ভৌগলিকভাবে তুরস্ক আর ইসরায়েলের দূরত্ব অনেক। দেশ দুটির কোনো যৌথ সীমান্ত নেই। স্থলপথে দেশ দুটির মাঝখানে রয়েছে আরও দুটি দেশ- সিরিয়া ও লেবানন। সমুদ্রপথে দুই দেশের মাঝখানে ভূমধ্যসাগরের বিশাল জলরাশি। ভৌগলিক অবস্থানের মতো রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকেও দেশ দুটির মধ্যে আছে নানামুখী দূরত্ব। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে বিভিন্ন সময় হয়েছে বাগযুদ্ধ।
তুরস্ক ১৯৪৯ সালে প্রথম মুসলিম দেশ যেটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। অবশ্য তারও আগে তুরস্কের ওসমানীয় খিলাফাতের যুগে সুলতান দ্বিতীয় বায়েজীদ প্রচুর সংখ্যক ইহুদি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। যে কারণে ইহুদিরা বহুবছর ওসমানীয় সম্রাটদের অনুগত হিসেবেই পরিচিত ছিলো। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পরের বছরই তুরস্ক স্বীকৃতি দেয়। সে সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন কামাল আতাতুর্কের উত্তরসূরী ইসমেত ইনুনু। আর তুরস্ক তখন পুরোপুরি পশ্চিমা অনুগত এক রাষ্ট্র। ২০০২ সালে এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পরও প্রথম দিকে সম্পর্ক এগিয়েছে স্বাভাবিকভাবে। ২০০৮ সালে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর থেকে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
সামরিক দিক থেকেও দুই দেশের অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের আশির্বাদ নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাতে ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাজেটের বড় অংশই বরাদ্দ থাকে ইসরায়েলের সামরিক উন্নতির জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সরঞ্জাম, প্রযুক্তি, বিশেষজ্ঞসহ সব দিক থেকেই সহযোগিতা পেয়ে আসছে ইসরায়েল।
অন্যদিকে নিজস্বভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার অনন্য এক উদাহরণ তুরস্ক। রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে সামরিক খাতে পশ্চিমা নির্ভরতা কাটিয়ে উঠার মহাপরিকল্পনা নেয় তুরস্ক। যার ফল হিসাবে দেশটি প্রতিরক্ষা সামগ্রী রফতানিও করছে। স্থল, নৌ, আকাশ সব সেক্টরেই শীর্ষস্থানীয় শক্তিগুলোর সাথে সমানতালে এগিয়ে চলছে দেশটি।
সামরিক শক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের র্যাঙ্কিংয়ে দুই দেশের পার্থক্য অনেক। এই তালিকায় তুরস্কের অবস্থান বিশে^ এগারো নম্বরে, আর ইসরায়েল আছে ২০-এ। ওয়েবসাইটির তথ্য মতে, তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাজেট এক হাজার ৭৩০ কোটি মার্কিন ডলার। ইসরায়েলের যা এক হাজার ৬৬০ কোটি মার্কিন ডলার। আসুন দেখে আসি দুদেশের সামরিক শক্তির চিত্র।
তুরস্কের সামরিক বাহিনীর মোট জনবল ৮ লাখ ৯৫ হাজার, যার মধ্যে সক্রিয় সদস্য ৩ লাখ ৫৫ হাজার, রিজার্ভ সদস্য ৩ লাখ ৮০ হাজার। তুরস্ক বিশে^র সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। জোটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী তুরস্কের। শুধু সংখ্যার দিক থেকেই নয়, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও নৈপুণ্যেও তারা বিশে^র শীর্ষস্থানীয় বাহিনীর একটি।
এরদোগান সরকার তুরস্কের প্রতিরক্ষাখাতে যে ব্যাপক আধুনিকায়ন করেছে তার ছোয়ায় তুর্কি সেনাবাহিনী অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে। অবশ্য ২০১৫ সালের অভ্যুত্থান চেষ্টার পর দেশটির সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই ধাক্কা সামলে তুর্কি সেনাবাহিনী কতটা গুছিয়ে উঠতে পেরেছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রতিরক্ষা বাজেটের মতো লোকবলেও পিছিয়ে রয়েছে ইসরায়েল। তাদের সশস্ত্র বাহিনীর মোট সদস্য ৬ লাখ ৪৩ হাজার। যার মধ্যে সক্রিয় সদস্য ১ লাখ ৭০ হাজার। রিজার্ভ সদস্য ৪ লাখ ৬৫ হাজার।
