সৌদি আরবের সামরিক সামর্থ্য কেমন


  • মেহেদী হাসান
  • ২৬ মে ২০২১, ১৫:০২

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে সৌদি আরবের অবস্থান বিশ্বে ১৭তম। সৌদি আরবের প্রায় সব সমরাস্ত্র আমদানি করা। গত পাঁচ বছর ধরে সৌদি আরব বিশ্বের শীর্ষ সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ। সৌদি আরবের নিজস্ব তৈরি তিনটি সমরাস্ত্র রয়েছে। এগুলো হলো- সাকার ড্রোন বিমান এবং দুই ধরনের আরমারড ভেহিক্যাল। এছাড়া চীন, রাশিয়া, জার্মানি এবং চেক রিপাবলিকের সাথে যৌথভাবে রাইফেল, সামরিক ট্রাকসহ কয়েকটি ক্ষুদ্রাস্ত্র নির্মাণ করে। এর বাইরে সৌদি আরবের স্থল, বিমান এবং নেভির সব সমরাস্ত্র বিদেশ থেকে কেনা।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবের মোট সৈন্য সংখ্যা ৫ লাখ ৫ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সৈন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার। প্যারামিলিটারি ২৫ হাজার। সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

সৌদি আরবের সমরাস্ত্র মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সৌদি আরবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমরাস্ত্র হলো ইউরো ফাইটার টাইফুন।

সৌদি আরবের বিমানবাহিনীর বিমানের সংখ্যা ৮৮৯টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ২৭৯টি। ডেডিকেটেড অ্যাটাক ৮১টি। সামরিক পবিহন বিমান ৫০টি। প্রশিক্ষণ বিমান ১৮৬টি। স্পেশাল মিশন ১৩টি। রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার ৩৫টি। সৌদি আরবের সামরিক হেলিকপ্টারের সংখ্যা ২৫৮টি। অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩৪টি।

সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৫ ফাইটার জেট রয়েছে ২৪৮টি। আরো ২৫টি এফ-১৫ বিমানের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এফ-১৫ ঈগলসহ কয়েক ধরনের এফ -১৫ বিমান রয়েছে সৌদি আরবের কাছে।

সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৫ বিমান রয়েছে ৯৮টি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কেসি- ১৩০ সি হারকিউলিসসহ কেসি-১৩০ সিরিজের বিমান রয়েছে ৪২টি। আরো ২৩টি কেসি-১৩০ সি বিমান অর্ডার দিয়েছে সৌদি আরব। লকহিড মার্টিনের কেসি-১৩০ সি মূলত সামরিক পরিবহন বিমান এবং এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার।

সৌদি আরবের কাছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপের যৌথ বিমান ইউরো ফাইটার টাইফুন রয়েছে ৭২টি। ২০১৮ সালে তারা আরো ৪৮টি কেনার অর্ডার দেয়। ইউরো ফাইটার টাইফুন একটি ফোর্থ জেনারেশন শক্তিশালী ফাইটার জেট। ইউরোফাইটার টাইফুনের যৌথ নির্মাতা ইউরোপের এয়ারবাস, ব্রিটেনের বিএই সিস্টেম এবং ইতালীর সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো।

সৌদি আরবের কাছে ব্রিটেনের প্যানাভিয়া টরনাডো রয়েছে ৮১টি। ইউরোপের এয়ারবাস এ ৩৩০ বিশালাকায় এরিয়েল ফুয়েল ট্যাঙ্কার রয়েছে ৭টি। বোয়িং ই-৩ এয়ারবর্ণ আর্লি ওয়ার্নিং রয়েছে ৫টি এবং আর ই-৩এ রিকনিস্যান্স রয়েছে ১টি।

