বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই আফ্রিকা মহাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে ভাড়াটে বাহিনী। সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন কিংবা অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনো নেতাকে ক্ষমতায় বসাতে ভাড়াটে বাহিনীকে ব্যবহার করা শুরু হয়। বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর অনেক দেশই ভাড়াটে বাহিনীকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির অংশ করে নিয়েছে। রাশিয়া এ-ক্ষেত্রে সামনের সারিতে আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া তার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী সংগঠন ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করছে।
লিবিয়া, সুদান, মোজাম্বিক, মালি, বুরকিনা ফাসো, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও রিপাবলিক অব কঙ্গোতে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে ওয়াগনার গ্রুপকে পাঠায় রাশিয়া। এ-সব দেশে সরকার অথবা শক্তিশালী বিরোধীপক্ষকে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে রাশিয়া। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে পশ্চিমাপন্থী সরকার উৎখাত করেন সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
এই সমর্থনের বিনিময়ে এ-সব দেশের স্বর্ণ ও হীরাসহ মূল্যবান খনিজসম্পদ আহরণ করার চুক্তির পাশাপাশি বিমানবন্দর ব্যবহার করার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে রাশিয়াকে। সম্প্রতি নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা দখলকারী জান্তা সরকার ওয়াগনার বাহিনীর সাহায্য চেয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে।
ইউক্রেন-যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দেশটির ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরও এখনও প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের আফ্রিকা কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে ওয়াগনার গ্রুপ। এই বাহিনী আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে শক্তিশালী করে দিচ্ছে বলে মনে করেন অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের শিক্ষক স্যামুয়েল রামানী। তার এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের কথায়। ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের বিদ্রোহের পর তিনি বলেছেন, সম্প্রতি যা কিছু ঘটেছে তা সত্ত্বেও রাশিয়া এবং ওয়াগনার আফ্রিকায় থাকবে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিকে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের আরেকটি হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন পুতিন। তবে, এখনও সব দেশের সাথে এই সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে আফ্রিকার সাথে রাশিয়ার মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই সম্পন্ন হয়ে থাকে মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, তিউনিসিয়া, উগান্ডা, আইভরি কোস্ট ও কেনিয়া- এই ১০টি দেশের সাথে। বাকি দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনও ন্যূনতম পর্যায়েই রয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে আফ্রিকা মহাদেশে রাশিয়ার ‘সফট পাওয়ার’-এর ঘাটতিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পর থেকেই আফ্রিকায় রাশিয়ার ‘সফট পাওয়ারের’ মারাত্মক ঘাটতি শুরু হয়। রুশ নেতৃত্বের প্রতি সাব-সাহারান অঞ্চলের দেশগুলোর আস্থা ২০২১ সালের ৪৫ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ৩৫ শতাংশে নেমে আসে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট খাদ্য সংকট আফ্রিকার অনেক দেশের সরকারকে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ওপর ক্ষুব্ধ করে তোলে।
কয়েক মাস আগে সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে অনুষ্ঠিত ‘আফ্রিকা সম্মেলনে’ যোগ দিয়েছিল এই মহাদেশের ১৩টি দেশ। অথচ ২০২১ সালের ‘আফ্রিকা সম্মেলনে’ যোগ দিয়েছিলেন ৪০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। কিন্তু এবার যোগদানকারী দেশের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এই সম্মেলনে যোগদানকারী ১৩টি দেশের নেতারা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে দ্রুত ইউক্রেন-যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান পুতিনের প্রতি।
এ-কারণে পুতিন এ-সব নেতাকে খুশি করতে তাদের দেশে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেন। পুতিন তার দেশের ওপর আফ্রিকার নেতাদের আস্থার সংকট দূর করার চেষ্টা করার পাশাপাশি বিকল্প পন্থা হিসেবে সামরিক শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন। এ-ক্ষেত্রে ওয়াগনার বাহিনী তার বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
ওয়াগনার গ্রুপ ২০১৭ সাল থেকেই আফ্রিকায় তাদের তৎপরতা সম্প্রসারিত করে। সুদান, লিবিয়া, মোজাম্বিক, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও মালিসহ সংঘাত চলছে এমন বিভিন্ন দেশে তৎপর রয়েছে ওয়াগনার। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে বেশ কয়েক বছর ধরেই সক্রিয় সংগঠনটির সদস্যরা। তারা সেখানকার হীরার খনি পাহারা দিচ্ছে। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধেও ওয়াগনার গ্রুপের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওয়াগনারের একজন যোদ্ধার ফেলে যাওয়া একটি ডিজিটাল যন্ত্র থেকে এবং লিবিয়ার সেনা ও বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায় বলে জানিয়েছে বিবিসি।
নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পশ্চিমাপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজুমকে গৃহবন্দি করে ক্ষমতা দখল করে তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীর কর্মকর্তারা। পরে দেশটির ক্ষমতা গ্রহণ করেন অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী প্রেসিডেনশিয়াল গার্ডের প্রধান আবদুর রহমান চিয়ানি। অভ্যুত্থানের দুইদিন পর জান্তা সরকারের কয়েক হাজার সমর্থক রাজধানী নিয়ামিতে মিছিল করে। এ-সময় তারা রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষে ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক বলেছেন, নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানে রাশিয়ার হাত আছে। অন্যদিকে, ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন ‘উপনিবেশবিরোধী সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, নাইজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে ওয়াগনার গ্রুপ।
ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাজুমকে পুনর্বহালের আলটিমেটাম দেন পশ্চিম আফ্রিকার পশ্চিমাপন্থী দেশগুলোর অথনৈতিক জোট ইকোওয়াসের নেতারা। বাজুমকে পুনর্বহালে প্রয়োজনে নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপেরও হুমকি দেন তারা। এই হুমকি মোকাবিলায় ওয়াগনারের সহযোগিতা চেয়েছে জান্তা সরকার। অভ্যুত্থানকারীদের অন্যতম নেতা জেনারেল সালিফো মোদি সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ মালি সফর করেন। সেখানে তিনি ওয়াগনারের একজন প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করে সহযোগিতা চেয়েছেন।
মালির সরকার ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তার জন্য ওয়াগনারের দ্বারস্থ হয়। যদিও মালি সরকার কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এই গ্রুপের উপস্থিতির কথা স্বীকার করেনি। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও মালিতে রাশিয়ার এই ভাড়াটে যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, সুদানে ২০১৯ সাল থেকে নানা কাজে জড়িত আছে ওয়াগনার গ্রুপ। এর মধ্যে স্বর্ণখনিতে খননকাজ ছাড়াও আছে ইউরেনিয়াম অনুসন্ধান ও দারফুর অঞ্চলে ভাড়াটে যোদ্ধা পাঠানো। সুদানের নিরাপত্তা বাহিনীকে এক সময় প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে ওয়াগনার গ্রুপ। এছাড়া দেশটিতে সরকারের নেতাদের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছে তারা। মার্কিন অর্থ দফতর জানিয়েছে, ওয়াগনার গ্রুপ সেখানে আধাসামরিক অপারেশন চালানো, একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থন দেওয়া এবং প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের মতো কাজ করছে।
লিবিয়ার একটি মিলিশিয়া বাহিনীর মাধ্যমে সুদানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত বাহিনী আরএসএফ প্রধান জেনারেল হামদান দাগালোর কাছে অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে ওয়াগনার। আরএসএফ অবশ্য এক টুইট বার্তায় ওয়াগনারের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ থাকার কথা অস্বীকার করে জানিয়েছে, বরং সুদানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গেই ওয়াগনারের সম্পর্ক আছে।
কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, ওয়াগনার গ্রুপ ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহের জন্য বেশি পরিচিত হলেও এটি আসলে একাধিক কোম্পানির একটি নেটওয়ার্ক, যারা খনিজ সম্পদ উত্তোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারসহ নানা কাজ করে থাকে। সুদানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের আমলে দেশটির স্বর্ণ খনি পরিচালনায় ‘এমইনভেস্ট’ নামে একটি রুশ কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছিল সুদান সরকারের। মার্কিন অর্থ দফতরের অভিযোগ, এমইনভেস্ট ও তাদের সাবসিডিয়ারি গ্রুপ মেরো গোল্ড আসলে সুদানে ওয়াগনার গ্রুপের কার্যক্রমের আবরণ হিসেবে তৈরি করা দুটি কোম্পানি। এই দুটি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট।
সুদান হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ। এ-কারণে ওয়াগনারের মাধ্যমে সুদানের স্বর্ণ খনিগুলোতে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করেছে রাশিয়া। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সুদানে উত্তোলন করা স্বর্ণ স্থলপথে বহন করে প্রতিবেশী দেশ মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে ওয়াগনার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু স্বর্ণ রপ্তানির এই বিবরণ সুদানের সরকারি বাণিজ্যের তথ্যে উল্লেখ করা হয়নি।
ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় গত বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সুদানের সামরিক বিমানঘাঁটির একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্বর্ণের বড় চালান দেশটি থেকে বাইরে পাচার করা হয়। এভাবে ওয়াগনারের মাধ্যমে ১৩ হাজার কোটি ডলারের স্বর্ণের মজুত গড়ে তুলেছে রাশিয়া। এই পদক্ষেপ তাদের রুবলের মুদ্রামান ধরে রাখা এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় কাজে লাগছে।