আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে ভারত নিজেকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে মনে করে, বাস্তবতা বলে, সেরকম কিছু অতীতেও ছিল না, এখনো তা হতে পারেনি। ১৯৫০-এর দশক এমনকি ১৯৯০ এর দশকের চেয়েও ভারত এখন অনেক বেশি অসুবিধাজনক অবস্থানে আছে। ভারতের আগের পররাষ্ট্রনীতির ভুলত্রুটি ও পদক্ষেপ নিয়ে অতীতে নানা ধরনের সমালোচনা হতো। সেসব ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির শুরু থেকেই একই ধরণের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। একারণে দেশটিকে বিভিন্ন সময়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। আর এর ফলে নিজের স্বার্থকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে দিল্লি। এক্ষেত্রে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বিষয়টিকে সামনে আনা যায় বলে মনে করেন ভারতের অনেক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজেশ রাজাগোপালান।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক রাজেশ রাজাগোপালানের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে সম্প্রতি দেশ দুটি সফর করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জটিল এই সংকট সমাধানে ভারত একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ভাবে নিজেকে এতে যুক্ত করেছে। কিন্তু দুতিয়ালি করতে গিয়ে ভারত যে কোন পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য। বরং এতে ভারতের স্বার্থই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুদ্ধ অবসানের এই দুতিয়ালীতে মোদি প্রথমে যান রাশিয়ায়। তার এই সফর ছিল খুবই ঝুকিপূর্ণ। কারণ ছোট্ট প্রতিবেশি দেশ ইউক্রেনে অব্যাহতভাবে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। অথচ মস্কো অনেক আগেই সরকারিভাবে ইউক্রেনের ভৌগলিক সীমানাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই দেশটির ভূখন্ড দখল করার এমন এক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া যেখানে প্রতিনিয়ত বর্বরতার স্বাক্ষর রাখছে দেশটি।
অধ্যাপক রাজেশ রাজাগোপালানের মতে, এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদির এই সফরের উদ্দেশ্যই অস্পষ্ট এবং তা ভারতের জন্য কোন সুফলই বয়ে আনবে না। বরং এটা ভারতের প্রকাশ্যেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের পক্ষে দাড়ানোর নজির হয়ে থাকবে। কারণ পুতিনের পাশে দাড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিয়ে মোদির পক্ষে ইউক্রেনের নারী-শিশুদের উপর রুশ বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকান্ডের সমালোচনা করা নরেন্দ্র কোনভাবেই সম্ভব হয়নি।
মস্কো থেকে মোদির ইউক্রেন সফর করা কার্যত বিবদমান কোন পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। রাজধানী কিয়েভে মোদির উপস্থিতি খুব একটা উল্লসিত করেনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে। তিনি যুদ্ধ অবসানে মোদির উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও চলতি বছরের শুরুর দিকে সুইজারল্যান্ডে আয়োজিত প্রথম শান্তি সম্মেলনের চুড়ান্ত ঘোষণাপত্রে ভারতের স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানানোর বিষয়টিকে সামনে টেনে আনতে ভুলেননি জেলেনস্কি। এই শান্তি সম্মেলন থেকে সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টি সেরকম কিছু ছিল না। কিন্তু এরপরও দুই নৌকায় পা দিয়েছিল ভারত। একদিকে তারা শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল, আবার একইসাথে সম্মেলনের চুড়ান্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতেও অস্বীকার করেছিল ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দক্ষতা দিয়ে দেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হতো সেটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আত্মস্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজন অন্যকে কনভিন্স করা, নিজে সন্তুষ্ট হওয়া নয়। মৌখিক বক্তব্য বা কথা বলার দক্ষতা যদি শ্রোতাকে আকৃষ্ট বা কনভিন্স করতে না পারে তাহলে সেই দক্ষতার কোনই মূল্য নেই।
পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষতার সাফল্যের মানদন্ড কেবল নিজেদের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে নিজেরাই সন্তুষ্ট হওয়া নয়। কিন্তু দূ:খজনকভাবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে এ বিষয়টি প্রায় সময়ই ভুলে যান নীতিনির্ধারকরা। একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ভারতের ইউক্রেন নীতিতে অতীতের ভুলগুলোর বেশ কয়েকটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
ভারত ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর পরিবর্তে দিল্লি বরং প্রায় একই সময়ে সুয়েজ খালে ব্রিটিশ-ফরাসি ও ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় যা ছিল একেবারেই পরস্পরবিরোধী একটি পদক্ষেপ। ফলে এই সিদ্ধান্ত ভারতের জন্য কোনই সুফল আনেনি। এরপর ভারত তার লাইন পরিবর্তন করে হাঙ্গেরিতে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর আধাআধি একটি সিদ্ধান্ত নিলেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে ভ্রান্তি বিলাসের আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে কুয়েতে ইরাকের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই অবস্থান নেয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের প্রতি সমর্থন জানায় ভারত। আন্তর্জাতিক কুটনীতির ইতিহাসে এ ধরণের নির্বোধ সিদ্ধান্ত আর দ্বিতীয়টি নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক রাজেশ রাজাগোপালান।
