সামরিক দিক দিয়ে ইসরায়েল কতটা শক্তিশালী


  • মেহেদী হাসান
  • ২৪ মে ২০২১, ১৩:৪০

পারমাণবিক বোমার কারণে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। ইসরায়েলের রয়েছে নিজস্ব উদ্ভাবিত ব্যালিস্টিক মিসাইল। ইসরায়েলের মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কসহ আরও বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী সমরাস্ত্র তাদের নিজস্ব তৈরি। ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ, রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম লিমিটেড, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজসহ শক্তিশালী কয়েকটি সমরাস্ত্র শিল্প রয়েছে ইসরায়েলের। সমরাস্ত্র এবং সমরপ্রযুক্তির কারণে ইসরায়েল সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিবেচিত।

ইসরায়েলের সমরাস্ত্র এবং সমরপ্রযুক্তির পেছনে রয়েছে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সমস্ত যুদ্ধ বিমান যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। ইসরায়েলের নিজস্ব উদ্ভাবিত ব্যালিস্টিক মিসাইল থাকলেও তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই ধরনের ব্যালিস্টিক মিসাইল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে তৈরি। ইসরায়েল শক্তিশালী দেশ হলেও অনেকের মতে ইসরায়েল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রক্সি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এক ও অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব প্রশ্নসাপেক্ষ।

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ইসরায়েলের অবস্থান বিশ্বে ২০তম। ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯৩ লাখ। সৈন্য সংখ্যা ৬ লাখ ৪৩ হাজার। সক্রিয় সৈন্য ১ লাখ ৭০ হাজার। রিজার্ভ সৈন্য ৪ লাখ ৬৫ হাজার। প্যারা মিলিটারি ৮ হাজার। ইসরায়েলের সকল নাগরিক বাধ্যতামূলকভাবে সৈনিক। যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রের আদেশে যে কোনো নাগরিক যুদ্ধে যেতে বাধ্য।

ইসরায়েলের মোট ট্যাঙ্ক সংখ্যা ১ হাজার ৬৫০টি। সাঁজোয়া যান ৭ হাজার ৫০০। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ৬৫০টি। টাউড আর্টিলারি ৩০০টি। রকেট প্রজেক্টর ১০০টি।

স্থলবাহিনীর বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং ভেহিক্যাল ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাথে যৌথভাবে নির্মাণ করে। এছাড়া রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আরমারড রিকোভারি ভেহিক্যাল এবং আরমারড ব্রিজ লেয়ার।

ইসরায়েলের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি নির্মাণ করে হেভি আরমারড কমব্যাট ভেহিক্যাল বা পারসোনাল ক্যারিয়ার।

ইসরায়েলের মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক মারকাভা তাদের নিজস্ব তৈরি। এর রয়েছে চারটি সংস্করন। ইসরায়েলের কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি কয়েক ধরনের শক্তিশালী রকেট ও গ্রেনেড লঞ্চার। ইসরায়েল নিজেও দুই ধরনের রকেট ও গ্রেনেড লঞ্চার তৈরি করে। ইসরায়েলের স্থল বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের মেশিন গান, সাব মেশিন গান, এসল্ট রাইফেল ও রাইফেল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

ইসরায়েল নিজেও কয়েক ধরনের রাইফেল অ্যাসল্ট রাইফেল ও মেশিন গান ও সাব মেশিন গান তৈরি করে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পিস্তল জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, বেলজিয়া, অস্ট্রিয়া থেকে আমদানী করে ইসরায়েল।

আধুনিক যুদ্ধ বিমানের ক্ষেত্রে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যর যে কোনো দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ইসরায়েলের মোট সামরিক বিমানের সংখ্যা ৫৯৫টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ২৪১টি। ডেডিকেটেড এটাক ২৩টি। সামরিক পরিবহন বিমান ১৫টি। প্রশিক্ষন বিমান ১৫৪টি। স্পেশাল মিশন ২৩টি। এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার ১১টি। হেলিকপ্টার ১২৮টি। এটাক হেলিকপ্টার ৪৮টি। আসুন দেখে আসি ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর চিত্র

