কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রফতানির চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে রাশিয়া। মস্কো বলেছে, তাদের শর্তগুলো পূরণ করা হলে তারা চুক্তিতে ফেরার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। তবে, বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত মস্কোকে চুক্তিতে ফিরতেই হবে। তা না হলে, তাদের নিজেদের স্বার্থই ক্ষুণ্ন হবে। তারা বলছেন, তুরস্কের সাথে দরকষাকষিতে বসলে আঙ্কারার শর্ত মানা ছাড়া ক্রেমলিনের উপায় থাকবে না। কারণ, তুরস্ক যদি রাশিয়ান নৌবাহিনী ও বেসামরিক জাহাজের জন্য বসফরাসের দরজা বন্ধ করে দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু জায়গায় রাশিয়ার স্বার্থ সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগস্টে তুরস্ক সফরকালে প্রেসিডেন্ট পুতিন ঠিকই কৃষ্ণ সাগর দিয়ে শস্য রফতানির চুক্তিতে ফিরে আসবেন।
রাশিয়া সম্প্রতি ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রফতানি চালু রাখতে এই চুক্তিটি করা হয়েছিল জাতিসংঘের সহায়তায়। যুদ্ধের কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে ইউক্রেনের শস্য রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিল তুরস্ক। চুক্তির এক বছর পর রাশিয়া সরে দাঁড়ানোর কারণে এখন তৈরি হয়েছে নানা সমস্যা। বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার উপরই এর প্রভাব পড়বে না, বরং এর অন্যান্য প্রভাবও হবে সুদূরপ্রসারী। এই ঘটনা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক মানচিত্রও বদলে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঁচ কমান্ডারকে আটক করেছিল রাশিয়া। আটকের পর তাদেরকে তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করে তারা। শর্ত ছিল, যুদ্ধ শেষ না হলে তুরস্ক তাদেরকে ছাড়বে না। কিন্তু ৭ জুলাই তুরস্ক ওই পাঁচ কমান্ডারকে ইউক্রেনের হাতে তুলে দেয়। আঙ্কারার এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছে মস্কো। রাশিয়ার সমর্থক অনেকে তাই মনে করছেন, শস্য রফতানি চুক্তি থেকে মস্কোর বেরিয়ে আসাটা তুরস্কের ওই সিদ্ধান্তের একটা উপযুক্ত জবাব।
এই কমান্ডাররা গত বছর বন্দর নগর মারিউপোলে রাশিয়ান সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর তারা তুরস্কের একটি নিরাপদ ফ্যাসিলিটিতে বেশ কয়েক মাস কাটিয়েছে। এই সেনারা ছিলো ইউক্রেনের আজভ রেজিমেন্টের অংশ। রাশিয়া এই রেজিমেন্টকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে। এই সংগঠনের বিরুদ্ধে নব্য-নাৎসী ও শ্বেত বর্ণবাদী আদর্শের মানুষদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
রাশিয়ার মনে করেন, এই আজভ কমান্ডারদেরকে ইউক্রেনে ফেরত পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, যা রাশিয়ায় মর্যাদায় আঘাত করেছে। রাশিয়ার কেউ কেউ মনে করছেন, রাশিয়া যদি এই অবস্থায় শস্য রফতানি চুক্তিতে অংশ নিতো, তাহলে পুতিনের ভাবমূর্তি দুর্বল হয়ে যেতো। কারণ কৃষ্ণ সাগর দিয়ে এই শস্য রফতানি প্রক্রিয়ায় তুরস্ককে ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
রাশিয়া চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে সত্য। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে আরেকবার পূর্ণ মাত্রার নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ক্রেমলিন। যুদ্ধের শুরুর দিকে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবার চুক্তিতে না থাকার অর্থ এটাও নয় যে, আঙ্কারার সাথে সম্পর্ক ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে মস্কো।
রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেনের বন্দরগুলোতে মিসাইল হামলা চালিয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রাশিয়ার এই হামলার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাময়িকভাবে হলেও ইউক্রেনের শস্য রফতানিতে বাধা দেওয়া। জাতিসংঘ সমর্থিত শস্য রফতানি চুক্তি সম্পর্কে মস্কো-আঙ্কারার ভিন্নমত থাকলেও তুরস্কের নেতা এরদোয়ান জানিয়েছেন , পুতিন এবং তিনি এখনও বন্ধুই আছেন।
আগস্টে পুতিন তুরস্ক সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এই সফরে শস্য রফতানির ইস্যুটি অবশ্যই অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। রাশিয়া যদিও তাৎক্ষণিকভাবে এই চুক্তিতে না থাকার কথা জানিয়েছে, তবে এরদোয়ান বলেছেন যে, এই চুক্তি চালিয়ে যাওয়ার ব্যপারে পুতিনের আগ্রহ আছে।
নতুন করে চুক্তি হলে, সেটার চেহারা কেমন দাঁড়াবে সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। রাশিয়ান কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, শর্ত হিসেবে তুরস্ককে প্রচলিত বৈশ্বিক মূল্যে রাশিয়ার শস্য কিনতে হবে। অন্যদিকে, আঙ্কারা আশা করছে তারা রাশিয়া ও ইউক্রেনের শস্য কেনার ক্ষেত্রে মূল্য ছাড় পাবে।
আবার, এরদোয়ান যেহেতু এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন, সে বিবেচনায় পুতিনকে হয়তো শেষ পর্যন্ত তুরস্কের শর্ত মেনে নেওয়া লাগতে পারে। মস্কো যদি সেটা মেনে নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে রাশিয়াকে তার জন্য বড় মূল্য দিতে হতে পারে।
