নাগরনো-কারাবাখে আজারবাইজানের ড্রোন হামলায় ব্যাপকভাবে আর্মেনিয়ার ট্যাঙ্ক ধ্বংসের পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক কতটা ভূমিকা পালন করতে পারবে? গত অক্টোবর-নভেম্বরে নাগরনো-কারাবাখের রাস্তার পাশে ও পাহাড়ি সেনা অবস্থানে আর্মেনিয়ার ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া যান ধ্বংসের দৃশ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ড্রোনের কাছে প্রচলিত শক্তিশালী সমরাস্ত্র ট্যাঙ্ক অসহায় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের এ ঘটনার পর বিভিন্ন দেশের সমরাঙ্গনে আলোচনা চলছে ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের ভূমিকা নিয়ে।
একটি বিষয়ে সমর বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন, ভবিষ্যতে যুদ্ধক্ষেত্রে যদি ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে হয়, তাহলে ব্যাপকভাবে আধুনিকায়ন করতে হবে। ড্রোন, রোবটসহ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দ্রুত উন্নতির কারণে আপগ্রেড করা না হলে প্রচলিত পুরনো অনেক মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক এখন অকেজো হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতের ট্যাঙ্কে থাকতে হবে শক্তিশালী উন্নত প্রযুক্তি, যা প্রতিপক্ষের ছুটে আসা যে কোনো হামলা শনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারবে। থাকতে হবে শক্তিশালী কাউন্টার ব্যবস্থা।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ভবিষ্যত যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক, ড্রোন বিমান এবং গ্রাউন্ড ড্রোনকে একই নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির সাথে প্রয়োগ করতে হবে উন্নত কৌশল। আজারবাইজানের ড্রোন হামলা বিষয়ে আর্মেনিয়া ছিল একেবারেই অপ্রস্তুত। তারা যদি এ ধরনের হামলা বিষয়ে প্রস্তুত থাকত এবং ভালো কৌশল প্রয়োগ করতে পারত, তাহলে হয়তো ক্ষতি কিছুটা কম হতো বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
ভবিষ্যতে ড্রোনসহ আর্টিফিসিয়াল সমরাস্ত্রের আক্রমণ থেকে ট্যাঙ্ক রক্ষায় উন্নত প্রযুক্তির ট্যাঙ্ক উদ্ভাবন নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ করছে অনেক সংস্থা ও দেশ। ফলে বিশেষজ্ঞদের মতে অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের ভূমিকা কমবে না। বরং ভবিষ্যত যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যাবে আরো বিধ্বংসী ক্ষমতার ট্যাঙ্ক।
নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধে ব্যবহৃত ড্রোন আজারবাইজান সংগ্রহ করেছে তুরস্কের কাছ থেকে। ড্রোন হামলায় ট্যাঙ্ক এবং সাজোয়া যান ধ্বংসের সময় মারা গেছে বিপুলসংখ্যক আর্মেনিয়ান সৈন্য। নাগরনো-কারাবাখের সমস্ত সেনা ছাউনি জুড়ে আর্মেনিয়ার ধ্বংস হওয়া ট্যাঙ্ক ও সাজোয়া যান পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
বিশ্বে যে কয়টি এলাকায় ভূমি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে নাগরনো-কারাবাখ তার মধ্যে অন্যতম পুরনো। প্রায় তিন দশক নাগরনো-কারাবাখ আর্মেনিয়ার দখলে থাকার পর গত নভেম্বরে তা আজারবাইজান পুনরায় উদ্ভার করে। এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে একুশ শতকের উন্নত অস্ত্র প্রযুক্তি। প্রচলিত অস্ত্রের বিপরীতে স্বল্প খরচের উন্নত শক্তিশালী ড্রোনের বিজয়ী ভূমিকা ভবিষ্যত বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিপুল ব্যয়বহুল ট্যাঙ্ক নিয়ে। ব্যায়বহুল ট্যাঙ্ক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা পালনের পরিবর্তে বরং প্রতিপক্ষের নির্বিচার হামলায় ব্যাপক ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে।