ইতালি ও জার্মানির কয়েকটি প্রশিক্ষন বিমান ছাড়া ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর সকল বিমান যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। ইসরায়েলের বিমান বাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার এফ-৩৫ রয়েছে ২৭টি। আরো ৫০টি সংগ্রহের অপেক্ষায় রয়েছে ।

যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্থ জেনারেশন মাল্টিরোল জঙ্গি বিমান এফ-১৬ রয়েছে ২১৬টি। আধুনিক এফ-১৬ ই স্ট্রাইক ঈগলসহ এফ-১৬ ফাইটার জেটের তিনটি ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে ইসরায়েলের কাছে।

ইসরায়েলের কাছে এয়ারবর্ণ আর্লি ওয়ার্ণিং এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম বিমান রয়েছে ৪টি, রিকনিস্যান্স বিমান রয়েছে ২১টি। লকহিড মার্টিনের সি-১৩০ হারিকিউলিস ও সুপারি হারকিউলিস রয়েছে ১৩টি। ফ্রান্সের তৈরি ৫টি ইউরোকপ্টার বাদে ইসরায়েলের সকল হেলিকপ্টারও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি শক্তিশালী এপাচি হেলিকপ্টার রয়েছে ৪৮টি। সিকরস্কি পরিবারের হেলিকপ্টার রয়েছে ৭১টি। হেরনসহ ইসরায়েলের নিজস্ব তৈরি চার ধরনের ড্রোন বিমান রয়েছে। ইসরায়েলের বিমান বাহিনীতে নিজস্ব তৈরি কোনো বিমান ও হেলিকপ্টার নেই।

ইসরায়েলের কাছে রয়েছে অ্যারো নামক শক্তিশালী এন্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল। শত্রু রাষ্ট্রের ব্যালিস্টিক মিসাইল আক্রমন প্রতিহত করা এর কাজ। এন্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল অ্যারো নির্মাণ করেছে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং। এর অর্থায়নও করেছে দুই দেশ। অ্যারোর সর্বোচ্চ অপারেশন রেঞ্জ ৯৩ মাইল। সর্বোচ্চ গতি ম্যাক-৯।

ইসরায়েলের কাছে ডেভিড স্লিং নামে এক ধরনের শক্তিশালী এন্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। এটি একই সাথে সারফেস টু এয়ার মিসাইল। ডেভিড স্লিং একটি মাঝারি থেকে দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল। এ মিসাইলেরও নির্মাতা যৌথভাবে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের রাফায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের রেথিয়ন নামের সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডেভিড মিসাইল তৈরি করে। ডেভিড মিসাইল যুদ্ধ বিমান, এন্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল, ক্রুজ মিসাইল, রকেট এবং ড্রোন বিমান ভূপাতিত করতে সক্ষম। এর সর্বোচ্চ পাল্লা ১৮৬ মাইল।

ইসরায়েলের নিজস্ব উদ্ভাবিত বিখাত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হলো আয়রন ডোম। এটি মূলত একটি এন্টি রকেট মিসাইল। হিজুবল্লাহ, হামাসসহ পাশ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রের বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীর ছোড়া স্বল্প পাল্লার রকেট এবং আর্টিলারি শেল প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইসরায়েল উদ্ভাবন করেছে আয়রন ডোম মিসাইল।

ইসরায়েলের দাবি মিলিশিয়া বাহিনীর ৯০ ভাগ রকেট হামলা আকাশে প্রতিহত করতে সক্ষম আয়রন ডোম। আয়রন ডোমের নির্মাতা ইসরায়েলের রাফায়েল এবং অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ । ৪ থেকে ৪৩ মাইল দূরের রকেট ও শেল আকাশে ধ্বংস করতে সক্ষম আয়রন ডোম। আয়রন ডোম মোবাইল এবং সকল আবহাওয়ায় ব্যবহার উপযুক্ত।

এছাড়া ইসরায়েলের কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মিম প্যাট্রিয়ট ও মিম হক মিসাইল। এ গুলো সারফেস টু এয়ার মিসাইল এবং এন্টি ব্যালিসিটক মিসাইল।