সম্প্রতি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, দক্ষিন এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ দিল্লিকে এখন একঘরে করে ফেলেছে। বাংলাদেশে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র শেখ হাসিনার পতন নয়াদিল্লির ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা সবার আগে প্রতিবেশী পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন ভারতীয় ও পশ্চিমা কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর চীনের প্রভাব বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের অ্যাডজাংক্ট ফেলো নীলান্থি সমরনায়েকের মতে, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ধরনটিকে জটিল করে তুলেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে দিল্লির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘস্থায়ী মিত্র ছিলেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতা থেকে তার করুণ বিদায় আঞ্চলিক সম্পর্কের কাঠামোকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। বাংলাদেশ এখন একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচনের আগে সেই প্রক্রিয়া শেষ হতে যথেষ্ট সময় লাগবে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভারতের সমর্থনের প্রয়োজন হবে।’ নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের ‘নেবাবারহুড ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করেন। বলা হয়, এ নীতির উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক জোরদার করা। কিন্তু বাস্তবে মোদির এই আধিপত্যবাদী নীতি বর্তমানে দক্ষিন এশিয়ায় ভারতকে একঘরে করে ফেলেছে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও সর্বশেষ বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন তলানীতে এসে ঠেকেছে।
সম্প্রতি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জামায়াতে ইসলামী ভারতের পরিবর্তে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। আবার প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দিক থেকে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বেশ জোরালো।
গত মে মাসেও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছিল চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। ২০১৯-২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল চীনা অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা দেশ। এ সময় চীনের মোট অস্ত্র রফতানির প্রায় ১১ শতাংশই এসেছে বাংলাদেশে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের নিবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের জন্য আঞ্চলিক কূটনীতিতে চাপের মাত্রা বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটে সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল ভারত। কিন্তু এর পরই দেশটি সেখানে চীনের একটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প আটকে দেয়। একই সঙ্গে নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে শ্রীলংকায় চীনা গবেষণা জাহাজের নোঙর ফেলা নিয়ে আপত্তিও তোলে দিল্লি। আবার এর মধ্যেই নরেন্দ্র মোদি ভারতের সর্বশেষ নির্বাচনের আগে শ্রীলংকার কাচাথিভু দ্বীপের ওপর নয়াদিল্লির অধিকার দাবি করে বসলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু নির্বাচনে জয়লাভের আগে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে শুরুতেই তিনি ভারতীয় সৈন্যদের মালদ্বীপ থেকে বহিষ্কার করেন। একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করেন। নেপালেও চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত কে পি শর্মা অলি প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে এসেছেন। আবার আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটির সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে।
নীলান্থি সমরনায়েকের মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ও শক্তির সমীকরণে বরাবরই নিজেকে দুর্বল অবস্থানে দেখেছে শ্রীলংকা। বন্দরে নোঙর করা জাহাজের সংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে দেশটির রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু শুধু চীনা জাহাজ নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণে তারা বন্দরে গবেষণা জাহাজ নোঙর করার ওপর ১২ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দিতেও রাজি ছিল।
তবে চলতি মাসে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে আরেকটু অনিশ্চয়তা যোগ করতে পারে। কারণ বামপন্থী দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার অ্যালায়েন্স বা এনপিপির সম্ভাব্য বিজয় শ্রীলংকার পররাষ্ট্রনীতির গতিপথকে যথেষ্ট অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিতে পারে।
ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ও গবেষক নাতাশা আগরওয়াল মনে করেন, চীনের মতো ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, প্রতিবেশীদের প্রতি দিল্লির দৃষ্টিভঙ্গি অহংকারে পূর্ণ। এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ঠেকাতে গেলে ভারতকে তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতিতে সামঞ্জস্য আনতে হবে বলে জানিয়েছেন নাতাশা আগরওয়াল।