ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজা থেকে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামে বড় দুই আলোচনার বিষয় হলো ইসরায়েলের আয়রন ডোম আর হামাস সেনাদের ছোড়া রকেট বৃষ্টি। ইসরায়েলের আয়রন ডোমকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিরক্ষা সিস্টেম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের ভূখণ্ড রক্ষায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি আয়রন ডোম কিনেছে। অন্যদিকে, হামাসের ছোড়া রকেট নিয়ে ইসরায়েলকে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতে হচ্ছে। গাজায় যেহেতু বাইরে থেকে অস্ত্র আমদানির কোনো সুযোগ নেই, তাই হামাস কোথা থেকে এই রকেটগুলো পাচ্ছে, তা নিয়েও আছে বিস্তর কৌতূহল।
আয়রন ডোম হলো সব ধরনের আবহাওয়ায় কার্যকর একটি ভ্রাম্যমাণ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। ইসরায়েলের বিখ্যাত অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম এবং ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ যৌথভাবে আয়রন ডোম সিস্টেমটি তৈরি করেছে। আয়রন ডোম এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যা দিয়ে স্বল্প পাল্লার যে কোনো রকেট এবং আর্টিলারি শেলগুলোকে শূন্যে ভাসমান থাকা অবস্থায়ই অকার্যকর করে দেওয়া যায়। ২০০৬ সালের সঙ্ঘাতের সময় লেবাননের হিজবুল্লাহর সহস্রাধিক রকেটে ইসরায়েল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর দেশটির নীতি নির্ধারকেরা আয়রন ডোমের মতো একটি প্রতিরক্ষা সিস্টেম নির্মাণের কথা ভাবতে শুরু করেন।
ইসরায়েলের দিকে আসা সর্বনিম্ন ৪ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ৭০ কিলোমিটার দূরত্ব থেকে আসা সব ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। বর্তমানে সর্বোচ্চ দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার হলেও ভবিষ্যতে ২৫০ কিলোমিটার দূর থেকে আসা রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধেও আয়রন ডোমের কার্যকারিতা বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি একাধিক টার্গেট থেকে আসা রকেটগুলো প্রতিরোধে এবং একসঙ্গে ছোড়া অনেকগুলো রকেটকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে আয়রন ডোমের সক্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
আয়রন ডোম চালু করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১১ সালের ২৭ মার্চ। সেদিন থেকেই ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় নেগেভ শহরের বিরসেবা এলাকায় এর প্রয়োগও শুরু হয়। বিরসেবাতেই আয়রন ডোম দিয়ে প্রথমবারের মতো গাজা থেকে ছুটে আসা বিএম-টোয়েন্টি ওয়ান গ্রাড রকেটগুলোকে সফলভাবে ইন্টারসেপ্ট করা হয়। ২০১২ সালের ১০ মার্চ দ্য জেরুজালেম পোস্ট জানায়, গাজা থেকে আসা রকেটগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ রকেটকেই আয়রন ডোমের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে আয়রন ডোম দিয়ে ২৪০০-এর বেশি রকেটকে ইন্টারসেপ্ট করার দাবি জানায় ইসরায়েল।
আয়রন ডোমের মূলত তিনটি কম্পোনেন্ট আছে। টার্গেট শনাক্তকরন ও ট্র্যাকিং রাডার। আছে যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা যাকে সংক্ষেপে বিএমসি বলা হয়। রাডারের মাধ্যমে একটি টার্গেটকে সনাক্ত করার পর পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে। আর আছে মিসাইল ফায়ারিং ইউনিট। এই ইউনিটে অপটিক সেন্সর আছে যা দিয়েই মূলত ইন্টারসেপ্টের কাজটি হয়। আয়রন ডোমের মিসাইলগুলো রাফায়েল নিজেরাই উৎপাদন করেছে। প্রতিটি আয়রন ডোম ব্যাটারিতে ৩-৪টি লঞ্চার থাকে আর প্রতিটি লঞ্চারে আছে ২০টি মিসাইল।