স্থলযুদ্ধের জন্য সমরাস্ত্রের দিক থেকেও দুই দেশের ব্যবধান অনেক। তুরস্কের ট্যাংক রয়েছে ৩ হাজার ৪৫টি, আর ইসরায়েলের আছে ১ হাজার ৬৫০টি। সাজোয়া যান তুরস্কের ১১ হাজার ৬৩০টি, ইসরায়েলের ৭ হাজার ৫০০টি।
সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি বা ভ্রাম্যমান কামান তুরস্কের৯৪৩টি, ইসরায়েলের ৬৫০টি। টাউড আর্টিলারি বা অন্য যানবাহনের ওপর স্থাপনযোগ্য কামান সংখ্যা তুরস্কের ১ হাজার ২০০টির বিপরীতে ইসরায়েলের আছে ৩০০টি। আর তুরস্কের রকেট প্রজেক্টাইল ৪০৭টি, ইসরায়েলের যা আছে ১০০টি।
বিমান বাহিনীর তুলনামূলক আলোচনায় ইসরায়েলকে এগিয়ে রাখতে হবে। তুর্কি বিমান বাহিনীর মোট বিমান সংখ্যা ১ হাজার ৫৬টি, যার মধ্যে ফাইটার জেট ২০৬টি। অ্যাটাক হেলিকপ্টার রয়েছে ১০৪টি। ইসরায়েলের মোট ৫৯৫টি এয়ারক্রাফটের মধ্যে ফাইটার জেট ২৪১টি, অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৪৮টি।
উভয় দেশেরই রয়েছে এফ সিক্সটিন ফাইটিং ফ্যালকন জেট। তুরস্কের রয়েছে ২৪৫টি, যার মধ্যে ৮৭টি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। আর ইসরায়েলের রয়েছে ১৭৫টি। প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনলেও, পরবর্তীতে নিজেরাই এটির উৎপাদন শুরু করে আঙ্কারা। বিশে^র যে ৫টি দেশ এফ-সিক্সটির ফাইটার তৈরি করে, তাদের একটি তুরস্ক। দেশটির তৈরি এফ সিক্সটিনের প্রধান ক্রেতা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এছাড়া ৪৮টি এফ-ফোর প্যান্থম ফাইটার রয়েছে তুরস্কের বহরে। রয়েছে বেশ কিছু বোম্বার এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের তৈরি অন্যান্য মিলিটারি এয়ারক্রাফট।
ইসরায়েলের ফাইটার বহর তুরস্কের চেয়ে কিছুটা সমৃদ্ধ। এফ সিক্সটিন ছাড়াও দেশটির রয়েছে ১৬টি এফ-ফিফটিন ঈগল ও ২৫টি এফ ফিফটিন স্ট্রাইক ঈগল। আছে অ্যাপাচিসহ বেশ কয়েক ধরনের অ্যাটাক হেলিকপ্টার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ ফাইটার এফ - থার্টিফাইভ এর ২৩টি বিমান পেয়েছে ইসরায়েল। তুরস্কও একই প্রোগ্রামে থাকলেও রাশিয়ার কাছ থেকে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার কারণে তাদের বিমানগুলো সরবরাহ স্থগিত রেখেছে ওয়াশিংটন।
ড্রোন শিল্পে উভয় দেশই একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়েযেতে চেষ্টা করছে। তুরস্কের ড্রোন শিল্প গত কয়েক বছরে রীতিমতো বিপ্লব করেছে। দেশটির বেরাকতার টিবি টু ড্রোন আনম্যানড এরিয়াল ভেহিলেক জগতে রীতিমতো তারকা। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু দেশের কাছে এই ড্রোন রফতানিও করেছে তুরস্ক। নাগোরনো-কারাবাখের যুদ্ধে ড্রোনটি তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এছাড়া বেরাকতার আকিঞ্চি নামের আরেকটি সর্বাধুনিক অ্যাটাক ড্রোন শীঘ্রই যুক্ত হবে তুর্কি বিমান বাহিনীতে।
ড্রোন বহরে শক্তি অর্জন করেছে ইসরায়েলও। তাদের হেরন, এইতান, হারপিসহ বেশ কিছু অ্যাটাক ড্রোন রয়েছে যেগুলো ইসরায়েলি এয়ার অ্যাটাককে সমৃদ্ধ করেছে।
তুরস্কের বিমান বাহিনীর কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেশ কিছু আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়া দেশটি নিজেরাও বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এজিএম-এইটি ফোর, স্টানফোর্ড ক্রুজ মিসাইল রয়েছে তুরস্কের। এছাড়া এজিএম-এইটি এইট এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল ছাড়াও নিজস্ব তৈরি তিন ধরণের এয়ার টু সারফেস মিসাইল ব্যবহার করছে তুরস্ক।
