বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ অনাবিষ্কৃত তেল-গ্যাসের মজুদ রয়েছে আর্কটিক মহাসাগরের তলদেশে। আর্কটিক মহাসাগরের ৫৩ শতাংশ উপকূল রেখা পড়েছে রাশিয়ার ভাগে। ফলে গোটা আর্কটিক অঞ্চলকে রাশিয়া তার ভূখণ্ড বলে দাবি করছে। আর্কটিক মহাসাগরে রাশিয়া তার সমুদ্রসীমা আরও বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে। বাড়িয়ে চলেছে সামরিক উপস্থিতি। আর্কটিক অঞ্চলের তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর দেশগুলোর সাথে দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে রাশিয়ার।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো নিয়মিতভাবে মহড়া পরিচালনা করে চলেছে আর্কটিক মহাসাগরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র আর্কটিক মহাসাগরে বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে। আর্কটিক আকাশে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর প্রতিটি টহল বিমানকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে রাশিয়ার যুদ্ধবিমান। আর্কটিক অঞ্চলের মূল্যবান তেল, গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য রাশিয়া বাস্তবায়ন শুরু করেছে বৃহৎ পরিকল্পনা।
এ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব বাড়ছে। আর্কটিক অঞ্চল পশ্চিমা দেশগুলোর উপস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়ার ভূখণ্ডে কেউ কামড় বসালে তাদের দাঁত ভেঙে দেওয়া হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বাড়ছে, তত বরফ গলছে উত্তর মেরু অঞ্চলের। আর এরই সাথে উত্তেজনা বাড়ছে বরফঢাকা এ অঞ্চল ঘিরে।
আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়া বাড়িয়ে চলছে সামরিক শক্তি। সুদূর আর্কটিক মহাসাগরের মাঝখানে ফ্রাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ করেছে রাশিয়ার চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট ইলিউশিন-৭৬ এয়ার লিফটার। বরফ শীতল এ দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত নাগুরস্কোয়ো বিমান ঘাঁটির রানওয়ে সম্প্রসারণ করে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ করেছে রাশিয়া। এর ফলে ফাইটার জেট, টিইউ-৯৫-এর মতো ভারি বোমারু বিমানসহ রাশিয়ার প্রায় সব ধরনের সামরিক বিমান অবতরণ করতে পারবে। মেরু অঞ্চলের আকাশে টহল কার্যক্রমও বৃদ্ধি করতে পারবে রাশিয়া। আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার আরও অনেক সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
উত্তর মেরু অঞ্চলে সীমান্ত রয়েছে এমনটি আটটি দেশ নিয়ে গঠিত আর্কটিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বর্তমান রাশিয়া। সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আট জাতির বৈঠককে সামনে রেখে রাশিয়া এখানে তার সামরিক শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
আর্কটিক মহাসাগরে রাশিয়ার নাগুরস্কোয়ো বিমান ঘাঁটি নরওয়ের সর্বউত্তরে সাভালবার্ড দ্বীপপুঞ্জ থেকে মাত্র ১৬০ মাইল দূরে অবস্থিত। নতুন এ বিমান ঘাঁটির ফলে রাশিয়ার নর্দার্ন নৌবহরের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রেসিডেন্ট পুতিন আর্কটিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। নাগুরস্কোয়ো বিমান ঘাঁটি নির্মাণ এবং সম্প্রসারণ এ পরিকল্পনার অংশ।
এ ঘাঁটির মাধ্যমে রাশিয়া এ অঞ্চলে ন্যাটোর চলাচলরত রণতরী এবং যুদ্ধবিমান পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। রাশিয়ান আর্মি ফ্রাঞ্জ জোসেল ল্যান্ডে দুটি শক্তিশালী কোস্টাল ডিফেন্স রকেট সিস্টেম মোতায়েন করেছে । এসব রকেট সমুদ্রে ২০০ মাইল পর্যন্ত দূরের রণতরীসহ স্থলভাগেও হামলা চালাতে পারে।
সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আর্কটিক অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমে ঘণীভূত হচ্ছে। আর এ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদ নাগুরস্কোয়ো বিমান ঘাঁটি।
আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার সামকি উপস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হোয়াইট হাউজ। আর্কটিক কাউন্সিল বৈঠক সামনে রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার সামকি শক্তি বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া মনে করে তাদের বিপুল জ্বালানি সম্পদ রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা।
আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়া তার ভৌগোলিক সীমানা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ২০০৭ সালে রাশিয়ান ডুবুরিরা উত্তর মেরুর আর্কটিক মহাসাহরের তলদেশে একটি রাশিয়ান পতাকা স্থাপন করে।
