সারা বিশ্বে এটা স্বীকৃত যে, ইসরায়েল প্রযুক্তিগত এবং সামরিক দিক দিয়ে খুবই শক্তিশালী একটি দেশ। পরপর তিনবার সম্মিলিতভাবে আরব দেশগুলো পরাজিত হয়েছে ইসরায়েলের কাছে। এরপর আবার মিসর-সিরিয়া সম্মিলিতভাবে পরাজিত হয় ইসরায়েলের কাছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধে আরবরা ইসরায়েলের কাছে পরাজিত হয়নি। তারা পরাজিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না থাকলে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র বহু আগে মিসর, সিরিয়া, জর্ডানসহ পার্শবর্তী দেশের দখলে চলে যেত। প্রতিষ্ঠিত থাকত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। এমনকি এখনও যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সমর্থন ছাড়া ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। ইসরায়েলকে সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী দেশ মনে করা হলেও চলমান হামাসের রকেট হামলায় তাদের শক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
হামাসের মতো একটি অরাষ্ট্রীয় সংস্থার আনগাইডেড রকেট হামলা যদি তারা পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে না পারে, সেখানে ইরানের মতো মিসাইল পাওয়ারের দেশের আক্রমণের মুখে তারা কতক্ষণ টিকে থাকবে, এটা নিয়ে অনেক সামরিক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলেছেন।
ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও প্রযুক্তিগত উন্নতিও মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের ইহুদিপ্রেমী বিপুলসংখ্যক ধনকুবের অকাতরে ইসরায়েলে অর্থ ঢালার পরও ইসরায়েল বিশ্বের মধ্যে জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি উচ্চ ব্যয়বহুল দেশ। দেশটির অভ্যন্তরে ইহুদিদের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের তিক্ত বিরোধ। এক কথায় যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও শক্তিশালী কিছু দেশের প্রত্যক্ষ সহায়তায় টিকে আছে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যের সহায়তায় দেশটি গঠনের ৭০ বছর পরও অনেকের কাছে আজও এটি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য নয় বা শিশু রাষ্ট্র।
ইসরায়েল খুবই ছোট একটি দেশ। দেশটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গাড়ি দিয়ে মাত্র ৯০ মিনিটে পৌছানো যায়। প্লেনে পৌছানো যায় মাত্র কয়েক মিনিটে। সামরিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে এটি ইসরায়েলের সবচেয়ে দুর্বল দিক।
ইসরায়েলের আরেকটি দুর্বল দিক হলো এটি শত্রুরাষ্ট্র পরিবেষ্টিত । গোলান মালভূমি ছাড়া দেশটির আর কোনো কৌশলগত প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর নেই। আর গোলান মালভূমিও মূলত ইসরায়েল দখল করেছে সিরিয়ার কাছ থেকে । ছোট দেশ হওয়ায় কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রতিবেশী শত্রু দেশের মিসাইল ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানতে পারে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে এস-৩০০ মিসাইল সহজে আক্রমন করতে পারে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে।
হামাসের রকেট প্রযুক্তি এবং কৌশল আগের তুলনায় বর্তমানে অনেক উন্নত। ২০০৮ সালে তিন সপ্তাহের রকেট হামলায় ইসরায়েল বিপর্যস্ত হয়েছিল। এবারেও ২০১৮ সালের মতো পরিস্থিতির মুখে পড়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস অথবা ইসরায়েল সিকিউরিটি এজেন্সি এর তথ্য অনুসারে ১৮ মে পর্যন্ত গাজা থেকে ৩ হাজার ১শ রকেট ছোড়া হয়েছে।
