শেখ হাসিনার পতন ও পলায়ন নিজের হাতেই তৈরি

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১০

 বাংলাদেশে কয়েক সপ্তাহের প্রবল সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগষ্ট পদত্যাগ করে ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই আন্দোলনে শত শত ছাত্র জনতা নিহত হওয়ার পরও একেবারে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ক্ষমতার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। বিক্ষোভকারি ছাত্ররা প্রথমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করার ও পরবর্তীতে তার পদত্যাগের একদফা দাবিতে অনড় অবস্থান নেন। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে পরাজয় মেনে নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তার এই পরিনতি তার নিজের অর্জনেরই ফল বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। আল জাজিরায় বিশ্লেষনের আেলাকে বিস্তারিত থাকছে মোতালেব জামালীর প্রতিবেদনে।
ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভের মুখেও শেখ হাসিনা কোন আপোষ করতে রাজি ছিলেন না। তিনি বিক্ষোভ দমনে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া বিশেষ সুবিধাভোগি শ্রেনীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণে দেশের সাধারণ মানুষের সাথে শেখ হাসিনার সরকারের কোন সম্পর্ক ছিল না। বরং অনেক আগেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সরকার।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন যে তিনি হারিয়ে ফেলছেন সে সম্পর্কে সম্ভবত কোন ধারণাই ছিল না শেখ হাসিনার। তবে একেবারে শেষ মুহুর্তে তার বোধোদয় ঘটলেও তখন ক্ষমতা থেকে সরে দাড়ানো ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। তার সরকারের ১৬ বছরের শাসনের লজ্জাজনক অবসান একদিকে বিশ^ব্যাপি স্বৈরশাসকদের করুণ পরিণতির কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে একটি জাতির মোহভঙ্গ হওয়া যুব সমাজের ইচ্ছাশক্তি যে কতটা প্রবল হতে পারে তার প্রমানও শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর মধ্য দিয়ে আবার নতুন করে দেখা গেল।

পরিহাসের বিষয়, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাসন থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশের যুব সমাজের সমর্থন পেয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন শেখ হাসিনা।

তার সরকারের প্রথম মেয়াদে যুব সমাজের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদেও বির্তকিত বিচার করেন। এ সময় অনেক বিরোধী নেতাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে তা দ্রুতই কার্যকর করা হয়। অথচ নিজের দলের একই অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাদেরকে তিনি রক্ষা করেছেন।

২০১৩ সালে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচি ভন্ডুল করতে নির্মম দমন অভিযান চালায় সরকার। এতে অসংখ্য মাদ্রাসা ছাত্র প্রান হারান। পিছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি সতর্কবার্তা। কিন্তু তা সত্বেও এদেশের মানুষ শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকেই সমর্থন দিতে থাকে। কারণ তিনি মানুষকে দেশে নতুন নতুন বৃহৎ অবকাঠামো তৈরি ও ঘরে ঘরে চাকুরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা তার পারিবারিক ট্রাজেডি ও তার নিজের উপর হামলার ঘটনার ইস্যুগুলোকে কাজে লাগানোর বা ব্যবহারের ন্দিুমাত্র সুযোগ হাতছাড়া করেননি। ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা নিহত হন। এসব ইস্যুকে তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরে কান্নয় ভেঙ্গে পড়তেন। তার এই কান্না মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিত এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাকে সমর্থন জানাতেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে এদেশের যেসব মানুষ সহযোগিতা করেছে তাদেরকেই ‘রাজাকার’ হিগসেবে অভিহিত করা হয়। ষেখ হাসিনা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সর্বদাই এই ইস্যুটিকে তার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। তিনি বক্তব্য দেয়ার সময় প্রায় সময়ই তাদেরকে রাজাকারের বংশধর বলে গালি দিতেন।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরীতে কোটা সিস্টেম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে আন্দোলনকারিদেরকে তিনি রাজাকারের সন্তান আখ্যা দিলে তা মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আন্দোলনকারি শিক্ষার্থীরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাওয়ার আহবান জানান। কিন্তু তিনি তা করতে মোটেই ইচ্ছুক ছিলেন না। এমনকি তার মন্তব্য যে শিক্ষার্থীদের মনে আঘাত দিয়েছে সেকথাটিও স্বাীকার করতে চাননি শেখ হাসিনা।

জনগণ কি চায় তা শুনতে বা জানতে শেখ হাসিনার অস্বীকৃতি তার দীর্ঘ দিনের সুদৃঢ় রাজনৈতিক বিশ^াসেরই অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে হিসেবে তিনি নিজেকেও সকল কিছুর উর্ধে রেখে একজন দেবির মতো ও গনতন্ত্রের মানস কন্যা হিসেবে বিবেচনা করতেন। শেখ হাসিনা কোন বিষয়ে আপোষ করাটাকে মারাত্মক দুর্বলতার চিহ্ন হিসেবেই মনে করতেন।