তুরস্কের যেসব ড্রোন নাগরনো-কারাবাখে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বেরাক্তার টিবি২। এর নির্মাতা তার্কিশ ডিফেন্স কোম্পানী বেরাক্তার।
বেরাক্তার টিবি টু ৪টি মিসাইল নিয়ে ২৬ হাজার ফিট উচুতে উড়তে পারে আর টানা ২৭ ঘন্টা চলতে পারে। অনেক উচুতে অবস্থান করায় এটি প্রতিপক্ষের জন্য সনাক্ত করা কঠিন।
নাগরনো-কারাবাখের আগেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে ড্রোন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে ড্রোন মিশন পরিচালনা করে আসছে সাফল্যের সাথে। ২০২০ সালে নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধের আগে ২০১৬ সালের চার দিনের যুদ্ধেও আজারবাইজান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে ড্রোন। তখন তারা ব্যাবহার করেছে ইসরাইলের লয়টারিং ড্রোন হারোপ। হারোপ একটি উড়ন্ত বোমা। যুদ্ধক্ষেত্রে মাথার ওপর উড়তে থাকে এ বোমা। লক্ষ্যবস্তু খুঁেেজ পাওয়ার পর সেখানে উড়ে গিয়ে আত্মঘাতি হামলা চালায় হারোপ।
যুদ্ধক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় আলোচনা চলছে প্রচলিত অন্যতম শক্তিশালী সমরাস্ত্র ট্যাঙ্কের ভূমিকা নিয়ে।
ড্রোনের মত আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অটোনোমাস অস্ত্রের ভূমিকা বাড়লেও অনেকের মতে ট্যাঙ্কের ভূমিকা ফুরিয়ে যায়নি। ভবিষ্যত যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষচালিত আরমারড ভেহিক্যালস এর একটি অবস্থান থাকবে। এর কারন এখনো সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হয় এবং সেক্ষেত্রে তাদের দরকার আরমার প্রটেকশন। আকাশে কিলার ড্রোন ছেয়ে গেলেও এসব সাজোয়া যানের দরকার হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যতে আরমারড ভিহিক্যাল হতে হবে উন্নত প্রযুক্তির। পরিবর্তন আনতে হবে ট্যাঙ্ক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। নতুন ট্যাঙ্ক উদ্ভাবন করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে ম্যানড এন্ড আনম্যানড ভেহিক্যালের একত্রে এক নেটওয়ার্কের অধীনে যুদ্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ম্যানড-আনম্যানড টিমিং ধারনা নিয়ে কাজ করছে। আর্মির রোবটিক কমব্যাট ভিহিক্যাল প্রগ্রাম এ ধারনা নিয়ে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এম১ আবরামস ট্যাঙ্ক ১৯৮০ সালে সার্ভিসে যুক্ত হয় এবং আর্মি ও মেরিন কর্পস এর মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক এটি।
অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে একটি ভেহিক্যালে বন্দুক, সেন্সর এবং সৈন্যদের না রেখে ড্রোনে রাখা যায় লংরেঞ্জ সেন্সরে। মেইন গান রাখা যায় গ্রাউন্ড রোবটে এবং দূরবর্তী স্থানে ছোট শক্তিশালী সাজোয়া যানে থাকবে হিউম্যান কন্ট্রোলার। আর এ ক্ষেত্রে দরকার হবে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। একই সাথে এ নেটওয়ার্ক রক্ষা করতে হবে প্রতিপক্ষের হ্যাকিং এবং জ্যামিং আক্রমণ থেকে।
তবে যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের ধ্বংসাত্মক ভূমিকা হ্রাস করতে ইতোমধ্যে অনেকে কাউন্টার পদক্ষেপ উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। রাশিয়ান আর্মি বিশেষজ্ঞ সামুয়েল বেনডেট মনে করেন, গত অক্টোবরের যুদ্ধে আর্মেনিয়া যদি ড্রোন হামলা বিষয়ে আগেই সতর্ক হতো তাহলে তাদের ক্ষতি অনেক কম হতো। ধ্বংসাত্মক ড্রোন হামলা বিষয়ে তারা ছিল একেবারে অপ্রস্তুত। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে সোভিয়েত আমলের তৈরি ট্যাঙ্ক। এসব ট্যাঙ্কে এ ধরনের ড্রোন হামলা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই।
কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া যে আধুনিক ট্যাঙ্ক নির্মান করছে তাতে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ছুটে আসা বিভিন্ন শক্তিশালী আক্রমণ প্রতিহতের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিপক্ষের ছুটে আসা বোমা ধ্বংস করতে পারে আঘাত করার আগেই। আর রয়েছে ইনফ্রেয়ারড ড্যাজলার যা এন্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল এর সেন্সর কে অন্ধ করে দেয়। রাশিয়ার এ ট্যাঙ্কে আরো রয়েছে একটিভ প্রটেকশন সিস্টেম যা ছুটে আসা মিনিয়েচার মিসাইলসহ বিভিন্ন ইনকামিং আক্রমণ লক্ষ্য করে গুলি করে ধ্বংস করে দিতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত থ্রি স্টার সেনা কর্মকর্তা থমাস স্পোহর বলেন, যদি উন্নত প্রযুক্তি নাও থাকে তবু ভাল কৌশল অবলম্বন করতে পারলে ধ্বংসাত্মক ড্রোন হামলা থেকে অনেকটা রক্ষা পাবেন যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধসহ আরো অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন কারনে ব্যাপকভাবে ধ্বংসের শিকার হয়েছে ট্যাঙ্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানরা দ্রুত উপলব্ধি করে ফিল্ড গান দিয়েই মিত্রবাহীনর ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা যায়।
ড্রোনের কারনে ট্যাঙ্ক অকার্যকর হয়ে যাবে এটা মানতে রাজি নন অনেকে। আর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের মূল লক্ষ্য ট্যাঙ্ক নয়। ফলে ট্যাঙ্কের ভূমিকা কখনো ফুরিয়ে যাবে না। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাঙ্ক যেভাবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে তার পরিবর্তে এটি চলে যেতে পারে পদাতিক ভূমিকার পথে।
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে ভবিষ্যত যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন, গ্রাউন্ড রোবট এবং মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের সমন্বিত ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে ফিউচার ট্যাঙ্ক এর উদাহরন হিসেবে কেউ কেউ সামনে এনেছে রিপ স এম৫ রোবটিক কমব্যাট ভেহিক্যাল। এটি উদ্ভাবন করেছে টেক্সট্রন সিস্টেম। এতে রয়েছে এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল সিস্টেম। এটি মাইন অপসারণ ও আই ই ডি ধ্বংস করতে পারে। মিনি ট্যাঙ্ক রিপস এম৫-এর শক্তি ৬০০ হর্স পাওয়ারের সমান এবং ঘন্টায় গতি ৬০ মাইল।
অনেকের মতে এআই টেকনোলজির অগ্রগতি সত্ত্বেও মানবচালিত ট্যাঙ্ক দরকার হবে। কারন রিমোর্ট কন্ট্রোল এবং অটোনোমাস রোবট সবসময় সঠিকভাবে কাজ করে না। এজন্য দরকার হয় অভিজ্ঞ মানুষ পরিচালিত ভেহিক্যাল। যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্র অনুধাবন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকের দরকার।
আবার অনেকের মতে ভবিষ্যতের ট্যাঙ্ক হবে অনেক হালকা। যা সহজে বিভিন্ন দুর্গম এলাকা, ছোট ব্রিজ, রাস্তা সহজে অতিক্রম করতে পারবে। তাদের মতে অদূর ভবিষ্যতে ট্যাঙ্কের ভূমিকা কমবে না।