সৌদি আরবের মোট রনতরীর সংখ্যা ৫৫টি। এর মধ্যে ফ্রিগেট ৭টি, করভেট ৪টি। এ ছাড়া টহল জাহাজ ৯টি এবং মাইন ওয়ারফেয়ার ৪টি। সৌদি নেভির ফ্রিগেট ফ্রান্সের তৈরি। করভেট, টহল জাহাজ, মাইন ওয়ারফেয়ার এবং সাপোর্ট ভেসেল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

সৌদি নেভির কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪টি হেলিকপ্টার রয়েছে। এর মধ্যে সিকরস্কির ১০টি হেলিকপ্টার হেলফায়ার মিসাইল সজ্জিত। এ ছাড়া ফ্রান্সের হেলিকপ্টার রয়েছে ৪৪টি। যুক্তরাষ্ট্রের পি-৮ পজিডন মাল্টি মিশন মেরিটাইম বিমান রয়েছে ৬টি।

সৌদি আরবের মোট ট্যাঙ্ক সংখ্যা ১ হাজার ৬২টি। সাজোয়া যান ১২ হাজার ৫শ। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ৭০৫টি। টাউড আর্টিলারি ১ হাজার ৮শ। রকেট প্রজেক্টর ৩শ।

সৌদি আরবের স্থলবাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপাচি হেলিকপ্টার রয়েছে ৯৪টি। ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে আরো ২৯টি অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের অর্ডার দিয়েছে সৌদি আরব। এ ছাড়া বোয়িং চিনুক হেলিকপ্টার রয়েছে ৪৮টি এবং বেল হেলিকপ্টার রয়েছে ৪০টি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক হক রয়েছে ৩৭টি। আরো ২৪টির অর্ডার দেয়া হয়েছে।

সৌদি আর্মিতে যুক্তরাষ্ট্রের আবরাম ১ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক রয়েছে ৪২২টি এবং এম৬০ প্যাটন ট্যাঙ্ক রয়েছে ৩৯০টি। এ ছাড়া ফ্রান্সের ট্যাঙ্ক রয়েছে ২৫০টি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইটে সৌদি আরবের যেসব সমরাস্ত্রের নাম দেখা যায় তাতে তিনটি সমরাস্ত্র রয়েছে যা সৌদি আরব নিজেরা তৈরি করে। এগুলো হলো সাকার নামক ড্রোন বিমান, আল শিবল নামক এক ধরনের আরমারড ভিহিক্যাল এবং মাইন রেজিসট্যান্ট এম্বুশ প্রটেকটেড।

সৌদি আরব রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে পোর্টেবল এন্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল, অটোমেটিক গ্রেনেড লঞ্চার এবং একে-১০৩ এসল্ট রাইফেল তৈরি করে। আর জার্মানির সাথে হেকলার এসল্ট রাইফেল তৈরি করে। এ ছাড়া চেক রিপাবলিকের সাথে চার ধরনের সামরিক ট্রাক নির্মাণ করে।

সৌদি আরব চীনের সাথে যৌথভাবে চীনের উইং লং-২ ড্রোন নির্মাণ করেছে ৩০০টি। দক্ষিন আফ্রিকা এবং জার্মানির সাথেও যৌথভাবে ড্রোন বিমান নির্মাণ করে সৌদি আরব। এ ছাড়া সৌদি আরবের স্থল বিমান এবং নৌবাহিনীতে যত সমরাস্ত্র রয়েছে তা আমদানিকৃত।

সৌদি আরবের স্থলবাহিনীর ক্ষুদ্রস্ত্র পিস্তল থেকে শুরু করে ট্যাঙ্ক, সকল ধরনের আরমারড ভিহিক্যাল, রকেট আর্টিলারি, হাউইজার, মর্টার, এন্টি ট্যাঙ্ক উইপনস আমদানিকৃত।

সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, দক্ষিন কোরিয়া, ফ্রান্স সহ বিভিন্ন দেশ থেকে মেশিনগান, লাইট মেশিন গান, হেভি মেশিন গান, বিভিন্ন ধরনের এসল্ট লাইফেল, রাইফেল, গ্রেনেড বেজড উইপনস এবং পিস্তলসহ যাবতীয় ক্ষুদ্রাস্ত আমদানি করে।

সৌদি আরবের নিজস্ব উদ্ভাবিত ড্রোন বিমানের নাম সাকার। সাকার ১ থেকে সাকার ৪ পর্যন্ত চার ধরনের মোট ৩৮টি ড্রোন বিমান নির্মাণ করেছে সৌদি আরব। ২০১২ সালে এটি প্রথম আকাশে ওড়ে। কিং আব্দুল আজিজ সিটি ফর সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি এ ড্রোন নির্মাণ করেছে সৌদি সরকারের জন্য। সৌদি সরকার গবেষণার অংশ হিসেবে এ ড্রোন উদ্ভাবন করেছে। ২০ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে পারে সাকার এবং টানা ২৪ ঘন্টা আকাশে অবস্থান করতে পারে। সাকারের রয়েছে চীনা লেজার গাইডেড মিসাইল এবং গাইডেড বোমা ছোড়ার ক্ষমতা।

সৌদি আরব ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করে কিং আব্দুল আজিজ সিটি ফর সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি। এটমিক এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্পেস রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ সাতটি ইনস্টিটিউট রয়েছে এর অধীনে।

বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রের প্রধান ক্রেতা সৌদি আরব। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্র যত সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে তার চার ভাগের এক ভাগ কিনেছে একা সৌদি আরব। অপর দিকে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যত অস্ত্র বিক্রি করেছে তার অর্ধেক কিনেছে সৌদি আরব।

সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট সিপ্রি প্রকাশিত গত ১৫ মার্চ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫ বছর ধরে বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হলো সৌদি আরব। গত ৫ বছরে সৌদি আরবের অস্ত্র আমদানি বেড়েছে ৬১ ভাগ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে অনেক বছর ধরে তেজিভাব বিরাজ করছে সৌদি আরবসহ আরবের বিভিন্ন দেশের পেট্রো ডলারে। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প সর্বপ্রথম সৌদি আরব সফর করেন। সফরের প্রথম দিনেই তিনি সৌদি আবের সাথে ৪৬০ বিলিয়ন ডলার বা ৩৮ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বিক্রির চুক্তি সাক্ষর করেন। ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র চুক্তি এটি।

ট্রাম্প সৌদি আরবের কাছে যেসব অস্ত্র বিক্রি চুক্তি করে তার মধ্যে রয়েছে থাড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম, প্যাট্রিয়রট এন্টি মিসাইল সিস্টেম, যুদ্ধ বিমান, রণতরী, ট্যাঙ্ক, মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম, সার্ভিলেন্স বিমান, অ্যাটাক হেলিকপ্টার, রাডার, কমিউনিকেশনস এবং সাইবার সিকিউরিটি প্রযুক্তি।

অনেকের মতে দীর্ঘ দিন ধরে সৌদি আরবের সমর প্রস্তুতি মূলত ইরানকে কেন্দ্র করে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব মোকাবেলায় এবং চরমপন্থীদের আক্রমন থেকে রক্ষায় কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের সমরাস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং সার্ভিস সাপোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।

২০১৫ সাল থেকে সৌদি-নেতৃত্বে কোয়ালিশন সামরিক অভিযান পরিচালনা করে আসছে ইয়েমেনে।

মধ্যপ্রাচ্য দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বে সবচেয়ে অস্থিতিশীল একটি অঞ্চল। ইরান আর আরব দেশগুলোর পুরনো দ্বন্দ্বের পাশপাশি সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। পূর্ব ভূ-মধ্যসাগর ও লিবিয়া নিয়ে তুরস্ক মিশর-দ্বন্দ্ব চলছে।

কাতার-উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর দ্বন্দ্ব এখনো চলছে। অপর দিকে চলছে সৌদি নেতৃত্বে ইয়েমেন যুদ্ধ। এসব কারনে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে।