পররাষ্ট্রনীতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। চেষ্টা করছে ভারতের ওপর থেকে যাতে নির্ভরতা কমে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস এরইমধ্যে আসিয়ানে যোগ দেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছেন। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ঠিক এখনই আসিয়ানের সদস্য হওয়াটা ঢাকার জন্য সহজ নয়। কারণ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে যে বিপর্যস্ত অবস্থায় রেখে পালিয়ে গেছেন, সেটাকে সামলে নেওয়ার ধকল এখন বইতে হচ্ছে নতুন সরকারকে। তবে, কিছু বিশ্লেষক সম্ভাবনাটাও দেখতে পাচ্ছেন। তারা বলছেন, নৌ সীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে ঢাকাকে সাহায্য করবে। তাছাড়া, এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে একটা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ তো তাদের আছেই।
প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস মাত্র কয়েকদিন আগেই আসিয়ান নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। ১০ সদস্যের এই জোটে যোগদানের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সমর্থন চেয়েছেন তিনি। ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মোহাম্মদ হাশিম মোহাম্মদের সাথে বৈঠকের সময় ওই আগ্রহ জানান মোহাম্মদ ইউনূস। হাইকমিশনার জানান, ইউনূসের অনুরোধের বিষয়টি তিনি তার দেশের সরকারের কাছে পৌঁছে দিবেন। এখানে মনে রাখা দরকার যে, আগামী বছর আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া।
গত মাসে ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরেছেন ৮৪ বছর বয়সী অধ্যাপক ইউনূস। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনুরোধে মারাত্মক সঙ্কট কবলিত দেশে গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন আর স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। এর আগে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে হেলিকপ্টার নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রবিহীন ১৫ বছরের শাসনকালে তিনি প্রচন্ড স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন।
মালয়েশিয়ার প্যাসিফিক রিসার্চ সেন্টারের মুখ্য উপদেষ্টা এবং সিঙ্গাপুর ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনার অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো ওহ এই সুন বলেছেন, আসিয়ানের সদস্য হওয়ার জন্য মালয়েশিয়ার কাছে আগ্রহ জানানোটা বাংলাদেশের জন্য স্বাভাবিক। করণ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এই দেশটিও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়া ২০২৫ সালে আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তাদের হাতেই আসছে।
ওহ মনে করেন, আসিয়ানের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য সম্পর্কও বাড়ানোর আকাঙ্খা করবে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের দেশগুলো থেকে আরও বেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করবে ঢাকা। বাংলাদেশ এখন যে রাজনৈতিক আর আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আসিয়ানের অধিকাংশ দেশই সেটাকে সহানুভূতির চোখে দেখে। সেখানে উন্নয়নের বিস্তর সুযোগ রয়েছে বলেও মনে করে তারা। তবে, ওহ মনে করেন, আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ এই ফোরামে সদস্যপদের জন্য নিজেদেরকে উপযুক্ত করে তুলতে বাংলাদেশকে আগে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অস্থিরতা কমাতে হবে।
মিয়ানমারের সঙ্কট এখনও কাটেনি। আসিয়ান এখনই হয়তো নতুন আরেকটি সদস্যকে জোটে নেয়ার কথা ভাবছে না। বিশেষ করে নানা সমস্যা আর চ্যালেঞ্জে জর্জরিত বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে নেয়ার জন্য আসিয়ান তাড়াহুড়া করবে না। তিমুর লেস্টের সদস্যপদের কথা মনে করিয়ে দেন ওহ। দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তারা আসিয়ানের সদস্য পদের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিমুর লেস্টের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। তিনি আশা করছেন, আগামী বছরের মধ্যেই এই ব্লকের সদস্য হতে পারবে তার দেশ। আসিয়ানে বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার পথে আরেকটি বিষয় বাধা হতে পারে তা হলো আসিয়ান দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের যে ভৌগলিক দূরত্ব।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয় মিয়ানমারে। সেখানে যে সঙ্কট চলছে, সেটাকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে গেছে আসিয়ানের সদস্যরা। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আর সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সমালোচনা করেছে। অন্যদিকে, জান্তা সরকারের সাথে সরাসরি বিনিময়ে আগ্রহী আসিয়ানেরই আরেক সদস্য দেশ থাইল্যান্ড।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর গবেষক ইশরাত হোসেন মনে করেন, আসিয়ান ব্লকটি যেহেতু গড়ে উঠেছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কথা মাথায় রেখে, তাই বাংলাদেশের পক্ষে এই ফোরামের পূর্ণ সদস্য হওয়াটা সহজ হবে না।
ইশরাত মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হওয়াটা বরং বেশি যুক্তিযুক্ত। ঢাকা এর আগে এ ব্যপারে আগ্রহও জানিয়েছিল। সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হলে আসিয়ান দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বহুজাতিক নিরাপত্তা ইস্যুগুলোতে একসাথে কাজ করার ক্ষেত্রে বারতি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