হামাসের রকেট প্রযুক্তি ও ব্যবহারের সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। চলমান সংঘাতে হামাস প্রতি দিন গড়ে ৪ শতাধিক রকেট নিক্ষেপ করছে ইসরায়েলে। ২০১৪ সালে তারা দিনে দুই শতাধিক রকেট নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়। চলমান যুদ্ধে তারা ৫ মিনিটে ১৩৭টি রকেট ছুড়তে সক্ষম হয়েছে । রকেটের লক্ষ্য মাত্রাও আগের তুলনায় অনেক নিখুত। হামাসের ছোড়া ৫০ ভাগ রকেট এখন ইসরায়েলের জনবসতি এলাকার জন্য হুমকি।
২০১৪ সালে হামাসের ছোড়া ১৮ ভাগ রকেট জনবসতি এলাকার জন্য হুমকি ছিল। আগে যেখানে হামাসের অনেক রকেট খোলা জায়গায় আঘাত করত এখন ৫০ ভাগ রকেট জনবসতি এলাকার জন্য হুমকি। এখন তাদের অল্প কিছু রকেট খোলা জায়গায় আঘাত করে। বাকী সব রকেট ইসরায়েলের কোন না কোন স্থাপনায় আঘাত করতে সক্ষম হচ্ছে।
একই সাথে বেড়েছে হামাসের রকেটের পাল্লা। আগের সংঘাতে হামাসের প্রায় সব রকেট আঘাত করত ইসরায়েলের দক্ষিন অঞ্চলে। বর্তমানে এসব রকেট গাজা সীমান্ত থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে রাজধানী তেল আবিবে নিয়মিত আঘাত করছে।
ইসরায়েলের দাবি তারা আয়রন ডোম মিসাইল সিস্টেমের মাধ্যমে হামাসের ৯০ ভাগ রকেট আকাশে ধ্বংস করতে সক্ষম হচ্ছে । কিন্তু নির্বিচারে ছুটে আসা হামসের সব রকেট ঠেকাতে পারছে না ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বিশ্লেষকদের মতে হামাসের কয়েকশ রকেট ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায় আঘাত করেছে এবং তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান আগের যে কোনো সংঘাতের তুলনায় অনেক বেশি।
হামাসের বর্তমান কৌশল হল শক এন্ড অ। বিশ্লেষকদের মতে হামাস বর্তমানে স্বল্প সময়ে যে পরিমান রকেট ছুড়তে সক্ষম তার সব আয়রন ডোম ঠেকাতে সক্ষম নয়। এটা আয়রন ডোম মিসাইল সিস্টেমের ক্যাপাসিটির বাইরে। তা ছাড়া সংঘাতের সময় ইসরায়েলের একটি আয়রন ডোম সিস্টেম স্বল্প সময়ের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং তখন হামাসের অনেক রকেট ইসরায়েলে আঘাত করে।
ইসরায়েলের আরেটি ডিফেন্স সিস্টেম হলো তাদের যুদ্ধ বিমান। ইসরায়েল বিমান হামলার মাধ্যমে হামাসের অনেক অস্ত্রাগার ধ্বংস করেছে কিন্তু তা রকেট হামলা বন্ধ করতে পারেনি। বিমান হামলার পরও একই গতিতে চলছে হামাসের রকেট হামলা। অপর দিকে ইসরায়েলের বিমান থেকে নিক্ষেপ করা বোমায় ধ্বংসের মাত্রা ব্যাপক। নির্বিচারে গাজায় এভাবে বোমা হামলা চালিয়ে ধ্বংস যজ্ঞ চালানো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করছে। গাজায় হামাসের ১৪ হাজার অস্ত্রাগার রয়েছে যেখানে রকেট মজুদ রয়েছে এবং তা দিয়ে তারা কয়েক মাস পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে সক্ষম।
ইসরায়েলের সকল নাগরিক বাধ্যতামূলকভাবে সৈনিক । এ কারণে সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে ইসরায়েলের আর্মি অন্যতম বড় আর্মি। কয়েক মাসের মধ্যে ইসরায়েল তার নাগরিকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে সক্ষম। কিন্তু এই সক্ষমতা একই সাথে ইসরায়েলের একটি দুর্বল দিক। কারণ নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে যুক্ত করার ফলে যুদ্ধের সময় অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাঙ্কসহ অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে। বিপর্যন্ত হবে অর্থনীতি ।
হিজবুল্লাহ লেবানন আর্মির চেয়ে শক্তিশালী। হিজবুল্লাহকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় আর্মি বিবেচনা করা হয়। তাদের আর্থিক এবং সামরিক পৃষ্ঠপোষক ইরান। হিজবুল্লাহর মূল শক্তি তাদের মিসাইল পাওয়ার। হিজবুল্লাহর কাছে ৪০ হাজার থেকে দেড় লাখ রকেট মজুদ রয়েছে যা বিশ্বের অনেক দেশের আর্মির কাছেও নেই। আর এ রকেটে মূল লক্ষ্য হলো ইসরায়েল। তাদের রয়েছে হাজার হাজার এন্টি এয়ারক্রাফট, এন্টি শিপ এবং এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল। অনেকেই একমত যে, প্রচলিত যুদ্ধে আরব দেশের কোনো আর্মি হিজবুল্লাহর মত শক্তিশালী নয়।
