হামাসের অস্ত্রভান্ডারে কী কী আছে?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২০ মে ২০২১, ১৪:৫২

আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার প্রতিরোধ আন্দোলন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোমকে ফাঁকি দিতে পেরেছে হামাসের কিছু রকেট। আবার এক সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট ছুড়তে পারার সক্ষমতাও অর্জন করেছে তারা। যার ফলে হামাসের রকেট প্রযুক্তির উন্নতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল কাসসাম ব্রিগেড জেরুজালেম লক্ষ্য করে যেসব রকেট ছোড়ে, তাতে ছিল শক্তিশালী বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি ওয়ারহেড। আল আকসা মসজিদে মুসল্লিদের ওপর ইসরায়েলি হামলা ও শেখ জারাহ এলাকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদের প্রতিবাদে ছোড়া ওই মিসাইলগুলোর পাল্লা ছিল ১২০ কিলোমিটার। এসব মিসাইলের মধ্যে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী মাত্র একটি মিসাইল ভূপাতিত করতে পেরেছে। তাই তো ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় দ্রুত পার্লামেন্ট ভবন খালি করে দেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

১১ মে হামাস ১৩৭টি এস-ফোর্টি মিসাইল ছোড়ে ইসরায়েলের আশকেলন ও আশদোদ শহর লক্ষ্য করে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি ভবন। নিহত হয় ২ ইসরায়েলি, আহত হয় ৬০ জনের বেশি। সেদিন রাতেই ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চল লক্ষ্য করে সবচেয়ে বড় হামলাটি চালায় হামাস। ডজন ডজন রকেট উড়ে যায় রাজধানী তেল আবিব ও গুশ দান শহরের দিকে। এই হামলায় এক ইসরায়েলি নিহত, কয়েক ডজন আহত হওয়ার পাশাপাশি আগুন ধরে যায় বড় একটি তেলপাইপ লাইনে।

মে মাসের ১২ তারিখে রাজধানী তেল আবিব ও পাশ^বর্তী বেনগুরিয়ন বিমানবন্দর লক্ষ্য করে হামাস ছুড়েছে এসএইচ-এইটি ফাইভ মিসাইল, যার পাল্লা ছিল ৮৫ কিলোমিটার। এভাবে ক্রমশই তারা হামালার রেঞ্জ বাড়িয়েছে। ১৩ মে র‌্যামন বিমানবন্দর লক্ষ্য করে একটি আয়াশ মিসাইল ছুড়েছে, যার পাল্লা ছিল ২৫০ কিলোমিটার। ধ্বংস ক্ষমতাও ছিল অনেক বেশি। এসব হামলার বেশির ভাগই ইসরায়েলের আয়রন ডোম এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের দ্বারা প্রতিহত হয়েছে। তবুও হামাসের শক্তিমত্তা বৃদ্ধির বিষয়টি টের পাওয়া গেছে। তাদের অস্ত্রভান্ডারে যে বৈচিত্র এসেছে সেটিও স্পষ্ট হয়েছে।

হামাসের অস্ত্রভান্ডার সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হয় না। ইসরায়েলি গুপ্তচরদের চোখ এড়াতে গোষ্ঠিটি সামরিক কার্যক্রম চালায় অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে এর কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, হামাসের অস্ত্রভান্ডার সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া সম্ভব না হলেও এটি স্পষ্ট যে, জেরুজালেম, তেল আবিবসহ ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ সব উপকূলীয় এলাকাগুলোতে হামলার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও তারা টার্গেট করতে পারবে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট জানিয়েছে, হামাসের হাতে ১০০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার পাল্লার অনেক রকেট আছে। যেগুলো হাইফাসহ এমনকি ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলেও আঘাত হানতে সক্ষম।

এছাড়া ৭০-৮০ কিলোমিটার পাল্লার কয়েকশো রকেটের কথাও বলেছে পত্রিকাটি। এসব রকেট আঘাত হানতে পারে রাজধানী তেল আবিব, তার পাশ^বর্তী বেনগুরিয়ন বিমানবন্দর ও অধিকৃত জেরুজালেমের ইসরায়েলি স্থাপনায়। ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগর উপকূলীয় রিশন লেইজন, রেহোভত, বেইত শেমেশ শহরেও পৌছতে সক্ষম এমন রকেট রয়েছে হামাসের হাতে।

গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ গাজার প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর হাতে অন্তত ৩০ হাজার রকেট ও মর্টার শেল মজুদ রয়েছে। এসবের পাল্লা বিভিন্ন ধরণের। এগুলো সবাই আনগাইডেড রকেট হলেও মিলিশিয়া গ্রুপগুলো তাদের অ্যাকুরেসি উন্নতি করছে ক্রমশ। সংবাদ মাধ্যমটি আরো লিখেছে, ইসরায়েলের ওপর রকেট ছোড়ার পর অস্ত্রভাণ্ডারের শূন্যস্থানগুলো তারা দ্রুতই পূরণ করছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সমরাস্ত্র বিশ্লেষক ফাবিয়ান হিনজের বরাত দিয়ে জার্মানিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা জানিয়েছে, হামাসের কাছে অন্তত ১৫ ধরনের আন-গাইডেড রকেট বা মিসাইল রয়েছে। এসব মিসাইলের বেশির ভাগই হামাস নিজস্ব প্রযুক্তিতে উৎপাদন করে। এছাড়া ইরান ও সিরিয়া থেকে রকেট সংগ্রহ করে তারা।

ফাবিয়ানের মতে, হামাসের কাছে থাকা সবচেয়ে কম শক্তিশালী রকেটটি হচ্ছে ইরান থেকে সংগ্রহ করা ১০৭ মিলিমিটারের রকেট। এর পাল্লাা ৮ কিলোমিটার। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ১২ কিলোমিটার পাল্লার কিউ-টোয়েলভ রকেট। তৃতীয়টি ২০ কিলোমিটার পাল্লার কিউ-টোয়েন্টি রকেট। এ দুটি রকেট হামাস নিজস্বভাবে উৎপাদন করে।

ফিলিস্তিনের বাইরে থেকে ৪০ কিলোমিটার পাল্লার আরও একটি রকেট আসে হামাসের কাছে, এটি ১২২ মিলিমিটারের। ৪০ কিলোমিটার পাল্লার এস-ফোর্টি রকেট হামাস নিজস্ব প্রযুক্তিতেও উৎপাদন করে। ইরান থেকে সংগ্রহ করা ৭৫ কিলোমিটার পাল্লার রকেট ফজর-থ্রিও আছে হামাসের হাতে। একই পাল্লার দেশীয় উৎপাদনের আরেকটি রকেট রয়েছে হামাসের, যার নাম এম-সেভেনটি ফাইভ। ৮০ ও ৯০ কিলোমিটার পাল্লার আরও দুটি রকেট রয়েছে হামাসের নিজস্ব উৎপাদনের; নাম জে-এইটি ও জে-নাইনটি।

বাকি তিনটি রকেটের প্রতিটিই ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম। এগুলোর মধ্যে এ-ওয়ান টোয়েন্টি রকেট ১২০ কিমি পর্যন্ত এবং আর-ওয়ান সিক্সটি রকেট ১৬০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। হামাসের হাতে থাকা সর্বাধিক শক্তিশালী রকেটটি হচ্ছে এম-থ্রি হানড্রেড টু। ১৮০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম এই মিসাইল সিরিয়া থেকে সংগ্রহ করা।

নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে , হামাসের অস্ত্রভাণ্ডারের মাঝারি পাল্লার যে রকেট রয়েছে সেগুলো ইরান ও রাশিয়ার নকশায় নির্মিত। এসব মিসাইল ২৫ মাইল পর্যন্ত দূরত্বে আঘাত হানতে পারবে, অর্থাৎ রাজধানী তেলআবিব রয়েছে হামাসের হামলার আওতায়। এবং এসব মিসাইল গাজায় স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

হামাসের দূর পাল্লার রকেটগুলো আরো দূরে যেতে পারবে, এমনকি বেনগুরিয়ান বিমান বন্দর পর্যন্ত। সেসবের মধ্যে রয়েছে, ইরানি প্রযুক্তিতে স্থানীয়ভাবে তৈরি এম-সেভেন্টি ফাইভ। এছাড়া ২০১২ সালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হামাসের সামরিক কমান্ডার আহমেদ আল জাবারির নামে নামরকণ করা হয়েছে জে-এইটি রকেট, যেটিও মাঝারি পাল্লার। হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের হাতে ২৫০ কিলোমিটার বা ১৫৫ মাইল পাল্লার রকেট রয়েছে, যা ইসরায়েলের যে কোন স্থানে আঘাত হানতে পারবে।

