ইসরায়েলের সাথে এবারের সঙ্ঘাত চলাকালে হামাস যোদ্ধারা দেশটি লক্ষ্য করে গাজা ভূখণ্ড থেকে হাজার হাজার রকেট ছুড়েছে। এসব রকেটের বেশির ভাগই ইসরায়েল আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্যে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু হামাস এবার সাগরে নতুন ধরনের এমন কিছু অস্ত্রের ব্যবহার করেছে, যেগুলো ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের নজর কেড়েছে। হামাসের সমুদ্রগামী এসব স্টেলথ অস্ত্র এবং সংগঠনটিকে ইরানের সহযোগিতা ইসরায়েলের জন্য নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
সাগরে হামাস নতুন তিন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে। প্রথমত, সাগরে কমান্ডো অভিযান পরিচালনা ও সমুদ্রপথে গাজায় অস্ত্র পাচার করে আনার জন্য ব্যবহৃত কমান্ডো আন্ডারওয়াটার সুইমার্স। পানির নিচে সাতার কাটার যান ব্যবহারে এটা কাজে লাগানো হয়। দ্বিতীয়ত, বিস্ফোরক ভর্তি আধা স্বয়ংক্রিয় ছোট নৌকা এবং সর্বশেষটি হচ্ছে সাগরে পানির নিচে ব্যবহৃত মনুষ্যবিহীন বড় ধরনের যান বা আনম্যান্ড আন্ডারওয়াটার ভেহিক্যাল।
এবারের সঙ্ঘাত চলাকালে ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলি তেল টার্মিনাল ও রীগে হামলার জন্য হামাস একটি মনুষ্যবিহীন সাবমেরিন পাঠায়। কিন্তু ইসরায়েলি নৌ ও বিমানবাহিনী সেটি ধ্বংস করে দেয়। মিডিয়ার কাছে ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর পাঠানো একটি ভিডিওতে একটি বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখা যায়, যার মাধ্যমে এ ধরনের একটি ইউইউভি ধ্বংস হয়েছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ইউইউভি ধ্বংস হওয়ার পর একটি ছোট সাদা গাড়ি পালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় একটি বিস্ফোরণে গাড়িটি ধ্বংস ও এর চালক নিহত হন। গাড়ির ধ্বংসস্তূপের একটি ছবিও ভিডিওতে দেখানো হয়।
ড্রোনটি পাঠানো হয়েছিল ইসরায়েলি স্থাপনায় হামলা করার জন্য। সম্ভবত সাগরতীর থেকে কিছুু দূরে পানিতে স্থাপিত তামার ন্যাচারাল গ্যাস রীগে হামলার জন্যই এটি পাঠানো হয়েছিল। এই রীগের সাহায্যে পাঁচটি কূপের গ্যাস উত্তোলন করা হয়ে থাকে। গাজায় হামাসের সাথে যুদ্ধের কারণে সাগরে স্থাপিত ইসরায়েলের সবগুলো গ্যাস প্ল্যাটফর্ম বন্ধ রাখা হয়। ইউইউভি দিয়ে হামলার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণে হামাস তামার রীগে রকেট হামলারও চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সেটির লক্ষ্যবস্তুতে হামলার নিখুঁত নিশানা না থাকায় তা রীগে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। এরপর হামাস কয়েকবার অব্যর্থ লক্ষ্যভেদি ড্রোন হামলা চালায়। ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর পাইথন-৫ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে অন্তত দুটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তৃতীয় ড্রোনটি আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্যে ধ্বংস করেছে ইসরায়েল।
সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে হামাসের কাছে এসব ইউইউভি কোথা থেকে এলো। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর বরাত দিয়ে দেশটির মিডিয়া বলছে, এসব ইউইউভি আসলে বড় ধরনের বাণিজ্যিক যান। এগুলোকে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনী বলছে, হামাসের ইউইউভিগুলো ছিল আকারে একটু বড় ধরনের। এগুলোতে ৩০ থেকে ৫০ কেজি বিস্ফোরক ব্যবহার করা যায়, যা একটি তেল টার্মিনাল ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তবে এটি শত্রুপক্ষের মনে বড় ধরনের আতঙ্ক বা উদ্বেগ তৈরি করতে সক্ষম। হামাসের জন্য এটি বড় ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিজয়।
শুধু গ্যাস প্ল্যাটফর্ম নয়, ইসরায়েলের অন্যান্য স্থাপনায়ও হামাস ইউইউভি দিয়ে হামলা করেছে। সংগঠনটির অস্ত্র ভান্ডারে আরও কোনো ইউইউভি আছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন দেশ বাণিজ্যিকভাবে ইউইউভি উৎপাদন করে থাকে। বাণিজ্যিক বিভিন্ন কাজে এগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে আছে সাগর তলদেশের ম্যাপ তৈরি, পাইপলাইন ও পানির নীচের অবকাঠামো পরিদর্শন, সাগরে জরীপ কাজ পরিচালনা।
বাণিজ্যিক ও সামরিক উভয় ইউইউভিই দেখতে প্রায় একই রকমের। সামরিক ইউইউভিগুলোকে বিভিন্নভাবে অস্ত্রসজ্জিত করা যায়। এরমধ্যে আছে গভীর পানিতে মাইন স্থাপন, টরপেডে ও ক্ষেপনাস্ত্র ছোড়া, আত্মঘাতী হামলা চালানো।
