ফ্রান্সের ৬০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নাইজারের মুক্তি মিলেছিল বটে, ১৯৬০ সালের পর ৬৩ বছর ধরে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটি ফরাসিদের করাল গ্রাস থেকে কখনও মুক্ত হয়নি। স্বাধীনতা পাওয়ার পরও পরাধীন থাকার কষ্ট কী, তা নাইজারের আড়াই কোটি মানুষের চেয়ে কে বেশি জানে! একদিকে স্বাধীনতা, অন্যদিকে দেশের সব খনিজ সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকরা, তা চেয়ে চেয়ে দেখলেও মুখ ফুটিয়ে বলতে পারেননি তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন সেই কথা শক্তভাবে বললেন। তিনি জেনারেল আবদুর রহমান চিয়ানি; অনেকে বলেন ওমর চিয়ানি।
রাষ্ট্রীয় প্রধানের প্রতি আনুগত্য কিংবা গণতন্ত্রের প্রতি চিয়ানির শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডের কমান্ড গ্রহণ করার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহামাদু ইসুফু-র আস্থাভাজন হয়ে ওঠেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে চিয়ানিকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এর পুরস্কারও দেওয়া হয়। ২০২১ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজুম ক্ষমতা গ্রহণের দুইদিন আগে একটি সামরিক ইউনিট প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চিয়ানির বীরত্বে সেই অভ্যুত্থান-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর চিয়ানিকে ওই দায়িত্বে বহাল রাখেন বাজুম। কিন্তু, দেশ যখন বিপর্যস্ত, খোদ প্রেসিডেন্ট যখন একান্ত নিজস্ব ও বিদেশিদের স্বার্থ হাসিলে বিভোর, তখন তো তিনি চুপ থাকতে পারেন না।
নাইজার বেশ বড়সড় দেশ; আয়তন সাড়ে ১২ লাখ বর্গকিলোমিটারের মতো। আয়তনের দিক থেকে বিশে^র ২২তম বৃহত্তম দেশ। কিন্তু, জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি। আফ্রিকার অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রও এটি। ৯৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অর্থনীতিতে ফসল ও পশুসম্পদের অবদান থাকলেও ইউরেনিয়ামের ওপর বিপুল নির্ভরতা রয়েছে তাদের। ইউরেনিয়াম উৎপাদনের দিক থেকে বিশে^র সপ্তম বৃহত্তম দেশ নাইজার। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ইউরেনিয়াম সরবরাহ করেন তারাই। এই খনিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার হলে তারা ধনী হতে পারতেন, কিন্তু সেটি বিভিন্ন কৌশলে হতে দেয়নি ইউরোপ, বিশেষত ফ্রান্স। নিজেদের ইউরেনিয়াম নিয়ে ফ্রান্স আলোকিত হয়েছে, আর তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত থেকেছেন যুগের পর যুগ।
ফ্রান্সকে এই কাজে অন্যায্য সহায়তা দিয়েছেন শাসকরা। দেশের স্বার্থ দেখার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা যদি বিদেশিদের স্বার্থকেই দেবতাজ্ঞান করেন, সেই শাসক তখন ভয়ঙ্কর। নাইজারের সে-রকম একজন শাসকের নাম নাম মোহাম্মদ বাজুম। ২০২১ সালে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসে তিনি যে ফ্রান্সের স্বার্থ দেখা শুরু করলেন, একসময় সেটিই তার প্রধান দায়িত্বে পরিণত হলো। ফ্রান্স যা বলে, বাজুমও তা-ই করেন।
জনগণ একসময় বুঝে গেল, শাসক তাদের সঙ্গে প্রতারণ করছেন। তারা ফরাসিদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়লেন। কিন্তু বাজুম কঠোর হাতে তাদের দমন করতে থাকলেন। তার একসময় মনে হলো, ফ্রান্সকে নিজের পক্ষে রাখতে পারলেই তো লাভ! নাইজারের গরিব মানুষ কী আর করবে! পরাশক্তির ছায়ায় আশ্রয় নেওয়ার বৈশি^ক প্রবণতা তাকেও পেয়ে বসল। কিন্তু, তুষের আগুনের মতো জ¦লতে থাকলেন প্রভাবশালী প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডের প্রধান ৬২ বছর বয়সী জেনারেল চিয়ানি। এ-বছরের ২৬ জুলাই প্রেসিডেন্টকে গৃহবন্দি করার দুইদিন পর তিনি ঘোষণা করলেন, ‘সংবিধান স্থগিত; নাইজারের মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভার কাঁধে তুলে নিতে চাই আমি।’
নিজেকে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর দ্য সেফগার্ড অব দ্য হোমল্যান্ড-এর নেতা ঘোষণা করে চিয়ানি বললেন, ‘পবিত্র বাসভূমি রক্ষার দায়িত্ব নিলাম।’ দেশের অবধারিত পতন এড়াতে সেনা হস্তক্ষেপের বিকল্প ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাজুম দেশের কঠোর বাস্তবতা আড়াল করেছেন। বাজুম মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। তবে কঠিন বাস্তবতা হলো, দেশে মৃত্যু, বাস্তুচ্যুতি, অপমান ও হতাশার পাহাড় জমেছে।’
এই পদক্ষেপে সেনাবাহিনী তাকে সমর্থন জানাল। দেশের মানুষ বুঝল, সেনাশাসনের চেয়ে নিশ্চয়ই গণতন্ত্র ভালো; কিন্তু সেই গণতন্ত্র যখন বিদেশিদের স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন সেই গণতন্ত্র শব্দকে আক্ষরিকভাবে অর্থবহ করার পথে খাকি পোশাকের লোকজনকে দায়িত্ব নিতে হয়। এই সাময়িক সময়ের জন্য সামরিক শাসনের চেয়ে ভালো কিছু নেই; এই উদাহরণ পৃথিবীতে অনেক।
পুরো দেশে প্রশংসায় ভাসতে থাকলেন চিয়ানি। স্লোগান চলতে থাকল- জেনারেল চিয়ানি, জিন্দাবাদ। তার পক্ষে রাস্তায় নেমে গেল জনতা। লাখ লাখ মানুষের মিছিল আর সমাবেশ। কারও হাতে চিয়ানির প্রশংসা-সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, কারও হাতে রাশিয়ার পতাকা, কারও গায়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ছবিসহ টি-শার্ট। চিত্রটা স্পষ্ট হলো- এই পালাবদলের পেছনে পূর্ব-পশ্চিম রাজনীতিও কাজ করেছে। চিয়ানির পক্ষে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক কিংবা আলজেরিয়া তো আছেই, সঙ্গে আছে প্রতিবেশী মালি ও বুরকিনা ফাসো। বেশ শক্ত একটা বলয়।
পশ্চিমা দেশগুলোর এবার প্রতিবাদে ফেটে পড়ার পালা। তা-ই হলো। সামনে থাকল ফ্রান্স; কারণ, মূল স্বার্থ তো তাদের। তারা গণতান্ত্রিক শাসকের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জেনারেল চিয়ানিকে চাপ দিতে থাকলেন। কিন্তু চিয়ানি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। সাফ জানিয়ে দিলেন, বাজুমের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন না তিনি।
এবার ফ্রান্সের মদতপুষ্ট পশ্চিম আফ্রিকার ১৫ দেশের অর্থনৈতিক জোট ইকোওয়াস দাঁড়িয়ে গেল জেনারেল চিয়ানির বিরুদ্ধে। নাইজারের সঙ্গে আকাশপথ বন্ধ করে দিলেন তারা। যথারীতি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে জোটের তরফে বৈঠকের পর বৈঠক হলো। তারা আল্টিমেটাম দিয়ে বললেন, সাত দিনের মধ্যে বাজুমের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে না দিলে সামরিক হস্তক্ষেপ হবে। কিন্তু, চিয়ানি জানিয়ে দিলেন, সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে তিনি প্রস্তুত। তিনি এটাও বললেন, এ-ধরনের হস্তক্ষেপ হলে গোটা আফ্রিকায় সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়বে। মালি ও বুরকিনা ফাসো বলল, নাইজারে যদি হামলা হয়, ধরে নেব, আমাদের দেশেই হামলা হয়েছে। পরিস্থিতি জটিল দেখে পিছু হটল ইকোওয়াস।
ততদিনে পুরো পরিস্থিতি জেনারেল চিয়ানির পক্ষে; মানে, জনগণের পক্ষে। জনগণ ভাবল, যে ডাকাতদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি, তাদের তাড়াতে চূড়ান্ত পদক্ষেপে যেতে হবে। তারা ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সিলভাইন ইত্তে এবং সেনাদের নাইজার থেকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানালেন। ফ্রান্স কথা শুনল না। এরপর ফরাসি দূতকে ৪৮ ঘণ্টার সময় দিলেন চিয়ানি। জনগণও স্লোগান দিতে দিতে ফরাসি দূতাবাস ঘেরাও করল। দূতাবাসের সামনে স্রোতের মতো জড়ো হতে থাকলেন তারা। ফরাসি সেনা ও রাষ্ট্রদূত নাইজার না ছাড়লে তাদের দূতাবাস ও সামরিক ঘাঁটিতে হামলার হুমকিও দেন তারা।
সেনা ও জনতার সম্মিলিত পদক্ষেপের কী অদ্ভুত শক্তি! কিছুদিন আগে যাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে একটি শব্দও উচ্চারণ করা যায়নি, সেই ফরাসি দূতাবাসের বিদ্যুৎ, পানিসহ জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দিল সামরিক সরকার। শুধু তাই নয়, বাইরে থেকে দূতাবাসে কোনো খাবারও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। জিন্দারে অবস্থিত ফরাসি কনসুলেটেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
একসময় রাষ্ট্রদূত ও সেনাঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো ফ্রান্স। ২৫ সেপ্টেম্বর অসহায়ের মতো ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বললেন, রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রদূত ও কয়েকজন কূটনীতিক দেশে ফিরে আসবেন। আগামী কয়েক মাসে নাইজার থেকে ফরাসি সেনাদেরও প্রত্যাহার করা হবে।
ম্যাক্রোঁর ঘোষণার পর নাইজারে খুশির জোয়ার বইয়ে গেল। জাতীয় টেলিভিশনে সেনাশাসকদের একটি বিবৃতিটি পড়ে শোনানো হয়। এতে বলা হয়, ‘সার্বভৌমত্বের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল নাইজার। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা নাইজারের জনগণের তীব্র আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রতিধ্বনিত করে।’
জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতীক চিয়ানি সেনাসদস্য থাকাকালে দেশের জন্য বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডের কমান্ডার হওয়ার আগে ভয়ঙ্কর মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। একটি ঘটনার পর তিনি নাইজারের জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ঘটনাটি ১৯৮৯ সালের। তেনেরে মরুভূমিতে ফ্রান্স এয়ারলাইন্সের ইউটিএ ফ্লাইট-সেভেন সেভেন টু বিধ্বস্ত হয়ে ১৭২ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। দুর্গম ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চিয়ানি। তিনি ছিলেন ঘটনাস্থলে পৌঁছা প্রথম সেনা-কর্মকর্তা। এজন্য তাকে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল। আইভরি কোস্ট, সুদান ও কঙ্গোতে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করার সময়ও তার বীরত্ব স্বীকৃতি পেয়েছে।
দেশের বিপদে বারবার এগিয়ে এসেছেন এই সাহসী জেনারেল। শেষ পর্যন্ত বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ও লুটপাট বন্ধ করতে শক্তহাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত এই জেনারেলের আশ্রয়ে জনগণ আশায় বুক বাঁধছে, খনিজসম্পদে ভরপুর এই দেশ নিশ্চয়ই একদিন সমৃদ্ধ হবে।