হামাসের ন্যাশনাল রিলেশন্স ব্যুরোর সদস্য ও আল-কাসসাম ব্রিগেডের সাবেক কমান্ডার মাহমুদ মারদাবি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম আল মনিটরকে জানান, হামাস অতীতের তুলনায় এখন নিজস্ব উৎপাদিত অস্ত্রের ওপর বেশি নির্ভর করে। তিনি বলেন, হামাস এবার স্থানীয়ভাবে তৈরি রকেট ও মিসাইল প্রকাশ করেছে। এসব অস্ত্রের পাল্লা, ধ্বংস ক্ষমতা ও নির্ভূলতা অনেক বেশি।এই কর্মকর্তা জানান, ২০১৪ সালের যুদ্ধের তুলনায় হামাসের সামরিক সক্ষমতা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে এখন তারা কয়েক মিনিটের মধ্যে শতাধিক রকেট ছুড়তে পারে।

হামাসের মিসাইল সক্ষমতা কিভাবে বাড়ছে সেটি নিয়েও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া কঠিন। তবে তারা যে ইরানের কাছ থেকে সরাসরি সহযোগিতা পাচ্ছে তাতে কারো সন্দেহ নেই। হামাস ও ইরানি কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় একথা স্বীকার করেছেন। অন্য দুএকটি দেশ থেকেও তারা অত্যন্ত গোপনে সহযোগিতা পাচ্ছে।

গাজা উপত্যকার ওপর ইসরায়েলের কঠোর অবরোধ থাকার কারণে হামাসকে বাইরে থেকে সহযোগিতা করা খুব সহজ নয়। মিসরের সাথে গাজার সীমান্ত থাকলেও মিসরের সরকার ইসরায়েল বান্ধব। মিসরের সাথে গাজার যোগাযোগের অনেক গোপন সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এরপর থেকেই হামাস বিদেশ থেকে রকেট না এনে, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিয়ে স্থানীয়ভাবে রকেট উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে।

হামাসের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোও হামাস টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে রকেটের রেঞ্জ ও অ্যাকুরেসি বাড়ানোর বিষয়ে। আলজাজিরার এক ডকুমেন্টারিতে হামাসের সামরিক কর্মকাণ্ডের দুর্লভ কিছু ভিডিও দেখানো হয়েছে। যাতে দেখা গেছে, কিভাবে হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের ছোড়া অবিস্ফোরিত মিসাইলগুলো সংগ্রহ করছে।

এগুলো তারা একটি গোপন কারখানায় নিয়ে খুব সাবধানে ভেতর থেকে বিস্ফোরকগুলো আলাদা করে। এরপর এর বিভিন্ন অংশ নিজেদের মতো কাজে লাগায় রকেট তৈরিতে। ওই ডকুমেন্টারিতে আরো দেখানো হয়েছে, একই উদ্দেশ্যে ইসরায়েলের ছেড়ে যাওয়া অবৈধ বসতি এলাকা থেকে পাইপ ও সিলিন্ডার সংগ্রহ করে হামাস কর্মীরা।

হামাসের নিজস্ব পদ্ধতিতে অস্ত্র উৎপাদনের বিষয়টি ইসরায়েলেরও চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না। যে কারণে ইহুদিবাদী দেশটি এখন টার্গেট করছে গাজার ইঞ্জিনিয়ারদের। ইসরায়েল হত্যা করেছে জামাল আল জিবদেহ নামে গাজা উপত্যকার এক ইঞ্জিনিয়ারকে। গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক ছিলেন তিনি।

২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হন গাজার ইঞ্জিনিয়ার ফাদি আল বাদশাহ। তিনি এমন একটি মিসাইল নিয়ে কাজ করছিলেন যেটি ইসরায়েলের আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে। কিন্তু সফল হওয়ার আগেই মেধাবি ওই বিজ্ঞানীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল।