জুলাই মাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দমন করতে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর পর থেকেই এ বাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বাহিনীর মধ্যে চলমান এ ক্ষোভ প্রশমনে ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান এক বৈঠকের আয়োজন করেন। এ বৈঠকে সেনা মোতায়েনের পক্ষে বেশ কিছু যুক্তিও দেন তিনি। একই সঙ্গে কয়েক জন জুনিয়র কর্মকর্তাকে তাদের অবস্থান প্রকাশেরও সুযোগ দেন।
ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় মেজর থেকে কর্নেল র্যাংকের একের পর এক কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাব তুলে ধরেন। সেনা প্রধান বৈঠকের শেষে জানান, সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগনের সঙ্গে থাকবে। ওই বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা যায় এ তথ্য।
এই বৈঠকের মাত্র দুই দিনের মাথায় টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার খবর ঘোষনা করেন সেনাপ্রধান।
সেনাবাহিনীর তরুণ প্রজন্মের কর্মকর্তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং জনগণের সেন্টিমেন্টের গতি প্রকৃতির ওপর নজর রাখছিলেন। তারাই তাদের সিনিয়র কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে অবহিত করেন। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর জেনারেল নাইম আশফাক চৌধুরী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
শেখ হাসিনার এক চাচাতো বোনের স্বামী সেনা প্রধান ওয়াকার। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, তিনি এই স্বৈরাচারি নেত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মানুষ। সংকট বাড়তে শুরু করলে সেনাবাহিনীর মধ্যে একধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। সেনা প্রধান বুঝতে পারেন পুরো দেশের মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত ঐক্য স্থাপিত হয়েছে। মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে হাসিনার অজন প্রিয়তার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে যায়। একই সঙ্গে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের তীব্র সমালোচনার বিষয়টিও তার মাথায় ছিল।
এ সময় থেকেই সেনাবাহিনী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলতে শুরু করে। পরে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিও তাদের সর্বোচ্চ সমর্থনের কথা জানান।
আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের সহানুভূতি এবং আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সেনাবাহিনী পর্দার আড়ালে থেকে তাদের ভূমিকা পালনে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা আর সরাসরি সরকার পরিচালনায় আসেনি। এবারের আন্দোলনে এক সময় সেনাবাহিনী ঘুড়ে দাঁড়ায় এবং ছাত্র- জনতার পক্ষে অবস্থান নেয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে আদালতের একটি রায়ের পর গত জুলাই মাসে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। সরাকারি চাকরির ব্যাপারে বাংলাদেশি তরুণদের আগ্রহ সীমাহীন। এর একটি বড় কারণ দেশটিতে তরুণ বেকারের হার এক গণনা করা হয় দুই অংকের সংখ্যায়। সরকার শক্ত হাতে এই আন্দোলন দমনের চেষ্টা চালায়। যা শেষ পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে একটি গণ অভ্যূত্থানে পরিণত হয়। যার চূড়ান্ত ফল হিসেবে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।
মধ্য জুলাই থেকে তীব্র হয়ে ওঠা এ আন্দোলনে সহস্রাধিক মানুষ নিহত হন। একজন সেনা কর্মকর্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানান, ক্ষমতাসীনদের রক্ষায় আরও রক্ত ঝরাতে রাজি ছিলেন না সেনাপ্রধান। ৪ আগস্ট তিনি পদত্যাগের ব্যাপারে হাসিনাকে রাজি করানোর চেষ্টা শুরু করেন। আর এর প্রধান কারণ ছিল হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা।
এক্ষেত্রে ওয়াকারকেও অত্যন্ত কৌশলে এগুতে হচ্ছিল। কারণ সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের হাসিনা অনুগতদের সংখ্যাও কম ছিল না।
বর্তমানে ইউনুস সরকারের সামনেও বহু চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও ভঙ্গুর। পুলিশ এবং সরকারি আরও বহু সংস্থার কর্মকর্তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ২৫ আগস্ট থেকে সচিবালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনা মোতায়েন করা হয়। ওই দিনই চাকরি জাতীয়করন ও বেতন বাড়ানোর দাবিতে আনসার সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়।
ঢাকার একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান মনে করেন, সেনাবাহিনী এখন পেছনের আসনে চলে গেছে। তারা চায়, শিক্ষার্থী সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারই এই দেশ পরিচালনা করুক। তবে যতোই দিন যাচেছ তাদের এই সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানসহ অন্য ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব রয়েছে তা শিক্ষার্থীরাই করে দেবে এমনটা আমরা আশা করতে পারি না। নিরাপত্তা পারিস্থিতি আরও খারাপ হলে সেনা হস্তক্ষেপ হয়তো আরও বাড়বে।
