটাই দেখেছি।
পুতিনের জন্য এই সম্ভাব্য ঝড়ের ঝাপটা আপাতত দূর হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে ওয়াগনার গ্রুপই একমাত্র আধাসামরিক বাহিনী নয়, যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানালো। আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে তারা হয়তো অন্যতম শক্তিশালী, কিন্তু এই ধরনের বাহিনী রাশিয়াতে আরও আছে।
১২ হাজার চেচেন সেনা নিয়ে গঠিত আধাসামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন রমজান কাদিরভ। এর আগে তিনিও তার বাহিনী আর রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমস্যার কথা বলেছিলেন। যদি ওয়াগনার গ্রুপ বিদ্রোহ করার পর কাদিরভ তাদের নিন্দা করেছেন এবং রাশিয়ার পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন।
একটা বিষয় খেয়াল রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো পুতিন জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ওয়াগনার গ্রুপের নিন্দা করেছেন মনে হলেও গ্রুপের প্রধান প্রিগোঝিনের নাম তিনি উল্লেখ করেননি। খুব সতর্কভাবেই এই কাজটি করেছেন পুতিন। এই ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে পুতিন তার বিকল্পগুলো খোলা রেখেছিলেন। প্রিগোঝিনের বিদ্রোহ আদৌ কোন সাফল্য পেলেও দর কষাকষির একটা পথ তিনি খোলা রাখতে চেয়েছেন।
এই সশস্ত্র বিদ্রোহ স্বল্পস্থায়ী হলেও সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তবে সেটা সঙ্ঘাতের গতির মোড় ঘুরাবে কি না, সেটা এখনও অনিশ্চিত। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এই বিদ্রোহ দীর্ঘায়িত হলে পুতিন হয়তো সঙ্ঘাতের একটা ইতি টানার দিকে যেতেন। পুতিন খুব ভালো করেই জানেন, ইউক্রেনে তাকে কোনভাবেই হারলে চলবে না।
পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে পরাজয়ের দায়ভার পুতিন এক বা একাধিক গ্রুপের উপর দেয়ার একটা সুযোগ পেয়ে যেতেন। ওয়াগনার গ্রুপ এবং আরও যে সব আধাসামরিক গ্রুপ এখনও রাশিয়াতে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছে, তাদের উপর দায় দিয়ে মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করতেন পুতিন।
এরপরও সেটা পুতিনের ক্ষমতা কাঠামোতে একটা ঝাঁকি দিতো। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০০ সালের নির্বাচনে জেতার পর থেকে এ রকম নড়বড়ে অবস্থায় পুতিন এর আগে কখনও পড়েননি। তবে, সহজে তিনি নিয়ন্ত্রণ ছাড়বেন না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। প্রভাব ধরে রাখার জন্য পুতিন সম্ভাব্য সব বিকল্পই বিবেচনা করবেন। রাশিয়াতে পুতিনের এই প্রভাব ও আধিপত্য যতদিন থাকবে, ততদিন এর সরাসরি প্রভাব ইউক্রেন যুদ্ধের ওপরও পড়বে।