আঙ্কারা রাশিয়ার নৌবাহিনী ও সিরিয়াগামী বেসামরিক জাহাজগুলোর জন্য বসফরাস ও ডারডানেলাস প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। তুরস্ক যদি সে ধরণের কোন সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার বিনিময়ের বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে উঠবে।
রাশিয়ান জ্বালানি কোম্পানিগুলো তুরস্কে বহু বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের সাথে কাজ করছে। এই প্রকল্পগুলোর সম্ভাবনাও রাশিয়ার জন্য সীমিত হয়ে আসতে পারে। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের মেসরিন প্রদেশে একটি পারমানবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে রোসাটোম। অন্যদিকে, তুরস্ককে গ্যাসের অন্যতম হাব হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে গ্যাজপ্রম। এই বড় দুই কোম্পানিই নিশ্চিতভাবে ক্রেমলিনকে চাপ দেবে, যাতে তারা তুরস্ককে কোনভাবে ক্ষুব্ধ না করে।
এর বাইরেও পদক্ষেপ নিতে পারে তুরস্ক। রাশিয়ার অনেক ওলিগার্ক বা ধনকুবের তুরস্কে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। তুরস্কের কর্তৃপক্ষ পশ্চিমাদের অনুসরণে এই সব ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। অন্যদিকে, রাশিয়াকে বাদ দিয়েই তুরস্ক ও ইউক্রেন শস্য চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু করতে পারে। তা করা হলে রাশিয়ার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে, রাশিয়ার হুমকিকে অগ্রাহ্য করে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে শস্য রফতানি অব্যাহত রাখতে পারে।
ইউক্রেনও এই ধরণের চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি সম্প্রতি এরদোয়ান ও জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুটেরেসের সাথে দেখা করেছেন। তিনি তাদেরকে বলেছেন, রাশিয়াকে বাদ দিয়েই ইউক্রেনের শস্য পরিবহনের বিষয়ে তারা যাতে সমর্থন করেন।
কিয়েভ ও আঙ্কারা এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, ক্রেমলিন খুব সম্ভবত ইউক্রেন বা তুরস্কের বেসামরিক জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার সাহস করবে না। কারণ তারা এ ধরণের কোন সিদ্ধান্ত নিলে তুরস্ক সরাসরি ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেন আর তুরস্ক নিজেদের মতো করে শস্যের বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে।
মস্কো যদি আক্রমণাত্মক অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং ইউক্রেনের বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া বা বন্দরগামী জাহাজে হামলা করতে শুরু করে, তাহলে কিয়েভও নিশ্চিতভাবে তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবে। এ রকম পরিস্থিতিতে শেষ পদক্ষেপ হিসেবে তুরস্ক এমনকি কৃষ্ণ সাগর রুটে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করা শুরু করতে পারে। পরিস্থিতি সেই পর্যায়ে গেলে সেটা প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তার যুদ্ধ কৌশলের উপর আরেকটি বড় আঘাত হিসেবে প্রমাণিত হবে।
অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে হলে, ক্রেমলিনকে আঙ্কারার পছন্দের পথে হাঁটা ছাড়া উপায় থাকবে না। তবে, দর কষাকষির ক্ষেত্রে মস্কো সব সময় আরেকটি বিষয় সামনে আনবে। সেটা হলো, একটা সদিচ্ছা থেকে তারা শস্য রফতানি চুক্তিতে অংশ নিয়েছে। আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোকে যাতে সাহায্য করা যায়, সে জন্য তারা শস্য রফতানির প্রক্রিয়া চালু রাখতে চেষ্টা করেছে। তবে, এরদোয়ান হয়তো এটাও বলতে পারেন যাতে মস্কো মালি, জিবুতি, সুদান, ও সোমালিয়ার মতো আফ্রিকার দেশগুলোতে বিনামূল্যে শস্য পাঠানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। কারণ তুরস্ক এই দেশগুলোতে তাদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তুরস্কের বিখ্যাত কমব্যাট ড্রোন তৈরি করে বায়রাক্তার কোম্পানি। এই কোম্পানিটি ইউক্রেনে ড্রোন তৈরির একটি প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। তুরস্কের এই পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায়, নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এরদোয়ান আত্মবিশ্বাসী, এবং তুরস্কের স্বার্থের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে তারা হুমকি মনে করে না। তিনি জানেন , তুরস্ক যদি দর কষাকষির টেবিলে বসতে চায়, তাহলে সেখানে মস্কোর খুব বেশি সুবিধা করার সুযোগ হবে না।
এই মুহূর্তে অন্তত চালকের আসনে রয়েছে তুরস্ক। রাশিয়াকে নতুন করে শস্য চুক্তিতে রাজি করানোর জন্য চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে এরদোয়ান কোন দ্বিধা করবেন না। কারণ, এই চুক্তি আঙ্কারার অর্থের সাশ্রয় করবে। অন্যদিকে, বিশ্ব বাজারেও শস্যের চালান জারি থাকবে। মস্কো যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা হয়তো তারা কৌশল হিসেবেই নিয়েছে। কিন্তু, তাদেরকেও শেষ পর্যন্ত চুক্তিতে ফিরতে হবে, কারণ এর বাইরে তাদের সামনে খুব বেশি বিকল্প নেই।