ইসরায়েলের নিজস্ব উদ্ভাবিত শক্তিশালী ব্যালিস্টিক মিসাইলের নাম লোরা। এটি একটি থিয়েটার কোয়াসি ব্যালিস্টিক মিসাইল। এর অপারেশন আওতা আড়াইশ মাইল। লোরার নির্মাতা ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। লোরা মিসাইলের গতি হাইপারসনিক।

স্পাইকসহ ইসরায়েলের রয়েছে ৫ ধরনের নিজস্ব উদ্ভাবিত এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল। এছাড়া রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগন নামক এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল।

ইসরায়েলের কাছে রয়েছে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত দীর্ঘ পাল্লার আর্টিলারি রকেটসহ কয়েক ধরনের রকেট। এছাড়া রয়েছে নিজস্ব উদ্ভাবিত এন্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল, মিসাইল লঞ্চিং ভিহিক্যাল, মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, সেলফ প্রপেল্ড মর্টারসহ বিভিন্ন ধরনের মর্টার, সেলফ প্রপেল্ড হাউইজারসহ কয়েক ধরনের হাউইজার এবং ট্যাঙ্ক ডেস্ট্রয়ার।

ইসরায়েলের নৌ বাহিনীর মোট রণতরীর সংখ্যা ৬৫টি। এর মধ্যে করভেট ৪টি, সাবমেরিন ৫টি এবং টহল জাহাজ ৪৮টি। তাদের কোনো ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, হেলিকপ্টার ডক এবং বিমানবাহনী রণতরী নেই। আসুন জেনে আসি ইসরায়েলের নৌ ও সামরিক শক্তির আরো কিছু তথ্য।

ইসরায়েলের কাছে থাকা চারটি করভেটের তিনটি যুক্তরাষ্ট্রের এবং একটি জার্মানির তৈরি। এছাড়া ৫টি সাবমেরিনের সবগুলোই জার্মানির তৈরি। এগুলো ডলফিন ক্লাস সাবমেরিন এবং ডিজেল ইলেকট্রিক চালিত। ইসরায়েলের রয়েছে তাদের নিজস্ব তৈরি আট ধরনের শক্তিশালী মিসাইল বোট। এছাড়া ইসরায়েলের সকল টহল জাহাজও তাদের নিজস্ব তৈরি।

ইসরায়েল একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ইসরায়েলের কাছে ৮০ থেকে ৪০০টি পারমাণবিক বোমা মজুদ থাকতে পারে। এসব বোমা ইসরায়েল যুদ্ধ বিমান, ব্যালিস্টিক মিসাইল ও সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপ করতে সক্ষম। পারমাণবিক বোমা থাকার কথা ইসরায়েল আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি। তবে অস্বীকারও করছে না।

সামরিক দিক দিয়ে ইসরায়েল যতই শক্তিশাল দেশ হোক না কেন এটি তার চারদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত একটি দেশ। মিশর, জর্ডানের পর সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন আরব দেশের সাথে একের পর এক শান্তি চুক্তি করলেও দেশটিতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শান্তি সুদুর পরাহত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বিজয়ী শক্তি ইসরায়েল নামক দেশটির জন্ম দেয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনীদের ভূমি দখল করে সীমানা বাড়িয়ে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ফিলিস্তিনীদের প্রতি চালিয়ে যাচ্ছে হত্যা, উচ্ছেদ আর ধ্বংসের মিশন। এর প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনে গড়ে উঠেছে হামাসের মত সংস্থা যারা ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়।

ইসরায়েলের আশপাশে বিভিন্ন দেশে ইরান গড়ে তুলেছে হিবুল্লাহর মত বিভিন্ন ধরনের মিলিশিয়া বাহিনী। এসব মিলিশিয়া বাহিনীর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইরান।

আরবদের সাথে প্রতিবার যুদ্ধে ইসরায়েলের নাগরিকরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে এই বুঝি ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মুছে গেল। কিন্তু ১৯৭৩ সালসহ বিভিন্ন সময় আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে বাঁচাতে বারবার এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় ছাড়া রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে পারে বলে অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন।