মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন জি-সেভেন সম্মেলনে ইউরোপ সফরে, তখন মার্কিন রণতরী কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করে। বাইডেনের ইউরোপ সফরের পাশাপাশি ন্যাটোর বৈঠকের প্রস্তুতি তখন চলছিল। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে তৎপরতা বাড়াচ্ছে, তখন এ অঞ্চলে মার্কিন রণতরীর উপস্থিতিকে বিশ্লেষকরা খুবই গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করছেন।
মার্কিন রণতরী ইউএসএস লাবুন ১১ জুন বসফরাস প্রণালী পার হয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তখন যুক্তরাজ্যে জি-সেভেন নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করছিলেন। ইউএসএস লাবুন হচ্ছে মার্কিন নৌবাহিনীর আরলেইঘ বুর্কে ধরনের একটি ডেসট্রয়ার। মার্কিন নৌবাহিনীর চাপলেইন কোরের ক্যাপ্টেস জন ফ্রান্সিস লাবুনের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। ১৯৯৩ সালে এ ডেসট্রয়ারটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। কমিশন হয়েছিল ১৯৯৫ সালে।
২০১২ সালে লিবিয়ায় মার্কিন কূটনীতিকদের ওপর হামলার পর ইউএসএস লাবুনকেই লিবিয়ার উপকূলে মোতায়েন করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়, তখনও একবার ইউএসএস লাবুনকে কৃষ্ণসাগরে পাঠানো হয়েছিল। ২০১৮ সালে সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন- এ অভিযোগে ইউএসএস লাবুন থেকেই সিরিয়ায় বাশার বাহিনীর ওপর টমহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। এই রণতরীকে এবার কৃষ্ণসাগরে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা পাঠিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আইসেনহোয়ার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুেেপর সাথে সংযুক্ত এই গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ারও বর্তমানে কৃষ্ণসাগরে কাজ শুরু করেছে বলে শিপ স্পটারদের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ নৌবহর একটি বিবৃতিতে জানায়, ইউএসএস লাবুন রণতরীটি মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ পি-এইট-এ পোসেইডন এবং ন্যাটোর ই-থ্রি-এ সেন্ট্রি এয়ারর্বণ ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমসহ কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করেছে।
রাশিয়ার ন্যাশনাল ডিফেন্স কন্ট্রোল সেন্টার বার্তা সংস্থা তাসকে জানিয়েছে, তারা কৃষ্ণসাগরে নতুন রণতরীগুলোর আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করছেন। সেন্টার থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার মোতায়েনকৃত জাহাজগুলো এরইমধ্যে মার্কিন নৌবাহিনীর গাইডেড মিসাইল ডেসট্রয়ার লাবুনকে ট্র্যাক করেছে। অর্থাৎ রাশিয়া মার্কিন রণতরীর গতিবিধি পুরোমাত্রায় পর্যবেক্ষণে রাখছে।
লাবুন কৃষ্ণসাগরে এসে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে এ বছরেই মোট পঞ্চমবারের মতো কোনো মার্কিন রণতরী এ এলাকায় প্রবেশ করল। লাবুনের আগে কৃষ্ণসাগরে মার্কিন নৌজাহাজ ইউএসসিজিসি হ্যামিল্টনকে মোতায়েন করা হয়েছিল। হ্যামিলটন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী দেশের নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সাথে যৌথ মহড়া শেষ করে কৃষ্ণসাগর ছেড়ে চলে যায়।
বিগত কয়েক বছরের মধ্যে হ্যামিলটন হলো একমাত্র মার্কিন কোস্ট গার্ড কাটার যা কৃষ্ণসাগর এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করেছে। লাবুনের পাশাপাশি এবার ইউএসএস সিভিএন-সিক্সটি নাইন স্ট্রাইক জাহাজকেও কৃষ্ণসাগরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও উত্তর আরব সাগরে আরও বেশ কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ বর্তমানে অবস্থান করছে। যেগুলো আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের সম্ভাব্য প্রত্যাহার কার্যক্রম তদারকি ও পরিচালনা করবে।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবেই কৃষ্ণসাগরে এ ধরনের রণতরী পাঠিয়ে আসছে। ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো নিরাপত্তা নিয়েও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হয়ে পড়ে। এর আগে গত এপ্রিলে ওয়াশিংটন তুরস্ককে জানায় যে, মনট্রিয়াক্স কনভেনশন অনুযায়ী বসফরাস এবং দারদেনেইলস প্রণালীর মাঝ দিয়ে দুটো রণতরী পাঠানো হতে পারে। ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে বলে তুরস্ককে জানানো হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এ দুটো রণতরী আর পাঠায়নি।
রাশিয়াও ইউক্রেন সীমান্ত থেকে মোতায়েন করা বাড়তি সৈন্য ও সরঞ্জামাদি প্রত্যাহার করার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। পুতিনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন নানা মুখী আলোচনা চলছে।
আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই পুতিন ইউক্রেন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা দাবি করছেন । ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাক- এটা পুতিন কখনোই চাননি। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ার আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হঠাৎ করে পুতিন বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির দিক থেকে জনগনের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষনা দেয়া হয়।
পুতিন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কাজ করতে গিয়ে আর্থিক চাপেও পড়েছেন। সিরিয়ায় যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে গিয়ে এরই মধ্যে রাশিয়ার অনেক অর্থ ব্যয় হয়ে গিয়েছে। ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের পেছনেও অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। পাশাপাশি নিত্য নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র নির্মাণেও রাশিয়াকে অনেক বেশি পরিমাণে অর্থ জোগাতে হচ্ছে। এতসব খরচ নির্বাহ করার পর ইউক্রেনে আগের পরিমাণে সেনা মোতায়েন রাখা পুতিনের জন্য এখন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
এদিকে জি সেভেন ও ন্যাটো সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ইউরোপের দেশগুলোকে সক্রিয় করারা চেষ্টা করছেন বাইডেন। পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি এবারের বৈঠকগুলোতে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। জেনেভায় পুতিন- বাইডেন বৈঠকে আগে আগে পুতিন এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কে অনেকটাই অবনতি হয়েছে।
ইউরোপ সফরের আগে ওয়াশিংটন পোস্টকে জো বাইডেন বলেন, ‘ইউরোপের নিরাপত্তা রাশিয়ার কারণে যেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আমরা তার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে অবস্থান নিয়েছি। রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে আমরা তা মেনে নিতে পারি না।’ বাইডেন যখন প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তখনও তিনি ইউক্রেনের পক্ষে ছিলেন। সে সময়ে মস্কোর পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া প্রশাসনকে গনবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে উচ্ছেদ করা হয়। বাইডেনই যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে ইউক্রেনমুখী রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে ন্যাটোর আরেক সদস্য তুরস্কের ভুমিকা নিয়ে জোর অলোচনা চলছে। দেশটি একইসাথে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। তবে দ্বিপাক্ষিক এ সম্পর্কের সমীকরণ মেলানো খুব সহজও নয়। আংকারা এখনো অবধি রাশিয়ার মানচিত্রে ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তিকে স্বীকৃতি দেয়নি।
ইউক্রেনের সাথেও তুরস্কের বেশ কার্যকর প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্ক ইউক্রেনকে বেশ কিছু ড্রোন সরবরাহ করেছে। ইউক্রেনের কাছ থেকে ইঞ্জিন সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক এবং ইউক্রেন একটি যৌথ প্রকল্পে সশস্ত্র ড্রোনও নির্মাণ করছে। সম্প্রতি আংকারা ইউক্রেনের কাছে বেশ কয়েকটি টিবিটু বেরাকতার সশস্ত্র ড্রোনও বিক্রি করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, মস্কো ইউক্রেনের ওপর হামলা চালালে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ ড্রোনগুলো ব্যবহার করবে।
তবে তুরস্ক রাশিয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংঘাতে যাচ্ছে না। এ দুটো দেশের মধ্যে লড়াইটা অনেকটা পরোক্ষ ভাবে হচ্ছে। সিরিয়া, লিবিয়া বা আজারবাইজানে তুরস্ক আর রাশিয়া বিপরীতমুখী অবস্থানই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রে তুরস্ক আর রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই রয়ে গেছে। এমনকী মার্কিন আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমও ক্রয় করেছে।
নাগরনো কারাবাখে তুরস্ক প্রকাশ্যে আজারবাইজানকে অস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে সহযোগিতা করলেও রাশিয়া ছিল আরমেনিয়ার পক্ষে। যদিও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিও হয়। এ যুদ্ধবিরতিকে তুরস্ক ও আজারবাইজানের জন্য বিজয় হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী সময়ে রাশিয়া ও তুরস্কের সম্পর্ক আবারও স্বাভাবিক হয়ে যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন কৃষ্ণসাগরকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতি এখনো বেশ অস্পষ্টই রয়ে গেছে। প্রকৃত মেরুকরণটি কীভাবে হচ্ছে, পরাশক্তিগুলো এ অঞ্চলে আরো কতদিন রণতরী মোতায়েন রাখবে- তা সময়ই বলে দেবে।