অনেকেই মনে করেন, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে চায় না। কারণ তারা মনে করে, এই বিষয়টি দেশে-বিদেশে সুনজরে দেখা হবে না। মার্শাল ল জারি করার পরিকল্পনা নেই তাদের।
ড. ইউনূস বিশ^জুড়ে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। সেনা বাহিনী চায়, ড. ইউনূসের ইমেজকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেঙে পড়া সম্পর্ক মেরামত করে নিতে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সেনাবাহিনী সেই অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একটি যারা নূন্যতম মাত্রার স্বাধীনতা উপভোগ করেছে। যদিও সমালোচকরা বলছেন, এই বাহিনী উর্ধ্বতম প্রায় সব কর্মকর্তাই আ্ওয়ামী লীগের অনুমোদনপুষ্ট।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে কালো তালিকাভুক্ত করে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিয্গো রয়েছে। তবে এই সেনা কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা বলে নাকচ করে দেন।
এর আগে ২০২১ সালে যক্তিরাষ্ট্র র্যাবকে কালো তালিকার অন্তর্ভূক্ত করে। র্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ রয়েছে। গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যা এই বাহিনী চালাতো বলেই অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরে। ্ওই সময় বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন দাবি করে, এই নিষেধাজ্ঞা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।
ইতোমধ্যে সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারনের নেতৃত্বে একটি ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের কাজ হবে, হাসিনার আমলে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনার তদন্ত করা।
সামরিক বাহিনীর গনসংযোগ অধিদপ্তর ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স জানায়, এই কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দেবে সেনাবাহিনী। এক সেনা মুখপাত্র জানান, দোষি সাব্যস্ত হলে তিনি যেই হোন না কেন তাকে আইন অনুসারে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, বিক্ষোভে কঠোর ব্যবস্থা না নিতে সেনাবাহিনীর প্রতি জাতিসংঘের তরফ থেকে এক ধরনের চাপ ছিল। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তাদের বড় ধরনের অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে একে একটি লোভনীয় সুযোগ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কারণ এতে উচ্চহারে অর্থ সংযোগের সুযোগ রয়েছে।
জুলাইয়ের শেষ দিকে জাতিসংঘের লোগো আঁকা সাঁজোয়া যান দেখা যায় ঢাকার রাস্তায়। বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তর। হাসিনার পদত্যাগের মাত্র একদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র, বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জাতিসংঘও বিক্ষোভ দমন করতে সরকারের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার তুর্ক।
এ সময় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাও সেনাবাহিনীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান। তবে তার আগেই বিক্ষোভ দমনে মোতায়েন করা সেনা সদস্যদের ভূমিকায় চোখে পড়ার মতো পার্থক্য পরীলক্ষিত হয়। ঢাকার আইনের একজন ছাত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানান, বিক্ষোভের পুরো সময় তিনি রাস্তায় ছিলেন। তিনি বলেন, সেনা সদস্যরা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তারা পুলিশের সঙ্গে টহলে যোগ দিতেন না।
৪ আগস্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার সমর্থকদের উদ্দেশে এই আন্দোলন প্রতিহত করার আহ্বান জানায়। তারা মনে করে, এটা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরও শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। পুলিশ না থাকায় সে সময় দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
৪ আগস্টের রাতে এক উর্দিপরা নৌ বাহিনীর এক কর্মকর্তা ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি তার সহকর্মীদের এই বিক্ষোভে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যথেষ্ট হয়েছে। এবার সবাই মিলে প্রতিরোধ করতে হবে।
৫ আগস্ট যখন লাখো ছাত্র জনতা প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দিকে রওনা হন তখনও রাস্তায় সেনা মোতায়েন ছিল। ওই দিন অনেকেই সেবা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়েছেন। তার ফুল বা পানি দিয়েছেন। তবে এটা স্পষ্ট ছিল সেনা সদস্যদের মনোভাব পাল্টেছে। তবে দুপুর গড়াতে গড়াতেই সেনা সদস্যরা একপাশে সরে যায়। জনতা ব্যারিকেড সরিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। এর মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এাঁ ছিলো বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। নানা অনিশ্চয়তার পর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় তারা।