লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে ন্যাটোর যে সম্মেলন হলো, তাতে দুটো বিষয় নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বেশি। একটি ইউক্রেন যুদ্ধ, আর দ্বিতীয়টি সুইডেনের সদস্যপদ। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্মেলনের আরেকটি দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। তা হলো- ন্যাটোর নেতারা চীনের ব্যপারে কী বলেছেন। সম্মেলনের পর ন্যাটো যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেখানে অনেকটা জায়গা নিয়ে চীনকে ন্যাটোর জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। চীনের ব্যপারে ন্যাটোর এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য নতুন নয়। আগেও তারা বেইজিংয়ের নীতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। ইউরোপের ন্যাটো-সদস্য দেশগুলো এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে মহড়াতেও অংশ নিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছে, ন্যাটোর তৎপরতা আটলান্টিক ছাড়িয়ে যে ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে, এ-সব তারই লক্ষণ।
ন্যাটো মূলত ট্রান্স-আটলান্টিক জোট। মস্কোকে মোকাবিলার জন্য ১৯৪৯ সালে এই জোট গঠন করা হয়। কিন্তু ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ এবারের সম্মেলনে একটা কথা বারবার বলেছেন, চীন এমন পর্যায়ে চলে গেছে, জোটের পক্ষে তাকে এড়িয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। তার ভাষায়- আমাদের ঘাড়ের ওপর চলে আসছে চীন। আর্কটিক থেকে নিয়ে আফ্রিকা, সাইবার জগৎ থেকে নিয়ে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক, ইউরোপে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ - সব ক্ষেত্রেই কাছাকাছি চলে আসছে চীন। ওদিকে, রাশিয়ার সাথে তাদের যৌথ মহড়াও বাড়ছে চীনের। ন্যাটোর বিজ্ঞপ্তির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে চীন আর তার হুমকির কথা বলা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তির ২৩তম প্যারাতে বলা হয়েছে, চীনের উচ্চাকাক্সক্ষা ও ক্ষতিকর নীতি আমাদের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও মূল্যবোধের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াতে এবং ক্ষমতার শক্তি দেখানোর জন্য চীন বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশল প্রয়োগ করে। কিন্তু নিজেদের কৌশল, উদ্দেশ্য বা সামরিক শক্তি বাড়ানোর বিষয়গুলো তারা গোপন রাখে।
ন্যাটোর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চীন অশুভ হাইব্রিড, সাইবার অভিযান, সঙ্ঘাতপূর্ণ কথাবার্তা, মিত্রদের মধ্যে ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে ক্ষতি করছে ন্যাটো জোটের নিরাপত্তা। তারা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও শিল্প খাত, জরুরি অবকাঠামো, কৌশলগত সরঞ্জাম ও সরবরাহ চেইনের। অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে তারা অন্যদেরকে চীনের ওপর কৌশলগতভাবে নির্ভরশীল করে তুলছে। তারা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছে মহাকাশ, সাইবার ও নৌসীমায় আইন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে।
বিজ্ঞপ্তিতে ন্যাটোর নেতারা বলেছেন, আমরা মিত্র হিসেবে এক হয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করছি। ইউরো-আটলান্টিক নিরাপত্তার প্রতি চীন যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তা মোকাবিলার চেষ্টা করছি। মিত্র দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে ন্যাটোর সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছি। আমরা পারস্পরিক সচেতনতা বাড়াচ্ছি। প্রতিরোধের সক্ষমতা ও প্রস্তুতি বাড়াচ্ছি। চীনের ক্ষতিকর কৌশলের মোকাবিলায় জোটের সুরক্ষা বলয় বাড়াচ্ছি।