গত ১৫ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় থেকে তিনি নিজের আপোষহীন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছেন বলে মনে করতেন। কাজেই কোন ক্ষেত্রে আপোষ করাটাকে তিনি সেই ব্যক্তিত্বকে খাটো করার শামল বলেই ভাবতেন। এমনকি ক্ষমতার উপর থেকে তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ যখন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাচ্ছিল, তখনো হাসিনা মনে করতেন , তার পারিবারিক ঐহিহ্য এবং নিজের অনুগত কট্টর সমর্থকরাই কোন বিষয়ে আপোষ করা বা ছাড় দেয়া থেকে তার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।

ক্ষমতা থেকে শেখ হাসিনার লজ্জাজনক বিদায় ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা তার নিজের হাতেই তৈরি করা। সর্বাত্মক ক্ষমতার মোহের কারণে তিনি দেশে ও বিদেশে তার মিত্র ও বন্ধুদেরকেও হারিয়েছেন। যাদেরকে তিনি নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি সব সময়ই লেগে থাকতেন।

এ কারণেই তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসকে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মী, লেখক ও বুদ্ধিজীবিকে হয় কারাদন্ড প্রদান অথবা গুম করা হয়েছে। এমনকি তার প্রতি সহানুভূতিশীল যেসব ব্যক্তি সরল বিশ^াসে তাকে সুপরামর্শ দিতেন তাদেরকেও তিনি নানাভাবে হেনস্তা করতেন। এ কারণে শেখ হাসিনার এই শাসনামলকে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে এক সময় সেই সব দেশের জন্য মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হতো যেসব দেশ তাদের প্রতিবেশিদের সাথে প্রতিযোগিতা করে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে না রেখে পুরোপুরিই ভারতের অক্ষে নিয়ে যাওয়ায় চীনকে অসন্তুষ্ট করে তোলে ।

শেখ হাসিনা ব্যাপকভাবে গনতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মানবাধিকার লংঘন করতে থাকায় পশ্চিমা দেশগুলোও তার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই হাসিার সরকারের প্রতি তাদের অখুশি থাকার বিষয়টি তুলে ধরতে থাকে। গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা ও দুর্নীতির সাথে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের উপর ২০২৩ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাইডেন প্রশাসন।

কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় হাসিনা উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নানা ধরণের সমালোচনা করে বক্তব্য দিতে থাকেন। বাইডেন প্রশাসন নিজেই তার দেশের জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশে শুরু হওয়া কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহন করায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাসিনার সরকারের কুটনৈতিক বিরোধ বাড়তে থাকে।

হাসিনা ভেবেছিলেন চলমান ছাত্র আন্দোলন দমনে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করলে তাতে কাজ হবে, কারণ অতীতে এধরণের পদক্ষেপ ফলপ্রসু হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে তার বিরুদ্ধে ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের ক্ষোভ তাদের মনের কতো গভীরে পুঞ্জিভূত হয়েছিল তা তিনি মোটেই ধারণা করতে পারেননি। একারণে চলমান ছাত্র আন্দোলন দ্রুতই গণআন্দোলনে রুপ নেয় যা জেনারেশন জেড রেভ্যুলুশন হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া হাসিনা আন্দোলন দমনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা এর বিরুদ্ধে ছিলেন। ব্যাপক রক্তপাত এড়াতে তারা তাকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। হাসিনার ছেলে পরে জানিয়েছেন , তার মা ক্ষমতা ছাড়তে মোটেই রাজী ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিবারের সব সদস্যদের চাপের মুখে ক্ষমতা থেকে সরে দাড়াতে রাজী হন। এভাবেই তিনি হয়তো নিজেকে শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিক পরিনতির হাত থেকে রক্ষা করেছেন। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়াই ছিল তার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা।

শেখ হাসিনার সরকারের পতন কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশে^র অন্যান্য দেশের গনতন্ত্রকামী জনগণ ও কর্তৃত্ববাদী শাসকের মধ্যে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। যারা গনতন্ত্রকামী জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে স্তব্ধ করে দিতে চায় তাদের মুখে বাংলাদেশের তরুন ও যুবসমাজ কড়া চপেটাঘাত করেছে।

বিশে^র যেসব স্বৈরশাসক মনে করেন যে, ক্ষমতার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কোনদিনই শিথিল হবে না, তাদের জন্য বাংলাদেশের ছাত্রদের এই বিজয় একটি শক্তিশালী বার্তা। এই বিজয় বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।