কানাডার তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী পিটার ম্যাক এর তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলেন, এটা ১৫ শতক নয় যে, আপনি যেখানে খুশি গিয়ে একটি পতাকা স্থাপন করে বলবেন এ ভূখন্ড এখন থেকে আমাদের। আর তা আপনাদের হয়ে যাবে। পতাকা স্থাপনের পর থেকে রাশিয়া আর্কটিক অঞ্চলের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে।
আর্কটিক অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে রাশিয়ার নর্দার্ণ ফ্লিট। এর সদর দফতর ব্যারেন্ট সাগর উপকূলে। আলেকজান্দ্রা ল্যান্ড দ্বীপ থেকে এর দূরত্ব ৮৩০ মাইল। নর্দার্ণ ফ্লিটে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নতুন বেশ কিছু রণতরী এবং সাবমেরিন। এ ফ্লিটে রয়েছে শক্তিশালী ফাইটার জেট, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং গোয়েন্দা সম্পদ।
জাতিসংঘের সমুদ্র আইনে বলা হয়েছে, আর্কটিক সার্কেলের অভ্যন্তরে উপকূলীয় দেশগুলো কোস্টাল বেজলাইন থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রাকৃতকি সম্পদ আহরণ করতে পারে। এর বাইরে কেউ যদি অধিকতর সমুদ্র এলাকা দাবি করতে চায় তাহলে জাতিসংঘে কন্টিনেন্টাল শেলফ বৃদ্ধির প্রমান হাজির করতে হবে । ইতোমধ্যে রাশিয়া জাতিসংঘের কাছে দুটি আবেদন করেছে তাদের কন্টিনেন্টাল শেলফের আওতা বৃদ্ধির জন্য ।
আর্কটিক অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। এর ফলে আর্কটিক অঞ্চলে সামরিক এবং অর্থনৈতিক তৎপরতার সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাশিয়া দ্রুত অনুধাবন করতে পেরেছে তাদের দূরবর্তী উত্তরাঞ্চল শীঘ্রই একটি নতুন ফ্রন্টে পরিণত হবে। তাই বিলম্ব না করে রাশিয়া এ অঞ্চল ঘিরে বড় ধরনের কৌশল গ্রহণ করেছে। এ কৌশলের রয়েছে তিনটি ভিত্তি। সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, নর্দার্ন সি রুটের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং আর্কটিক অঞ্চলের গ্যাস এবং খনিজসম্পদসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ।
আর্কটিক মহাসাগরের ৫৩ ভাগ উপকূল রেখা রাশিয়ার। আর্কটিক কাউন্সিল বৈঠক সামনে রেখে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, এটা অনেক আগেই সবার কাছে স্পষ্ট , এটা আমাদের ভূখন্ড। আমাদের আর্কটিক উপকূল নিরাপদ রাখা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের দেশ সেখানে যা কিছুই করছে তা নিয়ে কারোর প্রশ্ন তোলার কিছু নেই। কার্নেগি মস্কো সেন্টার এর পরিচালক দিমিত্রি ট্রেনিন বলেন, আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার লক্ষ্য অর্থনৈতিক ফসল তোলা।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ অনাবিস্কৃত তেল গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে আর্কটিক মহাসগারের তলদেশে। আর রাশিয়া এটি সংগ্রহ করতে বদ্ধ পরিকর। রাশিয়া ইতোমধ্যে উত্তর রাশিয়ায় ইয়ামাল উপদ্বীপে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস ইনস্টলেশন এবং শিপিং ফ্যাসিলিটি নির্মান করেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে চীনের।
আর্কটিক অঞ্চল ঘিরে চীনেরও আগ্রহ বাড়ছে । ২০১৮ সালে চীন নিজেদেরকে আর্কটিক অঞ্চলের কাছের দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এতে হতাশা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি পরিষ্কার করে দিয়েছি যে, আর্কটিক থেকে ৯০০ মাইল দূরে অবস্থান করে আর্কটিকের কাছের রাষ্ট্র দাবী করা কমিউনিস্ট কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়।
আর্কটিক নিয়ে রাশিয়া এবং ন্যাটো মিত্র দেশগুলোর মধ্যে বির্তক আর দ্বন্দ্ব বাড়ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালে আর্কটিক সাগরে বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করে। সেখানে ন্যাটোর সদস্যদের সাথে বড় ধরনের মহড়া পরিচালনা করে।
রাশিয়ান নর্দার্ণ ফ্লিট কমান্ডার সিএনএনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অথবা ন্যাটো নিয়মিতভাবে আলাদা আলাদা মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে আর্কটিক মহাসাগরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমনটি এর আগে দেখা যায়নি।
আর্কটিক সাগর ঘিরে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের এ প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে। কার্নেগি মস্কো সেন্টারের পরিচালক ট্রেনিনের মতে এখানে আবিষ্কারের অনেক কিছু রয়েছে । আপনি এখান থেকে প্রচুর অর্থ আয় করতে পারবেন। প্রচুর সম্পদ ছড়িয়ে রয়েছে এ অঞ্চলে। প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের অনন্য সম্পদ রয়েছে। রাশিয়া এগুলো তুলতে চায়।
আর্কটিক ঘিরে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব শুধু সম্পদ ঘিরে নয়। বরং এর রয়েছে সামরিক গুরুত্ব। ম্যাপ নয় বরং গ্লোবের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মিসাইলের সংক্ষিপ্ত রুট আটলান্টিক সাগর নয় বরং আর্কটিক সাগর। আর রাশিয়া তার মিসাইল তাক করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।