এয়ার টু এয়ার মিসাইলের ক্ষেত্রে তুরস্কের কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এআইএম-১২০, স্প্যারো ও সাইডউইন্ডার। নিজস্ব তৈরি গোকদোকান ও বোজদোকান নামের দুটি মিসাইল যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইল।
ইসরায়েলের কাছে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি মাভেরিক, হেলফায়ার ও পাইথন এয়ার টু সারফেস মিসাইল। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র আছে ইসরায়েলের কাছে। তুরস্ক এই প্রতিরক্ষা সামগ্রী কিনতে চেয়েও পায়নি ওয়াশিংটনের কাছ থেকে। এছাড়া ইসরায়েলের রয়েছে জেরিকো টু ও জেরিকো থ্রি নামের দুই ধরণের ব্যালেস্টিক মিসাইল। দ্বিতীয়টি পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্কের কোনো ব্যালেস্টিক মিসাইল নেই।এছাড়া ইসরায়েলের মতো পারমাণবিক অস্ত্রও নেই দেশটির হাতে। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে দেশটির হাতে ৮০টির বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ক্ষেত্রে তুরস্ক হাতে পেয়েছে রাশিয়ার তৈরি সর্বাধূনিক এস-ফোর হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। যেটি কেনা নিয়ে দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ চলছে গত কয়েক বছর ধরে। এই প্রতিরক্ষা সামগ্রীটিকে বলা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত বিশে^র সবচেয়ে নিরাপদ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম। এস-ফোর হান্ড্রেডকে ফাঁকি দিয়ে তুরস্কের আকাশ সীমায় শত্রুর মিসাইল কিংবা বিমান প্রবেশ করা কঠিন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমআইএম-টুয়েন্টি থ্রি, স্ট্রিঞ্জার ও নিজস্ব উৎপাদিত হিসার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম আছে তুরস্কের।
ইসরায়েলের আছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হক ও নিজস্ব তৈরি আয়রন ডোম, ডেভিড স্লিং ও অ্যারো মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। এর মধ্যে অ্যারো হচ্ছে এন্টি ব্যালেস্টিক মিসাইল।
নৌ শক্তিতে অনেক এগিয়ে আছে তুরস্ক। দেশটির মোট সামরিক নৌ যান ১৪৯টি, আর ইসরায়েলের সেই সংখ্যা মাত্র ৬৫টি। কোনো দেশেরই নেই বিমানবাহী রণতরী। তুরস্কের ফ্রিগেট আছে ১৬টি, কর্ভেট ১০টি। ইসরায়েলের কোনো ফ্রিগেট নেই, কর্ভেট ৪টি। আসুন দেখে আসি দুদেশের নৌশক্তি চিত্র।
তুর্কি নৌ বাহিনীর ১২টি সাবমেরিনের বিপরীতে ইসরায়েলের সাবমেরিন ৫টি। মাইন ওয়ার ফেয়ার বোট তুরস্কের আছে ১১টি, ইসরায়েলের একটিও নেই।
ইসরায়েলের সাথে সামরিক সঙ্ঘাত বাধলে তুরস্ক এগিয়ে থাকবে তার বিশাল নৌ বহর ও সাইপ্রাসের সামরিক ঘাঁটির কারণেই। সাইপ্রাস থেকে তুর্কি ফাইটার আকাশে উড়লে তারা সহজেই ইসরায়েলের পৌছতে পারবে। আবার ভূমধ্যসগারের বিশাল সমুদ্রসীমায় তুর্কি যুদ্ধজাহাজগুলো থেকে হামলা শুরু হলে বিপদে পড়তে হবে ইহুদিবাদী দেশটিকে। অন্যদিকে ইসরায়েল বিমান শক্তিতে এগিয়ে থাকলেও এত দূরত্ব অতিক্রম করেতুরস্কের ভূখণ্ডে গিয়ে হামলা করার সহজ হবে না তাদের জন্য।
অবশ্য সামরিক সঙ্ঘাতে এখন শুধু শক্তির বিচার দিয়ে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না। এর সাথে থাকে মিত্রদেশগুলোর সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব, ভৌগলিক পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি সৈন্যদের সাহসীকতা আর আত্মত্যাগের মানসিকতা।