আসিয়ানের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশের আগ্রহের আরেকটি কারণ রয়েছে। আগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় ভারত-কেন্দ্রিক পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করেছেন। বাংলাদেশ এখন সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সেজন্যেই তারা পূর্বের দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে।
পুরো শাসনকালেই ভারতের শীর্ষ নেতাদের সাথে জোরালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। গত জুলাই মাসেও ভারত সফরে গিয়ে ১০টি চুক্তি করে এসেছিলেন তিনি। নৌসীমায় সহযোগিতা, ডিজিটাল অংশীদারিত্ব ও রেল সংযোগ থেকে শুরু করে মহাকাশ প্রযুক্তি খাতেও ভারতের সাথে চুক্তি করেছিলেন তিনি।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেয়ারব্যাংক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের অনাবাসিক সহযোগী আনু আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে গণবিক্ষোভ হয়েছে, সেখানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে তীব্র অসস্তোষ ছিল। সেটাও একটা বড় কারণ, যে জন্য সরকার এখন আসিয়ান সদস্যপদের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত দীর্ঘ সময় ধরে অনাকাঙ্খিক্ষত হস্তক্ষেপ করেছে। সে জন্যেই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে, ভারতের সেই অযাচিত হস্তক্ষেপের বিপরীতে একটা বৈশ্বিক অবস্থান তৈরির জন্য আসিয়ানের সদস্যপদকে একটা বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা আর তার প্রশাসন বিগত তিনটি নির্বাচনকে সম্পূর্ণ প্রহসন বানিয়ে তুলেছিল। এর মধ্যে সবশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনও রয়েছে। শুধু বাংলাদেশী নয়, বরং বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকও এই অভিযোগ করেছে। পাতানো ওই নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতার চেয়ারে বসেছিলেন হাসিনা আর তার দল। নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলের প্রায় সব নেতাকে আর তাদের ২৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আটক করে জেলে ঢুকিয়েছিল স্বৈরাচারি হাসিনার সরকার।
ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার পরও ভারত ওই নির্বাচনের ফলকে স্বাগত জানিয়েছিল। ভারতের এই অবস্থানের জবাবে সারা বাংলাদেশ জুড়ে তখন ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক ওঠে। এই আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছিল খুব পরিস্কার। নয়াদিল্লি তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জেনে বুঝে অবৈধ হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে।
আসিয়ানে সদস্যপদের জন্য বাংলাদেশের প্রার্থীতা এক দিক থেকে বেশ প্রাসঙ্গিক। তা হলো চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট। বিগত বছরগুলোতে মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার জাতিগত রোহিঙ্গা পালিয়ে যেমন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তেমনি বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়াতেও ঢুকে পড়েছে।
মিয়ানমারে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধ থেকে বাঁচতে অতি সাম্প্রতিক সময়েও প্রায় আট হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। সরকারের কর্মকর্তারাই এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মাদকের প্রসার এবং মানব পাচার ঠেকানোর মতো অভিন্ন ইস্যুগুলো নিয়ে বাংলাদেশ আর আসিয়ান দেশগুলো এক সাথে মিলে কাজ করতে পারে।
গবেষক আনু আনোয়ার মনে করেন, আন্তর্জাতিক নৌসীমা নিয়ে বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি-তে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। তাদের এই অভিজ্ঞতাটাও আসিয়ান সদস্য দেশগুলো কাজে লাগাতে পারে।
ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে নৌসীমার বিরোধ নিয়ে দুই দেশ আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছিল। সেই বিবাদের মামলায় ২০১৪ সালে আদালত বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে আরেকটি জলসীমা কেন্দ্রিক বিরোধ নিয়ে আদালতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেখানেও আদালতের রায় এসেছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ওই আদেশে বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইল সীমার মধ্যে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সীমার মধ্যে মিয়ানমারের কোন ভূখন্ডগত নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও নাকচ করে দেয় আদালত।
আসিয়ান সদস্য দেশ মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, ভিয়েতনাম, ব্রুনেই এবং ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা নিয়ে চীনের সাথে দীর্ঘদিনের বিবাদ চলে আসছে। দক্ষিণ চীন সাগরে জলসীমা নির্ধারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সম্পদ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একই এলাকাকে দুই পক্ষই নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও আসিয়ানে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়াটা সুবিধাজনক। কারণ বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানটা একদিকে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের একটা ঐতিহাসিক আর সাংস্কৃতিক যোগাযোগ তো আছেই।
এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র এমনভাবে বদলে যাচ্ছে, যেখানে আসিয়ানের স্বার্থ অর্জন আর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ক্রমেই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। এই বাস্তবতার মধ্যে আঞ্চলিক এই ফোরামে বাংলাদেশের সদস্যপদের গ্রহণযোগ্যতাও আসলে বেড়ে গেছে।