ইসরায়েলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হামাস। হামাস একটি রাজনৈতিক সংগঠন এবং তাদের রয়েছে মিলিটারিসহ বিভিন্ন শাখা। তারা যেমন ইসরায়েল বিরোধী তেমনি ইয়াসির আরাফাতের পিএলও-বিরোধী। হামাসের লক্ষ্য ফিলিস্তিন স্বাধীন করা, ইসরায়েলের দখলদারিত্ব মুক্ত করা। তারা ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। বর্তমান ইসরইলকেও তারা তাদের ভবিষ্যত ফিলিস্তিন নামক ইসলামিক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ২০০৬ সালের সংসদ নির্বাচনে পিএলও-ফাতাহ পার্টিকে পরাজিত করে হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অসহযোগিতার কারণে তারা সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়। বর্তমানে গাজা তাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে বৃটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং অন্যান্য বিজয়ী শক্তি মিলে গঠন করে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে আজ অবধি ইসরায়েল একের পর এক দখল করে চলছে ফিলিস্তিনীদের এলাকা এবং সেখানে গড়ে তুলছে ইহুদিদের বসতি। সর্বশেষ তারা দখলে নিয়েছে পশ্চিম তীর।
দখলদার ইসরায়েল ফিলিস্তিনীদের প্রতি তাদের ধ্বংসাত্মক আর দখল কার্যক্রমের মাধ্যমে ইসরায়েলকে একটি অনিরাপদ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি এখন ইসরায়েল বিরোধী ফিলিস্তিনি ও আরব জনতা। যা ইসরায়েলের অন্যতম একটি দুর্বলতম দিক। ইসরায়েল তার এ দুর্বলতা কোনো শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে কাটিয়ে উঠতে পারবে না । যতক্ষন না তার নীতি থেকে সরে আসে।
ইসরায়েল যদিও মিসর, জর্ডানের পর সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন আরব দেশের সাথে একের পর এক শান্তি চুক্তি করে যাচ্ছে কিন্তু দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজুবল্লাসহ প্রতিবেশি বিভিন্ন দেশের ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী।
ইসরায়েলের তেল সম্পদ নেই। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় যে শত্রু রাষ্ট্র ইরান ভাসছে তেলের ওপর। ইসরায়েলে এক গ্যালন পেট্রোলের দাম ৭ ডলার। ইসরায়েলে জীবন যাত্রার ব্যয় অতি উচ্চ।
রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা তাতে ৭০ বছর পরও ইসরায়েল আজও একটি শিশু রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না থাকলে এ রাষ্ট্র যে কোনো সময় বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে হিসেবে অনেকে ইসরায়েলকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মানতে নারাজ। অনেকের মতে এটি একটি অবৈধ রাষ্ট্র যা কয়েকটি পরাশক্তি মিলে জোরপূর্বক সৃষ্টি করেছে।
ইসরায়েলিরা অভ্যন্তরীণভাবে এক ডজনেরও বেশি বিষয়ে নিজেদের মধ্যে চরমভাবে বিভক্ত। রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক ইসরায়েলি একে অপরের ঘোরতর শত্রু। আরব-ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব ছাড়াও তাদের কেউ উদারপন্থী, কেউ কট্টরপন্থী, কেউ গণতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ সংস্কারপন্থী, কেউ লিবারেল, কেউ ধার্মিক কেউ সেকুলার। এর সাথে আছে জাতি ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব।
ইসরায়েলের কাছে বিপুল সংখ্যক এফ-৩৫ ও এফ-১৬ জঙ্গি বিমান রয়েছে। ইসরায়েল আর্মির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিমান যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। ইসরায়েল শুধুমাত্র ড্রোন বিমান বানাতে সক্ষম।