প্রাথমিকভাবে আয়রন ডোম সিস্টেম নির্মান ও উন্নয়নের যাবতীয় খরচ ইসরায়েল নিজেই সরবরাহ করেছিল। পরে এর সাথে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অনুরোধে মার্কিন কংগ্রেস আয়রন ডোম প্রকল্পে ইসরায়েলকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানে বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড় দিতে সম্মত হয়। ওবামা মার্কিন কংগ্রেসকে ২০৫ মিলিয়ন ডলার ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করেন। হোয়াইট হাউসের তৎকালীন মুখপাত্র টমি ভিয়েটর বলেন, হামাস ও হিজবুল্লাহর ছোড়া রকেটগুলোকে ইসরায়েলের জন্য হুমকি বলে মনে করেন প্রেসিডেন্ট ওবামা।
২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রকল্পে আরো ২৩৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেন। তবে এ বিনিয়োগের সময় শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় , সর্বশেষ মার্কিন সহযোগিতা দিয়ে যতগুলো আয়রন ডোম নির্মাণ করা হবে তার অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে হবে। পরে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথিওনও ইসরায়েলের অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে এক হয়ে যৌথভাবে আয়রন ডোম নির্মান শুরু করে।
আয়রন ডোমের প্রতিটি ব্যাটারি বা একেকটি ফুল ইউনিট নির্মাণে খরচ পড়ে ৫০ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, যে মিসাইলগুলো দিয়ে রকেটগুলোকে ইন্টারসেপ্ট করা হয় সে মিসাইলগুলোর প্রতিটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৮০ হাজার মার্কিন ডলার।
এবার আসা যাক হামাসের রকেট প্রসঙ্গে। হামাস বর্তমানে যেসব রকেট নিক্ষেপ করছে তা নিয়ে খুব নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। ধারনা করা হয় , প্রতিটি রকেট নির্মাণে মাত্র ৫শ থেকে ৮শ ডলার ব্যয় হয়। এমনকি আরও কম অর্থ ব্যয়েও রকেট তৈরির উদহারণ রয়েছে। হামাস যত রকেট নিক্ষেপ করছে, তার সবটাই টার্গেটে পৌঁছাতে পারে না। অনেকগুলো রকেট আছে যেগুলো গাজার সীমানাও ভালোভাবে পার হতে পারেনা। যেগুলো গাজা পার হয়ে ইসরায়েলের দিকে যায়, তারও একটি বিরাট অংশ আয়রন ডোমের কারণে ইন্টারসেপ্ট হয়ে যায়। এ কারণে এবারের সংঘাতে হামাস ভিন্ন একটি কৌশলে অগ্রসর হয়েছে এবং এতে তারা বেশ সফলতাও পাচ্ছে।
হামাস এক সাথে অনেকগুলো রকেট নিক্ষেপ করছে এবং খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নিক্ষেপ করছে। ফলে, আয়রন ডোম দিয়ে ইসরায়েল নানাভাবে চেষ্টা করেও সবগুলো রকেটকে অকার্যকর করতে পারছে না। অনেকগুলোই গিয়ে আঘাত করছে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ স্টেশন, তেল শোধনাগার এমনকী ইসরায়েলের বিমান বন্দরেও এ রকেটগুলো এসে আঘাত হানছে।
কাসসাম রকেট এই মুহূর্তের সবচেয়ে আলোচিত রকেট। অথচ এই রকেটগুলো খুবই সরল এবং স্টিলের আর্টিলারি-সমৃৃদ্ধ । ইজ্জ আদ দীন আল কাসেম ব্রিগেড মূলত এই রকেটটি নির্মাণ করে। কাসসাম ব্রিগেডের নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয়। দ্বিতীয় ইনতিফাদার পরপর ২০০১ সালে প্রথম কাসসাম রকেটের ব্যবহার শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এই রকেটটি মাত্র ৩ কিলোমিটার দূর থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব হলেও এখন এ দূরত্বকে অনেকটাই বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। একেবারেই ঘরোয়া পরিসরে চিনি ও পটাসিয়াম নাইট্রেট দিয়েই এ রকেটগুলো উৎপাদন করা হয়। সাধারণভাবে পটাসিয়াম নাইট্রেট সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অথচ ফিলিস্তিনের মুক্তিসেনারা গবেষণার মাধ্যমে এই পটাসিয়াম নাইট্রেট দিয়েই এরকম একটি রকেট প্রস্তুতির ফর্মুলা আবিস্কার করে নেয়। অনেক সময় টিএনটি এবং ইউরিয়া নাইট্রেটও কাসসাম নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। কাসসামে থাকে স্টিলের একটি সিলিন্ডার, নজেল এবং ধাতব পদার্থে ঢাকা বিস্ফোরক দ্রব্য। প্রতিটি রকেটে একটি করে ফিউজও বসানো হয়।
হামাস ছাড়াও অন্যা ফিলিস্তিনি সংগঠনও রকেট নিক্ষেপ করে। একেকটি ফিলিস্তিনি সংগঠন একেক ধরনের রকেট নিক্ষেপ করে। ইসলামিক জিহাদ যে রকেটগুলো ব্যবহার করে তার নাম আল কুদস। পপুলার রেসিস্ট্যান্স কমিটির রকেটগুলোর নাম আল নাসির। তানজিমের রকেটগুলোর নাম সারিয়া টু আর। ফাতাহ ব্যবহার করে কাফাহ নামের রকেটগুলো। লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ যে রকেটগুলো ইসরায়েলের ওপর নিক্ষেপ করে তার নাম কাতইয়ুশা। ইসরায়েলের ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড টেররিজম সেন্টারের একটি হিসেবে জানা যায়, বিগত কয়েক বছরে ইসলামিক জিহাদই তাদের ওপর সবচেয়ে বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছে। যতগুলো রকেট ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তার ৩৪ শতাংশ ছুড়েছে ইসলামিক জিহাদ, ২২ শতাংশ হামাস, ৮ শতাংশ ফাতাহ আর ৩০ শতাংশ রকেট কারা ছুড়েছে তা জানা যায়নি।
পশ্চিমা দেশগুলো দাবি করে থাকে, ইরান ও সিরিয়া থেকে পাচার হয়ে রকেট নির্মাণের কাঁচামালগুলো গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রবেশ করছে। যদিও এসব দাবির কোনো ভিত্তি নেই। মূলত ইরানকে কেন্দ্র করে হামাসের যাবতীয় গল্পগাঁথা রচিত হলেও এরও কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনা। গত কয়েকদিনে হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫শ রকেট নিক্ষেপ করেছে। এই সংঘাত শুরু হওয়ার আগে ইসরায়েলও ধারণা করতে পারেনি যে, হামাসের কাছে এত পরিমান রকেট মজুদ রয়েছে। অন্যদিকে, হামাস একের পর এক রকেট ছুড়ছে এবং দাবি করছে তাদের হাতে এখনো মূল অস্ত্র ভান্ডার অক্ষতই রয়ে গেছে।
হামাস নিয়ন্ত্রণ করছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। যা দীর্ঘদিন বিশ্বের সর্ববৃহৎ হিউম্যান প্রিজন বা মানব কারাগার নামে পরিচিত। ২০০৭ সালে হামাস ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসরায়েল ও মিশর গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ তো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় খাবার, ঔষধ ও জ্বালানী তেল সরবরাহের ক্ষেত্রেও ইসরায়েল নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। মিশরও বিগত কয়েক বছর সিনাই-গাজা বর্ডার দিয়ে মানুষ ও পণ্যের যাতায়াতকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অথচ এত কঠিন অবরোধের মধ্যেও হামাস কীভাবে এত বিপুল সংখ্যক রকেট নির্মাণ করলো তা বিরাট একটি রহস্য। এতদিন হামাসের কাসসাম রকেটের একটি সীমাবদ্ধতা ছিল আর তাহলো এই রকেটগুলো সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেটে আঘাত হানতে পারতো না। কিন্তু এবারের সংঘাতে দেখা যাচ্ছে, হামাসের নিক্ষিপ্ত রকেটগুলোর মধ্যে যেগুলো ইসরায়েলি ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে তার প্রায় সবগুলোই নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত হেনেছে।
সামরিক শক্তি ও অস্ত্র বা গোলা বারুদ কোনো দিক থেকেই হামাস ইসরায়েলের সাথে তুলনায় নয়। ইসরায়েলের হাতে আছে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা সিস্টেম আয়রন ডোম। আছে অত্যাধুনিক সব ফাইটার জেট ও ট্যাংক। ইসরায়েলী সেনারাও সুসজ্জিত এবং আধুনিক সব অস্ত্রে সমৃদ্ধ। এরপরও হামাস যেভাবে তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তুলছে তা অনেক সামরিক বিশ্লেষকের স্বাভাবিক হিসেব নিকেষকেই পাল্টে দিচ্ছে।