বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্যাসের মজুদ আছে রাশিয়ায়। এই গ্যাসসম্পদ ব্যবহারে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে মস্কোকে। রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানির মোট অবকাঠামোর বেশিরভাগই পশ্চিমাবিশ্বে রপ্তানির উদ্দেশ্যে তৈরি করা। কিন্তু বর্তমানে দেশটির গ্যাসের গ্রাহকের বৃহত্তর অংশই পূর্বে। আর এ গ্রাহকদেরকে গ্যাস সরবরাহের জন্য রাশিয়ার নতুন করে অনেক অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। ইউক্রেনে আক্রমণের কারণে রাশিয়া তার গ্যাস রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ হারিয়েছে।
২০২১ সালে রাশিয়া ইউরোপে ১৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে রপ্তানি করে। এ পরিমাণ গ্যাস জার্মানি, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ায় বার্ষিক ব্যবহৃত মোট গ্যাসের চেয়েও বেশি। যুদ্ধের আগে রাশিয়া এর দুই-তৃতীয়াংশ গ্যাস ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করত। ইউক্রেন যুদ্ধ যত দীর্ঘ হচ্ছে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস বানিজ্যর দুয়ার ততটাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প ব্যবস্থা করছে। কিন্তু তাই বলে রাশিয়া বসে নেই।
রাশিয়া গ্যাসের বাজার সম্প্রসারণে নিয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগ। এরমধ্যে তুরস্কে ট্রেডিং হাব, মধ্য এশিয়ায় নতুন বাজার, ও চীনমুখী নতুন পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব পরিকল্পনায় অগ্রগতির জন্য রাশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে নানা ধরনের কলকাঠি নাড়তে হবে। ফলে বাড়তি গ্যাস নিয়ে আপাতত কী করবে তা নিয়ে মস্কোর হাতে বর্তমানে বেশি বিকল্প নেই। আর উৎপাদন হ্রাস থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়ার গ্যাসের বেশিরভাগ অংশই এখন মাটির নিচে রয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধের পর রাশিয়া তার গ্যাসের নতুন বাজার খুঁজেছে। অন্যদেরকে বাড়িয়েছে গ্যাস সরবরাহ । রাশিয়ার ভেতর যেসব অঞ্চলে এখনো অভ্যন্তরীণ গ্যাস নেটওয়ার্ক পৌঁছেনি, সেখানে নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা নেবে জানিয়েছে। কিন্তু এতসব উদ্যোগের পরও রাশিয়ার এখনো ৯০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের কোনো ক্রেতা নেই। ফলে বড় নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা রুশ অর্থনীতির ওপর তা আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করেছে। এ বছর গ্যাসের দাম ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ায় দেশটির আয়ও কমে গেছে।
যুদ্ধের আগে রাশিয়ার বাজেটের অর্থের এক-তৃতীয়াংশের বেশির উৎস ছিল এ তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে পাওয়া আয়। তেলের বাজার ঠিক থাকলেও গ্যাস-রাজস্বের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সরকার ও দেশটির সবচেয়ে বড় গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম উভয়ই ক্ষতির মুখে পড়েছে। গত শীতের তীব্রতা বেশি না থাকায় ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানি নিয়ে মারাত্মক কোনো সংকটে পড়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু ইউরোপের বাজার থেকে সরে আসার ধাক্কা সামলানো রাশিয়ার জন্য সহজ হয়নি। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসে রাশিয়ার গ্যাস বিক্রির আয় ছিল ৮৩০ কোটি ডলার। এ বছরের একই সময়ে তা ৪৫ শতাংশ কমে গিয়েছে।
রাশিয়া তার গ্যাস নিয়ে কৌশল বদলে চীনের দিকে মুখ ঘুরিয়েছে। এ বছরের গোড়ার দিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রাশিয়ার পূর্বদিকে চীন সীমান্তের কাছে গ্যাস উৎপাদন, পরিশোধন ও পরিবহন ব্যবস্থার বিকাশের সত্যিকারের কৌশলগত গুরুত্ব আছে বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্চ মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন মস্কো সফর করেন, তখন বেইজিং রাশিয়ান গ্যাস আরও বেশি পরিমাণে কেনার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি রাশিয়াকে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বের চালু হওয়া পাওয়ার অব সাইবেরিয়া গ্যাস পাইপলাইনটি চীনে গ্যাস সরবরাহ করে। চীনের কাছে আরও গ্যাস বিক্রি করতে হলে ক্রেমলিনকে এ পাইপলাইনের পরিপূরক নতুন পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে।
যুদ্ধের আগে ইউরোপে রাশিয়া যে পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি করছিল, তার অতি অল্প অংশই এখন চীনে যাচ্ছে। তবে এ বছরের মধ্যে এর পরিমাণ ৪২ শতাংশ বেড়ে ২২ বিলিয়ন ঘনমিটার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ রাশিয়া চীনে ৩৮ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস রপ্তানি করতে পারে।
ইউক্রেনে আক্রমণের আগে গ্যাজপ্রম চীনের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহের দ্বিতীয় একটি চুক্তি করেছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী গ্যাজপ্রম চীনকে আগামী ২৫ বছর ধরে বছরে আরও বাড়তি ১০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করবে। এ গ্যাস যাবে ফার ইস্টার্ন রুট নামক দ্বিতীয় একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে কিন্তু সেটি এখনো নির্মাণ বাকি।
মস্কোর দাবি, তথাকথিত পাওয়ার অব সাইবেরিয়া টু প্রকল্প নিয়ে আলোচনা কয়েক মাস ধরেই 'চূড়ান্ত পর্যায়ে' আছে। এ পাইপলাইন চীনে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহকে দ্বিগুণ করে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ঘনমিটারে উন্নীত করবে। এমনকি যদি এ বছরের শেষ নাগাদও মস্কো-বেইজিংয়ের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় পাইপলাইন তৈরি করতে কমপক্ষে আরও পাঁচ বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ উৎপাদিত গ্যাস নিয়ে রাশিয়াকে বেশ জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
ইউরোপের বাজারকে রাতারাতি প্রতিস্থাপন করা মস্কোর জন্য সহজ কোনো কাজ নয়। দ্য অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজ-এর জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ভাইতালি ইয়েরমাকভ মনে করেন, আলোচনার বিষয়ে চীন সময় নিয়ে চাপের মুখে আছে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে রাশিয়া এক ধরনের টাইমবোমার ওপর বসে আছে। কারন গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ হুট করে বড় মাপে কমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
যুক্তরাজ্য এবং বাল্টিক দেশগুলোর মতো অনেক দেশ সরাসরি এলএনজিসহ রাশিয়ান গ্যাস কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল। এসব অঞ্চলে আরও অনেক দেশের সরকার কোম্পানিগুলোকে রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর আহ্বান করেছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাশিয়ান গ্যাসের ওপর শতভাগ নিষেধাজ্ঞা জারি সম্ভব হয়নি।
তা সত্ত্বেও পশ্চিমা বাজারের ক্রেতারা রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর প্রক্রিয়ায় যেভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, তাতেই ২০২২ সালে গ্যাজপ্রমকে গ্যাসের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমিয়ে গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৪১২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ঘনমিটারে নামিয়ে আনতে হয়েছে। আর নেট আয় ৪১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২৩ ট্রিলিয়ন রুবলে।
তুরস্ক অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার গ্যাসের বড় ক্রেতা। রাশিয়া এখন চেষ্টা করছে তুরস্ককে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে ইউরোপে গ্যাস পাঠাতে। তুরস্কে একটি ট্রেডিং হাব তৈরির পুতিনের পরিকল্পনাকে ইতোমধ্যে স্বাগতম জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এটি হলে তুরস্কের গ্যাসের চাহিদা পুরন হবে না বানিজ্যিক ভাবে লাভবান হবে তুরস্ক। কিন্তু এ রকম জ্বালানী হাব গড়ে তুলতে বেশ সময় লেগে যাবে।
গ্যাজপ্রম কয়েকটি সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিকের সঙ্গে আলোচনা বাড়িয়েছে। গত জুনে উজবেকিস্তানের সঙ্গে এটি একটি সরবরাহ চুক্তি সই করেছে। এছাড়া আজারবাইজান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে একত্রে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। ২০২৩ সালের শুরুতে কাজাখস্তান ও গ্যাজপ্রমের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ফলে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি বাড়তে পারে তবে এক্ষেত্রে চীনে গ্যাস পাঠাতে হলে নতুন পাইপলাইন তৈরি করতে হবে।
রাশিয়ার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। এ বছর রাশিয়ার মোট এলএনজি রপ্তানির ১২ শতাংশ গিয়েছে পশ্চিম ইউরোপে। ২০২২ সালে রাশিয়া থেকে রেকর্ড পরিমাণ এলএনজি আমদানি করেছিল ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও স্পেন। যদিও নেদারল্যান্ড ও স্পেন এখন রাশিয়া থেকে এলএনজি কেনা বন্ধের পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে এ অঞ্চল শীঘ্রই রাশিয়ান এলএনজি কেনা বন্ধ করবে না। কারন রাশিয়া থেকে এলএনজি আমদানি ইউরোপের দেশগুলোর জন্য অনেক বেশি লাভজনক। এছাড়া এর বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
রাশিয়া তার গ্যাস সম্পদ ব্যবহারের জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তুরস্কে ট্রেডিং হাব, মধ্য এশিয়ায় নতুন বাজার, ও চীনমুখী নতুন পাইপলাইন এসব হচ্ছে নতুন বাজার সম্প্রসারন পরিকল্পনায় অংশ। তবে এই কাজগুলো এগিয়ে নেয়া সহজ নয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়তে হতে পারে। ফলে বাড়তি গ্যাস নিয়ে আপাতত মস্কোর হাতে বর্তমানে বেশি খুব বেশি বিকল্প নেই। উৎপাদন হ্রাস থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়ার গ্যাসের বেশিরভাগ অংশই এখন মাটির নিচে রয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া যদি মাটির নীচের গ্যাস উত্তোলন না বাড়াতে পারে তাহলে অর্থনীতি এগিয়ে নেয়া কঠিন হতে পারে। কারন রাশিয়ার আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে তেল ও গ্যাস।