অনেকদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের পুরোনো মিত্রদের সাথে দূরত্ব বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো পরীক্ষিত মিত্র দেশও ওয়াশিংটন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বদলে গেছে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণ। নিরাপত্তার ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছে এই দেশগুলো। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ধরে রেখেছে কাতার। বাণিজ্যের স্বার্থে এবং ভারসাম্য রাখতে গিয়ে চীনের সাথে চুক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্রকে তারা সৌদি আরব বা আমিরাতের মতো দূরে ঠেলে দেয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কাতারই এখন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আরব মিত্র।
চীনের কাছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি বিক্রির জন্য সম্প্রতি ২৭ বছর মেয়াদি চুক্তি করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। এই চুক্তির অধীনে বেইজিংয়ের কাছে চার মিলিয়ন টন গ্যাস রফতানি করবে দোহা। গ্যাস রফতানির ইতিহাসে এত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। তবে এই চুক্তির আরেকটি দিক আছে। উপসাগরীয় দেশগুলো কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে, তার একটি উদাহরণ এই চুক্তি।
অনেকেই মনে করছে, এই চুক্তি কাতারের গ্যাসের উপর চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। এটা একদিকে যেমন বাণিজ্যিক চুক্তি, তেমনি এখানে আছে নিরাপত্তার দিক। চীন যে উপসাগরীয় দেশগুলোর সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার, এই চুক্তিতে সেটা বোঝা গেছে। আবার এই চুক্তির কারণে চীনের উপর বর্তেছে কাতারকে সুরক্ষা দেয়ার একটা দায়।
কাতার একাই যে জ্বালানি রিজার্ভের উপর চীনকে কর্তৃত্ব দিয়েছে, এমন নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য বড় রফতানিকারক দেশগুলোও এমনটা করেছে। চীন এখন সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতেরও সবচেয়ে বড় বাজার।
কাতারের সাথে অন্য দেশগুলোর পার্থক্য হলো, চীনের সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে দোহা একটা ভিন্ন নীতি অনুসরণ করেছে। এই নীতি তাদেরকে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি। কাতার এখানে দুই পক্ষের মধ্যেই ভারসাম্য রেখেছে, এবং বেছে নিয়েছে সম্ভাব্য সঙ্ঘাত এড়ানোর পথ।
অন্যদিকে, সৌদি আরব আর আরব আমিরাত নিজেদের স্বাধীনতার উপর জোর দিয়েছে। প্রয়োজনে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব বজায় বা মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেনি। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে তারা যুক্তরাষ্ট্রের চোখেও গুতা দিয়ে বসেছে।
কাতারের সাথে অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর এই পার্থক্য গত মাসেও বেশ স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে। আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ একমাত্র রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ইকোনমিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন। অনেকের তখন চোখ কপালে উঠেছিল। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই মস্কোর উদ্দেশে উড়াল দেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল-সানি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে দেখা করেন তিনি।
বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র আর আরব আমিরাতের সম্পর্ক মেরামতের যে চেষ্টা করেছিল, বিন জায়েদের সফর সেই চেষ্টাকে মাটি করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। বিশ্লেষক জোনাথন লর্ড ও আইরোনা বাইগাল বলেছেন, এটা সত্য, বিন জায়েদ তার দিক থেকে অনেকবার প্রমাণ করেছেন, আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত অংশীদার। কিন্তু তার সাম্প্রতিক কর্মকান্ডের মধ্যে তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এর বিপরীতে, কাতার গত মাসে ভেনেজুয়েলার এক সিনিয়র কর্মকর্তার সাথে মার্কিন কর্মকর্তাদের বৈঠকের আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্র যখন বিরোধী নেতা উয়ান গুয়াইডোকে ভেনেজুয়েলার বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ওই দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়। এই উত্তেজনা কাটিয়ে ওঠার জন্যই দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করেছিল কাতার। কর্মকর্তারা বলেছেন, এই আলোচনার সূত্রে দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় হতে পারে।
ব্রাসেলস-ভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতির বিশেষজ্ঞ এলডার মামেদোভ মনে করেন, ভেনেজুয়েলা ইস্যুতে সক্রিয় হওয়ার পুরস্কার অনেক বড়, অথচ ঝুঁকি অনেক কম। দুই দেশের মধ্যে বৈঠক আয়োজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক কূটনৈতিক অঙ্গনে দোহা নিজেদেরকে উদীয়মান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। ওয়াশিংটনকে তারা বেশ কিছু রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর জায়গা থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করছে।
সুদূর আমেরিকা মহাদেশে গিয়ে কাতারের মধ্যস্থতা করার বিষয়টি অনেকটাই অস্বাভাবিক। কারণ তাদের সাথে কাতারের কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় মিল নেই। তবে, অন্য দিক থেকে কাতার ছিল আবার উপযুক্ত। গুয়াইডোকে যে সব সরকার স্বীকৃতি দিয়েছিল, কাতার তাদের সাথে যোগ দেয়নি। আবার ভেনেজুয়েলার উপর যারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের সাথেও তাল মেলায়নি দোহা।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই তালেবানদের অফিস করার অনুমতি দিয়েছে কাতার। এই অফিসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সাথে আলোচনায় অংশ নিতে পেরেছে, এবং শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে সরে এসেছে মার্কিন বাহিনী। এই অফিসের মাধ্যমেই এখনও তালেবানদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময় আরব আমিরাতের মতো কাতারও যথেষ্ট লজিস্টিক্স সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতাতেও কাতারের ভূমিকা আছে। দুই দেশের মধ্যে বার্তা লেনদেনে কাজ করেছে দোহা।
আরব আমিরাতের মতো রাশিয়ানদের আশ্রয়স্থল হয়ে যায়নি কাতার। মার্কিন ও ইউরোপিয়দের নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য বহু রাশিয়ান আরব আমিরাতকে আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। এমনকি আমিরাতে আশ্রয় নিয়েছে রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের অনেকে ।
রাশিয়া ও ইরানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগে আমিরাতের বিভিন্ন কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কাতারের কোনো কোম্পানি এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েনি। আবার আমিরাত স্বাধীনভাবে তাদের নীতি গ্রহণ করায় ফিনান্সিয়াল অ্যাকশান টাস্ক ফোর্স বা এফএটিএফ তাদেরকে গ্রে লিস্টভুক্ত করেছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও মানি লন্ডারিংয়ের উপর নজরদারির এই প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন ইঙ্গিতে কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কাতার এটাও নিশ্চিত করেছে যাতে চীনা টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির উপর তারা বেশি নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ভয় রয়েছে, আমেরিকান অস্ত্র সিস্টেম ও অন্যান্য নিরাপত্তা প্রকল্পের মধ্যে যে সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, চীনা প্রযুক্তির উপর বেশি নির্ভরশীল হলে, এই সব অস্ত্র প্রযুক্তির তথ্য চীনের হাতে চলে যেতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে কাতারে। গত বছর ওয়াশিংটন কাতারকে দিয়েছে অন্যতম অ-ন্যাটো মিত্রের মর্যাদা। এটা ঠিক , আরব আমিরাত ও সৌদি আরব অনেক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করেছে। অতি সম্প্রতি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল। এর আগে, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সেনাও পাঠিয়েছিল আরব আমিরাত।
কাতারকে সাড়ে তিন বছর ধরে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বয়কট করে রেখেছিল আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলো। ২০২১ সালের শুরুর দিকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। তবে, এই নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হতে কাতার আলাদা করে কোনো দেন-দরবার করেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল, কোনো ধরনের বোঝাপড়ায় গেলে তারা আমিরাত ও সৌদির প্রভাব বলয়ে চলে যেতে পারে।
বয়কটকালীন সময়ে, কাতার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিরাপত্তা সম্পর্ক ও সহযোগিতা আরও জোরদার করেছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ইস্যুতে তাদের সহযোগিতা বেড়েছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের বিষয়টিকে সৌদি আরব বা আমিরাতের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখে কাতার। সৌদি ক্ষমতাসীন অভিজাত শ্রেণীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে সৌদি ভাষ্যকার আলি শিহাবির। তিনি বলেছেন, সময়ের সাথে সাথে সৌদি আরব নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তারা ছিল শিশুর মতো। এখন তারা আত্মবিশ্বাসী জি-২০ ভুক্ত একটি দেশ, যারা বিশ্বে নিজের অবস্থান সংহত করেছে।
রিয়াদের একটা ধারণা তৈরি হয়েছে , সৌদি আরবের ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ভাবনা আগের মতো নেই। সে কারণে নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির জন্য তারা অন্য জায়গায় চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালে ইরান যখন সৌদি আরবে তেল ফ্যাসিলিটিতে হামলা করেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসেনি। এছাড়া ইয়েমেনে সৌদি আরব অভিযান চালানোর পর রিয়াদের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রিও বন্ধ করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
আরব আমিরাতেরও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ইরান সমর্থিত গোষ্ঠি যখন আমিরাতে হামলা করেছিল, তখন জবাব দিতে অস্বীকার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
মার্চ মাসে সৌদি আরবের এক মন্ত্রী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছেন, তোমরা আমাদেরকে তোমাদের প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সাথে কথা বলতে নিষেধ করছো। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ ইরানের সাথে তোমরা ঠিকই কথা বলছো। তোমরা চীনা অস্ত্র কিনতে নিষেধ করছো। আমরা জানতে চাচ্ছি এর বিকল্প কি আছে? তোমরা বলছো, তোমাদের কাছে আছে, কিন্তু তোমরা বিক্রি করবে না।
আরেক সৌদি মন্ত্রী বৈঠকে বলেন, তোমরা বলেছিলে ইয়েমেনে আমাদের সাথে থাকবে। কিন্তু তোমাদের কোনো দেখা মেলেনি। ক্রাউন প্রিন্স দেশের সুরক্ষার জন্য আমেরিকার উপর খুব বেশি নির্ভর করতে চাচ্ছেন না। সৌদি আরবের স্বার্থের কথা ভেবে বড় শক্তিগুলোর সাথে খুব কৌশলে খেলছেন এমবিএস।