সেভেন সিস্টার্সে মোদির কৌশল কাজ করছে না

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৪

ভারতে মোদি ও তার দল বিজেপি যে মন্ত্র নিয়ে বারবার ক্ষমতায় আসছে, তার অন্যতম হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ বা হিন্দুত্ববাদী চেতনা। এই আদর্শের উগ্র সমর্থকরা ভারতে একটি হিন্দু ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে হিন্দুদের চাওয়া-পাওয়া ও আশা-আকাক্সক্ষাই অগ্রাধিকার পাবে। নরেন্দ্র মোদির সরকার ও বিজেপির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ ভারতের মুসলমানদের পাশপাশি দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যে বসবাসরত উপজাতীয় গোষ্ঠিগুলোর ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে মণিপুর রাজ্যে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান কুকি উপজাতীয় জনগোষ্ঠির সাথে সংখ্যাগুরু মেইতেই হিন্দুদের চলমান সংঘাত বিজেপির এই হিন্দুত্ববাদী চেতনারই ফসল।

মোদির গত এক দশকের শাসনামলে ভারতের মুসলমানদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন আগের চেয়ে বেড়েছে বহুগুনে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত ১৪ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতে চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৬৩ শতাংশ ভাষণ ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টিকারী।

গত ১৬ মার্চ নির্বাচনী আচরণবিধি কার্যকর হওয়ার পর জনসভায় মোদির দেওয়া ১৭৩টি ভাষণ বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ১৭৩টির মধ্যে ১১০টি ভাষণে মোদি ‘ইসলামভীতি’ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। সংগঠনটি মনে করে, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ঘৃণা সৃষ্টিকারী মন্তব্য করায় ভারতে মুসলমান ও খ্রিষ্টান এই দুই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা বেড়েছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ৭টি রাজ্যের উপজাতি অধ্যুষিত কয়েকটিতে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বেশি। এসব রাজ্যে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণে নতুন করে জাতিগত বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এরমধ্যে মণিপুর রাজ্যে হিন্দু মেইতেই ও খ্রিষ্টান কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতি ক্রমেই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

বিজেপির সমর্থকরা মনে করেন, নরেন্দ্র মোদির সরকার এর আগেও এই রাজ্যের জাতিগত সংঘাতকে শক্তভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। এবারও একইভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবে তারা। অন্যদিকে, সরকারের সমালোচকরা বলছেন, মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট এর প্রধান সম্পাদক ও লেখক শেখর গুপ্ত মনে করেন, বিজেপি তার ‘জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের রাজনীতি’ বা হিন্দুত্ববাদী আদর্শ উত্তর-পূর্ব ভারতেও কার্যকর করতে মরিয়া। মণিপুরের বর্তমান জাতিগত সংঘাতের মূল কারণ বিজেপির এই হিন্দুত্ববাদী নীতি। এই রাজ্যে সংখ্যালঘু কুকিরা তাদের জাতিসত্তার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে সংখ্যাগুরু মেইতেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে নেমেছে তা বিজেপি হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রবল শক্তি দিয়ে দমন করতে চাইছে।

বিজেপির কৌশল ও নীতি মণিপুরে এখনো পর্যন্ত কাজ দেয়নি। বরং রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাসীন দলটি তাদের সেই নীতি নিয়েই পড়ে আছে। বিজেপি মনে করে, কংগ্রেস তাদের কয়েক দশকের শাসনামলে উত্তর-পূর্ব ভারতের উপজাতি অধ্যুষিত কয়েকটি রাজ্যে আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের এই ব্যর্থতা এসব রাজ্যের পরিস্থিতিকে অবণতির দিকে নিয়ে গেছে।

সাংবাদিক শেখর গুপ্ত দ্য বলেছেন, তিনি বিজেপির মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস এর উত্তর-পূর্ব ভারতে অতীতে কাজ করা বেশ কিছু সিনিয়র নেতার মুখ থেকে এধরণের বক্তব্যই শুনে এসেছেন। বর্তমানে বিজেপি ও সরকারের সাথে সশ্লিষ্ট কয়েকজন নেতাও কংগ্রেসের ব্যাপারে এমন মনোভাবই প্রকাশ করেছেন।

তাদের মূল কথা হচ্ছে- কংগ্রেস কখনোই উত্তর-পূর্ব ভারতে আগুনকে আগুন দিয়ে মোকাবেলা করার নীতি অনুসরণ করেনি। আর এর ফলে এই অঞ্চলের উপজাতীয় গ্রুপ ও খ্রিষ্টান মিশনারিগুলো তাদের শক্তি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে দমন করতে অতীতের কংগ্রেস সরকার কখনোই শক্তি প্রয়োগের নীতি অনুসরণ করেনি। বরং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

কংগ্রেসের এই ভুল নীতির কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতে জাতিগত বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে উঠেছে বলে মনে করেন আরএসএস ও বিজেপির কিছু নেতা। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাদের আরো অভিযোগ হচ্ছে- এই দলটি দীর্ঘদিন কেন্দ্রে ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকতে হিন্দুত্ববাদ ও বৃহত্তর হিন্দু জনগোষ্ঠির জাতীয় ইচ্ছাকে সামনে না এনে বরং অন্ধকারেই রেখে দিয়েছিল। এর ফলে জাতি নিরাপত্তাসহ নানা সংকটে পড়েছে এবং কংগ্রেস উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিপদগ্রস্ত সীমান্ত ‘উপহার দিয়েছে ভারতকে।

মণিপুর নিয়ে বিজেপির দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- এই রাজ্যটি অনুপ্রবেশকারি বিদেশি ও মিয়ানমার থেকে আসা সশস্ত্র কুকি উপজাতীয় বিদ্রোহীদের হামলার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে। তবে বর্তমান সরকার এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতি হিন্দু জনগোষ্ঠিকে রক্ষায় চমৎকার কাজ করে যাচ্ছে দাবি বিজেপির।

মণিপুরের পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে তা সেখানে ক্ষেপনাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করার ঘটনা থেকেই বুঝা যায়। এর আগে সেভেন সিস্টার্সের কোন রাজ্যে এধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। ড্রোন হামলার কথা কেউ কখনো চিন্তাই করেনি। কিন্তু এবারের চলমান সংঘাতে সেটাই ঘটেছে মণিপুরে। ভবিষ্যতেও এখানে এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে এধরনের হামলা হতে পারে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

ফলে বিজেপি ও তাদের নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার তাদের হিন্দুত্ববাদী নীতি ও শক্তি দিয়ে এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতীয় গোষ্ঠিগুলোর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দীর্ঘদিন দমন করে রাখতে পারবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের যে তীব্র লড়াই চলছে তার ধাক্কা এসে লাগছে সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোতেও।

মণিপুরের সাথে মিয়ানমার সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৩৯৮ কিলোমিটার ও অরুণাচল প্রদেশের সাথে আছে ৫২০ কিলোমিটার। নাগাল্যান্ডের সাথে মিয়ানমার সীমান্ত ২১৫ কিলোমিটার এবং মিজোরামের সাথে আছে ৫১০ কিলোমিটার। মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গেরিলাদের সশস্ত্র অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে চলে এসেছে।

মণিপুরে গত বছর থেকে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার উভয়ই বারবার ইঙ্গিত দিয়েছে যে মিয়ানমার থেকে দুষ্কৃতকারিরা এসে অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতি গোষ্ঠীগুলির হাতে। একারণে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ রোধে এই সীমান্তে বেড়া দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানান।

পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই দুই দেশের ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ভিতরে যাওয়ার নিয়ম ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ বা এফএমআর তুলে দেয়ার ঘোষণাও দেন। সরকারের এই ঘোষনার বিরুদ্ধে বিগত কয়েক মাস ধরেই সরব হয়েছেন এই অঞ্চলের উপজাতীয় জনগোষ্ঠির সদস্যরা। সম্প্রতি জো-রিইউনিফিকেশান অর্গানাইজেশন বা জোরো আয়োজিত এক সভায় সংগঠনের মহাসচিব এল রামদিনলিয়ানা রেন্থলেই ঘোষণা করেন, কেন্দ্রীয় সরকার যদি মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার ও এফএমআর তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে তাহলে মিজোরামের যুবকরা অস্ত্র তুলে নিতে পারে এমন পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপি সরকার হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও চেতনাকে পুঁজি করে গত এক দশক ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ রাজ্যের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি গুলোর নিজস্ব জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দমনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোন কাজই হয়নি তা এসব রাজ্যে নতুন করে সৃষ্টি হওয়া ক্ষোভের আগুন থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এসব রাজ্যে তথাকথিত বহিরাগতদেরকে চিহ্নিত করতে নরেন্দ্র মোদির সরকার ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস বা এনআরসি এবং সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট বা সিএএ কার্যকরের পর থেকে ভারতের অ-হিন্দু বাসিন্দাদের হয়রানী চরমে পৌছেছে। বিজেপি সরকারের এই হিন্দুত্ববাদী নীতি উত্তর-পূর্ব ভারতে নতুন করে অশান্তির বীজ বপন করেছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইনের সূত্র ধরে গত মাসে মেঘালয় রাজ্য সরকার বহিরাগতদের চিহ্নিত করতে বিধানসভায় মেঘালয় আইডেন্টিফিকেশন, রেজিষ্ট্রেশন অব মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স আ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২৪ পাশ করে। এই আইনের বলে এখন সরকারির পরিদর্শকরা কথিত বহিরাগতদের সনাক্ত করতে ব্যাপক ক্ষমতা পাবেন।

আরেক রাজ্য আসামের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারও ইতিমধ্যে ‘বহিরাগত বাঙ্গালি মুসলমানদের’ বিরুদ্ধে একই ধরণের অভিযান শুরু করেছে। মিজোরামেও বাসিন্দাদের জাতীয় পরিচিতি সনাক্তের ইস্যুটি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। নরেন্দ্র মোদি সরকারের গত এক দশকের শাসনামলে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি তৈরির পরিবর্তে বিভেদ-বিভাজনের বীজ বপন করেছে।