সুইডেনকে ন্যাটোতে সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-র সদস্যপদ পাওয়ার আকাক্সক্ষার কথা জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও আশ্বাস দিয়েছে সদস্যপদ দেওয়ার আলোচনা এগিয়ে নিতে। বাস্তবে মুসলিম-প্রধান তুরস্ক কখনও খ্রিস্টান-প্রধান দেশগুলো নিয়ন্ত্রিত ইইউ-র সদস্য হতে পারবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ন্যাটো সদস্যপদের জন্য সুইডেনের আবেদন অনুমোদন করতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইইউ-র সাথে তার দেশের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি এক বৈঠকে এরদোয়ান এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল অভিবাসন, শরণার্থী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং ইইউতে তুর্কিদের ভিসামুক্ত ভ্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন।
একজন সিনিয়র ইইউ কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের বৈঠকটি ছিল ইতিবাচক। তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দশক ধরে ইইউ-র সদস্যপদে প্রার্থী। তবে ২০১৮ সালে প্রক্রিয়াটি কার্যত স্থগিত হয়ে যায়। তখন ইইউ এবং পূর্ব দিকের প্রতিবেশী তুরস্বের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনাকর সম্পর্ক তৈরি হয়।
উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকলেও টানাপড়েনও কম নয়। ইইউভুক্ত অধিকাংশ দেশ মনে করে এ জোটে তুরস্কের যোগদানের প্রচেষ্টা কার্যত মারা গেছে। কিন্তু তারা সেই কথা স্পষ্ট করে বলে না কখনও। কারণ, তাতে এরদোয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হতে পারে। এরফলে জ্বালানি সহযোগিতা এবং অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতির ক্ষেত্রে কাজে সমস্যা হতে পারে।
ইইউ-র সদস্য হওয়ার জন্য তুরস্কের প্রচেষ্টার ইতিহাসের দিকে নজর দিলে অনেক কিছু স্পষ্ট হবে। তুরস্ক ১৯৮৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে। তখন এই জোট ছিল অনেক ছোট। ১৯৯৯ সালে তুরস্ককে প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়া হয়। তুরস্ক ২০০৫ সালে ইইউতে যোগদানের জন্য আলোচনা শুরু করে। ইইউ-র সদস্য পদের জন্য আলোচনা সাধারণত দীর্ঘ হয়, গড়ে প্রায় ১০ বছর লেগে যায়।
তুরস্কের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক আলোচনা ১৮ বছর ধরে চলছে। তবে এর মধ্যে গত পাঁচ বছর আলোচনা কার্যত স্থগিত ছিল। আলোচনাগুলো হয় বিভিন্ন অধ্যায়ের ওপর। সদস্যপদের আলোচনার জন্য ইইউ-র একগাদা নীতিমালা রয়েছে, যা কোপেনহেগেন রাজনৈতিক মানদণ্ড বা কোপেনহেগেন পলিটিক্যাল ক্রাইটেরিয়া হিসাবে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, কার্যকর গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং মুক্ত ও স্বাধীন আদালতের মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। এগুলোকে এই জোটের সদস্য হওয়ার ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়।
মানবাধিকার এবং আইনের শাসনে তুরস্কের অগ্রগতির অভাবের কথা উল্লেখ করে ইইউ ২০১৮ সালে আঙ্কারার সাথে সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা স্থগিত করে। ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর এরদোয়ান সরকার হাজার হাজার কর্মীকে বরখাস্ত করে এবং শত শত সংস্থা বন্ধ করে দেয়। এতে নাখোশ হয় ইউরোপের দেশগুলো।
ইইউর কূটনীতিকরা মনে করেন, তুরস্কের ইইউতে যোগদানের সম্ভাবনা খুবই কম। তারা মনে করছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তুরস্কের মান আরও খারাপ হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশী গ্রিস এবং সাইপ্রাসের সাথে তুরস্কের রয়েছে বৈরী সম্পর্ক। উভয় দেশই ইইউর সদস্য। আবার উভয় দেশই ন্যাটোরও সদস্য। তবে এরদোয়ানসহ তুর্কি কর্মকর্তারা প্রায়ই ওই দুটি দেশের সাধারণ সীমানা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন যে তুরস্ক গ্রিসের অনেক অঞ্চলের মালিক।
তুরস্ক সাইপ্রাস দ্বীপের উত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেখানে সৈন্য মোতায়েন রেখেছে। ১৯৭৪ সালে তুর্কি-ভাষী সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে তুরস্ক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেখানে তুর্কি প্রশাসনকে স্বীকৃতি দেয়নি। অন্যদিকে তুরস্ক সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়নি। এটা তুরস্কের ইইউ-র সদস্যপদ পেতে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করেছে।
সাইপ্রাস সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা বিশ্বের সবচেয়ে জটিল দ্বন্দ্বগুলোর একটি। বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টার পরে এটা স্থবির হয়ে পড়েছে। তুরস্ক ইইউর সদস্যপদ পেতে চাইলে খুব সম্ভবত তাকে সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
বাস্তবতা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর পূর্ব দিকে প্রসারিত হতে চায় না। তুরস্ককে ইইউতে যোগদান করতে দেওয়ার অর্থ হবে একটি বৃহৎ মুসলিম দেশকে এই জোটে একীভূত করা। আর এই দেশটির সঙ্গে সিরিয়া, ইরান ও ইরাকের সীমান্ত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কের বর্তমান কাঠামোতে আঙ্কারার প্রার্থীতা নিয়ে মিথ্যা প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে। তার চেয়ে উভয় প্রতিবেশীর মধ্যে একটি নতুন ধরনের বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করা ভালো হবে। তবে বিদ্যমান কাঠামোর সাথে উভয়েরই লেগে থাকার কারণ রয়েছে।
ইইউর কূটনীতিকরা অভিবাসন এবং অন্যান্য প্রধান নীতির চ্যালেঞ্জ পরিচালনার জন্য তুরস্ককে চাবিকাঠি হিসাবে দেখেন। তারা বিশ্বাস করেন, এ প্রক্রিয়াটি কখনও তুরস্ককে পূর্ণ যোগদানের দিকে নিয়ে যাবে না। তবে আঙ্কারাকে ব্রাসেলসের সাথে সংযুক্ত করা এবং আলোচনার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রয়োজনীয় পথ হতে পারে।
পরবর্তীতে যা ঘটতে পারে তা হলো একটি পুনঃনিযুক্তি, বিশেষ করে জনসাধারণের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই জোট এবং তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হতে পারে। ইইউ-র সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, তুরস্কের সাথে জোটের বৈঠক এখনও আরও ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হতে পারে।
মনে রাখা দরকার, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইইউ এবং তুরস্কের মধ্যে ফাটল তুলনামূলকভাবে আরো বেড়েছে। তবে ইঙ্গিত মিলেছে, উভয় পক্ষই একে অপরের প্রতি উষ্ণ মনোভাবে দেখাতে পারে। সম্প্রতি ইইউ নেতারা তাদের নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের সাথে জোটের সম্পর্ক নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন।
তারা ইউরোপীয় কমিশন এবং ইইউর প্রধান কূটনীতিক জোসেপ বোরেলকে ইইউ-তুরস্কের সম্পর্কের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেন। ইইউ কর্মকর্তাদের মতে, এই প্রতিবেদনটি অক্টোবরে পরবর্তী ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের আগে প্রস্তুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে সমস্ত বিষয় তুলে ধরা হবে। ইইউ-র একজন কূটনীতিক বলেন, আমরা আশা করি, এটি ইইউ-র সাথে সহযোগিতার সব ক্ষেত্রে তুরস্ক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, তার একটি বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আলোচনার আগে ইইউর কূটনৈতিক পরিষেবা একটি সংক্ষিপ্ত মেমো তৈরি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বাড়িয়েছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে একটি স্থিতিশীল এবং নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ইইউর কৌশলগত আগ্রহ রয়েছে। মেমোতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ককে ইইউ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার নীতি সত্ত্বেও আঙ্কারা জোর দিয়ে বলেছে ইইউতে যোগদান তাদের একটি কৌশলগত লক্ষ্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত বিবেচনা সত্ত্বেও তুরস্কের জন্য সুযোগের চেয়ে বেশি বাধা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য এবং ইইউ- তুরস্কের যৌথ সংসদীয় কমিটি নেতা নাচো সানচেজ আমোর বলেন, আমি মনে করি না যে কোনো ধরনের যোগদান প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করা এখনই বাস্তবসম্মত হতে পারে। কারণ মূল প্রশ্নটি মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের। তবে সম্পর্কের অন্যান্য দিক যেমন কাস্টমস ইউনিয়ন, ভিসা উদারীকরণ বা উচ্চ-স্তরের রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
সানচেজ আমোর বলেছেন, তুরস্ককে ইইউ জোটের কাছাকাছি নিয়ে আসা সবসময়ই তাদের লক্ষ্য ছিল। সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের আগেও ছিল এবং এখন আরও বেশি আছে। কারণ তুরস্ক আমাদের প্রতিবেশী এবং আমরা আমাদের সমস্ত প্রতিবেশীর সাথে সম্ভাব্য সর্বোত্তম সম্পর্ক রাখতে চাই। তিনি বলেন, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হবে কি না তা আলাদা বিষয়। যোগদান প্রক্রিয়ার জন্য কোনো শর্টকাট পথ নেই।
ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের ইউরোপের সিনিয়র নীতি বিশ্লেষক আমান্ডা পল বলেছেন, তুরস্কের সদস্যপদের জন্য আলোচনা পুনরায় শুরু করার খুব কম সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ কোপেনহেগেনের রাজনৈতিক মানদণ্ড পূরণ করেনি তুরস্ক।
তবে ইইউ ও তুরস্কের মধ্যে কাস্টমস ইউনিয়নের আধুনিকীকরণের পদক্ষেপ আরও বাস্তবসম্মত বলে মনে হচ্ছে। তুর্কিরা সত্যিই এটা চায়। কারণ ইইউ হলো তুরস্কের প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার। আঙ্কারার কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধা পুনরুদ্ধার করার আলোচনা শুরু করার এই সুযোগটি মিস করা উচিত নয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের।
তুরস্কও চায় ইইউর সদস্য হতে না পারলেও তাদের কাছ থেকে বাণিজ্য সুবিধা আদায় এবং জোটের সদস্য দেশগুলোতে তুর্কি নাগরিকদের ভিসামুক্ত ভ্রমণ নিশ্চিত করতে। সেটা হয়তো সম্ভব হতে পারে।