গাজার ইউইউভি গুলো আত্মঘাতী হামলা চালানোর ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ একবার ব্যবহারের অস্ত্র হিসেবে বানানো হয়েছে। ইসরায়েলি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, এসব ইউইউভি স্বয়ংক্রিয়। কিন্তু এ তথ্য সঠিক নয়। হামাসের যোদ্ধারা সম্ভবত: সাগর তীর থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
হামাস স্থলে এবং সাগরে মনুষ্যবিহীন যান ব্যবহারের চেষ্টা করে আসছে। ২০১৪ সালে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধে গাজা ভূখণ্ড থেকে প্রথমবারের মতো আবাবীল নামে একটি ইউইউভি ব্যবহার করে হামাস। এটির ডিজাইন করেছিলেন তিউনিশিয়ার অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার মোহম্মদ জাউরি। তিনি হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদ্দিন আল কাসাম ব্রিগেডের পক্ষে কাজ করতেন। তিউনিশিয়ার সাফাক্সে বসে তিনি ইউইউভিটির ডিজাইন করেন এবং সেখানেই তৈরি করা হয়। পরে ইরানের সাথে তথ্য বিনিময় করা হয়। মোহাম্মদ জাউরি ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিউনিশিয়ার সাফাক্সেই আততায়ীর হাতে নিহত হন।
হামাসের ইউএভি ও ইউইউভি গুলো প্রথম প্রজন্মের প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়েছিল। এজন্য এগুলো পরিচালনা করতে লোকের প্রয়োজন হতো। বর্তমানে ইরান বড় ধরনের সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ইউইউভি নির্মাণ করেছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরবের খুরাইস ও আবকাইক তেল স্থাপনায় হামলা করে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা। এই হামলায় নিজেদের তৈরি ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র ও মনুষ্যবিহীন ড্রোন ব্যবহার করে দেশটি। অন্যগুলোর চেয়ে এই ড্রোনের বিশেষত্ব হচ্ছে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালানো যায়। দৃশ্যপটের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রযুক্তিও সম্ভবত এতে দেয়া আছে। এর ফলে ড্রোনটি অত্যন্ত কার্যকর ও নিখুতভাবে লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। হামাস প্রাথমিকভাবে তার অস্ত্রের প্রযুক্তি সংগ্রহ করে ইরান থেকে। কাজেই হামাসেরও নিখুতভাবে হামলার জন্য ইউএভি ও ইউইউভি এর প্রযুক্তি ইরানের কাছ থেকে পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এবার গাজা থেকে শক্তিশালী ও বৃষ্টির মতো রকেট হামলা এবং ড্রোন ও জলজ ড্রোনের ব্যবহার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য বিরাট নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এজন্য হামাসকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস বা নির্মূল করার চাপ তৈরি হয়েছে সেনাবাহিনীর উপর। কিন্তু গাজা ভূখণ্ড সম্পূর্ণ দখল করা ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ভবিষ্যতে জলজ ড্রোন বা ইউইউভি’র ব্যবহার যে অনেক বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর অর্থ হচ্ছে ইসরায়েলের উপকূলীয় এলাকা, সাগরে তেলের প্ল্যাটফর্ম, নৌবাহিনীর জাহাজ এবং সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলাও বাড়বে। কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই স্পর্শকাতর স্থাপনার সার্বক্ষনিক নজরদারি করা, যুদ্ধবিমান মোতায়েন বা সাবমেরিনবিরোধী জাহাজ মোতায়েন করে রাখা সম্ভব হবেনা। যদি সব ধরনের স্পর্শকতর স্থাপনায় পূর্ব সতর্কীকরণ যন্ত্রপাতি বসানো বা এগুলোর চারপাশে শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা না হয় তাহলে এগুলোর নিরাপত্তা সব সময় হুমকির মুখে থাকবে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জলজ ড্রোন গুলো মাছ ধরা নৌকা কিংবা সাগরে চলাচলকারি অন্যান্য নৌযানে বহন করে হামলার টার্গেট করা স্থাপনার কাছে পানিতে ফেলা সম্ভব। সম্প্রতি দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরক ভর্তি একটি নৌকা লোহিত সাগরে সৌদি আরবের ইয়ানবু বন্দরে আঘাত হানে। বন্দরটি জেদ্দা থেকে ৩০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এটি সৌদি আরবের একটি গুরুত্বপূর্ণ তেল বন্দর এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের এলাকা থেকে অনেক দূরে। হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক ভর্তি নৌকাটি লোহিত সাগরে বড় কোনো নৌযান থেকে পানিতে ফেলা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এ ধরনের হামলার ঘটনায় এটা নিশ্চিত যে আগামীতে ইসরায়েলকে নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। হামাসের এবারের রকেট বৃষ্টি ও ইউইউভি হামলায় বিপর্যস্ত ইসরায়েল তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে হামাসও হাত গুটিয়ে বসে থাকবেনা। তারাও আরও উন্নত প্রযুক্তি অস্ত্র তাদের অস্ত্রের ভান্ডারে যুক্ত করে ইসরায়েলের হামলার উপযুক্ত জবাব দেবে।