ন্যাটোর নেতারা গুরুত্বের সাথে নিয়েছে রাশিয়াকে চীনের সমর্থন দেওয়ার বিষয়টিকে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে চীনের অবস্থানও তারা ভালোভাবে দেখছে না। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞপ্তিতে চীনের পারমাণবিক নীতি নিয়েও জানানো হয়েছে উদ্বেগ। এতে বলা হয়েছে, চীন বাড়াচ্ছে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা। তারা তৈরি করছে জল, স্থল ও আকাশপথে ব্যবহারের উপযোগী পারমাণবিক অস্ত্র। কিন্তু এ-সব ক্ষেত্রে বজায় রাখছে না যথেষ্ট স্বচ্ছতা ।
বিজ্ঞপ্তিতে ন্যাটোর নেতারা বলেছেন, বেসামরিক কর্মসূচির নামে সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের যে কোন প্রচেষ্টার আমরা বিরোধীতা করি। আমরা চীনের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি, যাতে তারা পারমাণবিক ঝুঁকি কমানোর জন্য আলোচনায় অংশ নেয়, এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
স্বাভাবিকভাবেই ন্যাটোর অভিযোগের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বেইজিং। ১১ জুলাই ইউরোপিয় ইউনিয়নে নিযুক্ত চীনা মিশন থেকে এক বিবৃতি দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ন্যাটোর বিজ্ঞপ্তিতে চীন বিষয়ে যে সব কথাবার্তা বলা হয়েছে, সেখানে মৌলিক সত্যকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, চীনের অবস্থান ও নীতিকে করা হয়েছে বিকৃত। চীনকে হেয় করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। তবে, চীনকে নিয়ে কথা বললেও অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা ভুল প্রমাণ করে বিজ্ঞপ্তিতে তাইওয়ানের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে ন্যাটো।
তবে, সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ঠিকই তাইওয়ানের কথা উল্লেখ করেছেন ন্যাটোর মহাসচিব। তিনি বলেছেন, চীন চ্যালেঞ্জ করছে আইন-ভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে, অস্বীকার করেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার নিন্দা করতে, হুমকি দিচ্ছে তাইওয়ানকে, এবং বাড়াচ্ছে সামরিক শক্তি। চীন প্রসঙ্গের বাইরেও ন্যাটোর বিজ্ঞপ্তিতে বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে ইন্দো- প্রশান্ত অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে।
ন্যাটোর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইন্দো- প্রশান্ত অঞ্চল ন্যাটোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই অঞ্চলের যে কোন ঘটনা ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তায় এশিয়া প্রশান্ত অঞ্চলের মিত্র দেশ অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউ জিল্যান্ড, আর কোরিয়া রিপাবলিকের অবদানকে আমরা স্বাগত জানাই। এতে বলা হয়েছে, অভিন্ন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সংলাপ ও সহযোগিতাকে আরও জোরদার করবো। সাইবার সুরক্ষা, প্রযুক্তি, ও হাইব্রিড জগতেও আমাদের সহযোগিতা জারি থাকবে।
মনে রাখতে হবে, ন্যাটো সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন ইন্দো প্রশান্ত অঞ্চলের চার নেতা। এরা হলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়েওল, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ, এবং নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্স। চীনের ব্যপারে ন্যাটোর উদ্বেগ অবশ্য নতুন কিছু নয়। ২০২০ সালে ন্যাটো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য ন্যাটোকে অবশ্যই আরও সময় ও রাজনৈতিক সম্পদ ব্যায় করতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে। চীনের জাতীয় সক্ষমতা, অর্থনৈতিক শক্তি, এবং চীনা নেতাদের আদর্শিক লক্ষ্য বিশ্লেষণ করে এই পদক্ষেপ নিতে হবে।
২০২২ সালের মাদ্রিদ সম্মেলনে যে কৌশলগত ধারণা গ্রহণ করেছিল ন্যাটো, সেখানেও চীনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। চীনের উচ্চাকাঙ্খা ও ক্ষতিকর নীতি ন্যাটোর স্বার্থ, নিরাপত্তা, ও মূল্যবোধকে যে চ্যালেঞ্জ করছে, সেটাও সেখানে উল্লেখ ছিল। সংক্ষেপে বললে, চীনের ব্যপারে ন্যাটোর আশঙ্কার দিক রয়েছে চারটি ।
প্রথমত, ইউরোপে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও বন্দর সুবিধা খাতে রয়েছে চীনের বড় বিনিয়োগ। ন্যাটোর ভয় হলো, আন্তর্জাতিক সঙ্কট মুহূর্তে তারা কূটনীতিকভাবে, বা সামরিকভাবে কোন পদক্ষেপ নিতে গেলে এগুলো বাধা হতে পারে। ইউরোপের সম্পূর্ণ বন্দর সক্ষমতার প্রায় ১০ শতাংশের মালিকানা হলো চীনের। পূর্ব ইউরোপের সড়ক ও রেল নেটওয়ার্কে চীনের যে বিনিয়োগ, সেটিও ন্যাটোর জন্য উদ্বেগের। সঙ্কট মুহূর্তে ন্যাটোর সামরিক অভিযান এগুলোর কারণে জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
দ্বিতীয়ত, বেইজিং-মস্কোর সামরিক সহযোগিতা সম্প্রতি বেড়ে গেছে। দুই দেশের নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর ও বাল্টিক সাগরে যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। আর্কটিক অঞ্চলেও দুই দেশ একসাথে কাজ করছে। এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগকারী এই বিকল্প রুটটি সুয়েজ খালের উপর তাদের নির্ভরতা কমাবে।
তৃতীয়ত, চীনের দূরপাল্লার মিসাইল, বিমানবাহী রণতরী, পারমাণবিক অ্যাটাক সাবমেরিন, এবং এগুলোর বিশ্বের যে কোন জায়গায় আঘাত হানার সক্ষমতার কারণে ন্যাটোর প্রতি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সেই সাথে, চীন-ভিত্তিক হ্যাকাররা যদি ইউরোপে সাইবার হামলা শুরু করে, তাহলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে উঠবে।
চতুর্থত, তাইওয়ানের প্রতি চীনের হুমকি বাড়লে, সেটা যদি চীন-আমেরিকা যুদ্ধে গড়ায়, তাহলে কোন না কোনভাবে ন্যাটো আক্রান্ত হবে। কারণ ন্যাটোর নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র।
ন্যাটো চুক্তির পঞ্চম অনুচ্ছেদে বলা আছে, জোটের কোন সদস্য সশস্ত্র হামলার শিকার হলে, সেটা জোটের সব সদস্যের উপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সঙ্ঘাতে সেটা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কারণ, ওই অনুচ্ছেদটি মূলত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ভৌগলিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সেটার প্রয়োগ খুব একটা সহজ হবে না। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতেই ন্যাটোর প্রধান ইউরোপিয় সদস্য দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি আগে থেকেই ইন্দো- প্রশান্ত অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি আগে ছিল না।
২০২১ সালে, এশিয়ার জলসীমায় ২১টি যুদ্ধজাহাজ পাঠায় ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো। আঞ্চলিক নৌবাহিনীর সাথে মিলে তারা যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। শক্তি প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল ব্রিটিশ ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ২১ এর সাত মাসব্যাপী বিচরণ। নতুন এইচএমএস কুইন এলিজাবেথ বিমানবাহী রণতরী, তার সাথে দুটো রয়্যাল নেভি ডেস্ট্রয়ার, দুটো ফ্রিগেট, দুটো সহায়ক জাহাজ, আর একটি পারমাণবিক চালিত সাবমেরিন নিয়ে এই স্ট্রাইক গ্রুপটি গঠিত। ওই অঞ্চলে ব্রিটিশ নৌবাহিনী ফ্রান্স, জাপান, সিঙ্গাপুর, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
ফ্রান্সও তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরে ফ্রান্সের ভূখণ্ড আছে। নয় মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে তাদের ১ দশমকি ৬ মিলিয়ন মানুষ বাস করছে। সেখানে স্থায়ীভাবে সাত হাজার সেনা মোতায়েন আছে। ২০টি নৌযান আছে। সার্বভৌম সীমার মধ্যে ৪০টি বিমান আছে। ন্যাটো সম্মেলনের ঠিক আগ দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়েছে ১০টি জঙ্গি বিমান ।
ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে মনোযোগ দিয়েছে জার্মানিও। ২০২১ সালে তারা ইন্দো- প্রশান্ত অঞ্চলে ফ্রিগেট পাঠিয়েছিল। গত মাসে সাংগ্রি লা সম্মেলনে জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বোরিস পিস্টোরিয়াস ঘোষণা দেন, বার্লিন আগামী বছর ইন্দো- প্রশান্ত অঞ্চলে দুটো নৌযান পাঠাবে। সন্দেহ নেই , ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে ন্যাটো দেশগুলোর এসব সামরিক তৎপরতার লক্ষ্য হলো চীন। সেই কারণেই বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাটোর উদ্বেগের পরিসর আটলান্টিক পার হয়ে ছড়িয়ে গেছে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত।