আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরিভাবে সেনা প্রত্যাহারের পর কোন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোনগুলো পরিচালনা করবে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তবর্তী শামসি বিমানঘাঁটি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত এ এলাকাকে ব্যবহার করেই ড্রোন আক্রমণ পরিচালনা করে। সম্প্রতি পাকিস্তান বিমানবাহিনী এই এলাকায় আরেকটি বিমানঘাঁটি স্থাপনের সম্ভ্যাবতা যাচাইয়ের চেষ্টা করছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, পাকিস্তান বিমানবাহিনী ওয়াশিংটনের অনুরোধ রাখতেই বিমানঘাঁটি স্থাপন করার কথা ভাবছে। তাদের আশঙ্কা, ওয়াশিংটন হয়তো পাকিস্তানের কোনো বিমানঘাঁটি ব্যবহার করেই আফগানিস্তানে কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইছে।
আফগানিস্তান থেকে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশটিতে থাকা সর্বশেষ ২ হাজার সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা রয়েছে। আফগানিস্তানে যেসব মার্কিন ঘাঁটি ছিল, তার অধিকাংশই এরইমধ্যে খালি করে আফগান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেনা প্রত্যাহার করার পর কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে মার্কিন নীতি নির্ধারকরা এখনও বেশ সংশয়ে রয়েছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষ চাইছেন আফগানিস্তানের নিকটবর্তী কোনো দেশে একটি সামরিক বা বিমান ঘাঁটি স্থাপন করতে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের নাম প্রথম বিবেচনায় আসে।
পাকিস্তান যদি সাড়া না দেয়, তাহলে অন্য কোনো দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে সেখান থেকে ড্রোন আক্রমণ পরিচালনা করা বড় আকারের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। প্রতিপক্ষের স্থাপনার নিকটবর্তী কোনো স্থান থেকে ড্রোন হামলা চালানো তুলনামূলক সহজ, সাশ্রয়ী এবং অধিক কার্যকর। যেহেতু আফগানিস্তান ও পাকিস্তান একেবারেই পাশাপাশি দেশ, তাই পাকিস্তানের মাটিকে ড্রোনঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারলে মার্কিনীদের জন্য সুবিধাজনক হতো।
ড্রোন যেহেতু প্রথাগত বিমানের তুলনায় আস্তে ওড়ে, তাই ড্রোনের সফল অভিযান পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দূরত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ এক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারত। কিন্তু রাশিয়ার আপত্তির কারণে এ দেশগুলোতেও মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ নেই। অবশ্য বাহরাইন ও ওমান মার্কিনীদেরকে ড্রোনঘাঁটি স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে মার্কিনীরা এ দুটো দেশের বিষয়ে ততটা আগ্রহী নয়। কারণ এসব দেশ থেকে ড্রোন উড়ে আফগানিস্তানে আসতে অনেকটা সময় চলে যাবে। দূরত্ব বেশি হওয়ায় অপারেশনের খরচ ও অন্যান্য জটিলতাও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশী সম্প্রতি বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, ইসলামাবাদ ইতোমধ্যেই ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তানের কোনো বিমান ঘাঁটিকে ব্যবহার করার অনুমতি ও সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া হবে না। পাকিস্তান বিমান বাহিনীও জানিয়েছে, ওয়াশিংটনের কোনো অনুরোধে নয় বরং তারা নিজেদের বাহিনীর জন্যই নতুন বিমানঘাঁটি করার স্থান নির্বাচনের চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের মন্ত্রীসভার সিনিয়র একজন সদস্য তুরস্কের বার্তা সংস্থা টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, ইমরান খান এরই মধ্যে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি যতদিন ক্ষমতায় আছেন এ সময়ে পাকিস্তানের মাটিতে মার্কিন কোনো সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হবে না।
২০১৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের পাহাড়ী এলাকায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের প্রচন্ড বিরোধীতা করে এসেছেন। ২০১২ সালে ইমরান খান যখন দেশটির বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন, তখনও তিনি মিছিল সমাবেশ করে পাকিস্তানন ও আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন আক্রমণের সমালোচনা করেছেন। ইসলামাবাদের একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, এর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে পাকিস্তান যখনই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো সমঝোতায় বা সামরিক চুক্তিতে গেছে তার জন্য দেশটিকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।
পাকিস্তান মার্কিন ড্রোন ও বিমান ব্যবহারের অনুমতি না দেয়ার বিষয়ে ওয়াশিংটন এখনো প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জেক সুলিভান এ মাসের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পাকিস্তানে একটি ড্রোন ঘাঁটি নির্মাণের বিষয়ে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সাথে সামরিক, গোয়েন্দা বাহিনী এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে গঠনমূলক আলোচনা এখনো চলমান রয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস ৬ জুন এক খবরে জানায়, সিআইএ-র পরিচালক উইলিয়াম জে বার্নস সম্প্রতি ইসলামাবাদ সফরে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া এবং আইএসআই প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল ফাইজ হামিদের সাথে সাক্ষাত করেছেন। বার্নস এ সফরে ইমরান খানের সাথেও দেখা করতে চেয়েছিলেন তবে ইমরান খান তাকে সময় দেননি বলে খবরে জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সিআইএ পরিচালক নন, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার সমপর্যায়ের নেতা অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠক করতেই বেশি আগ্রহী। সিআইএ পরিচালকের পাকিস্তান সফরটি বেশ গোপন রাখা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আস্থায় নেয়ার জন্যই বার্নস এ সফরে চেষ্টা চালান। পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক তুঘরাল ইয়ামিন মনে করেন, পাকিস্তানের সংসদে ইমরান খানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও ব্যবধান খুবই সামান্য। ইমরান খান এরপরও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ বলিষ্ঠই থাকেন। মার্কিণ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি না দেয়ার বিষয়টি ইমরান খানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ বিষয়ে খুব ভিন্নমত দেবে বলে মনে হয় না।
ইমরান খান অনেক বছর ধরেই পাকিস্তানের মাটিতে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির সুযোগ দেয়ার জন্য আগের সরকারগুলোর সমালোচনা করে আসছেন। ইমরান খান তার সে কথা এবং অবস্থান ধরে রেখেছেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের মাটিতে সিআইএ পরিচালিত একটি ড্রোন আক্রমণের ঘটনাও ঘটেনি।
সিআইএ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে সর্বশেষ ড্রোন হামলা পরিচালনা করে। ইমরান খান হয়তো বুঝতে পারছেন মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি বা মার্কিন ড্রোন আক্রমণের বিরোধিতা করেছেন বলেই জনগন তাকে ভোট দিয়েছে। এমন অবস্থায় তার পক্ষে মার্কিন ড্রোন আক্রমণের সুযোগ দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এমনটা করলে তিনি ভয়াবহ ইমেজ সংকটে পড়ে যাবেন।
মার্কিন ড্রোন অপারেশনগুলো মূলত দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পরিচালনা করে। মার্কিন ড্রোনের অভিযান নিয়ে পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষের আপত্তি রয়েছে। পাকিস্তানের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন ড্রোন দিয়ে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলে ৪শরও বেশি আক্রমণ পরিচালনা করে। এসব হামলায় ৯৬৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন যার মধ্যে ১৭২জন শিশুও আছে। এই নাগরিকেরা প্রিডেটর এবং রিপার ড্রোন দিয়ে বোমা হামলায় নিহত হন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব বেসামরিক নাগরিক হত্যার দায়ও নিতে চায় না। কেবলমাত্র ২০১৫ সালেই একটি ড্রোন হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের হামলার দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে।
সশস্ত্র ড্রোন নিয়ে একেক দেশ আবার একেক ধরনের গল্প বলে। পাকিস্তান মূলত নজরদারি আর নাগরিকদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ড্রোন ব্যবহার করার দাবি করে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অহরহ ড্রোন বিমান ব্যবহার করলেও যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় তখন আবার তার দায় অস্বীকার করে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর থেকেই মার্কিন বাহিনীতে ড্রোন একটি বিশেষ জায়গা করে নেয়। মার্কিন রণকৌশলেও ড্রোন একটি উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টর হিসেবেই কাজ করছে। বিগত কয়েক বছরে আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন ড্রোন ব্যবহার করে ১৩ হাজারের বেশি আক্রমণ চালানো হয়েছে। যাতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। যার বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিক।
সাধারণ যুদ্ধবিমানগুলো আকাশে খুব বেশি সময় উড়তে পারে না। কিন্তু ড্রোনগুলো ৪০ ঘন্টারও বেশি সময় আকাশে ভাসতে পারে। ফলে, ড্রোনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের টার্গেট স্থাপনা সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। ড্রোনের ক্যামেরাগুলোতে বল আকৃতির সেন্সর থাকে। বিগত কয়েক বছর এ ক্যামেরাটিকে বারবার উন্নত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বর্তমানের ড্রোনগুলোতে অনেকটা মোবাইল ফোনের মতো ক্যামেরা থাকে। এর ফলে ড্রোন থেকে প্রতিপক্ষের স্থাপনার ওপর সূক্ষভাবে নজরদারি করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি, ড্রোনটিও প্রতিপক্ষের হামলা হওয়ার আগেই নিজেকে সুরক্ষা করতে পারে। ড্রোন ব্যবহার জনপ্রিয় হওয়ার একটি বড়ো কারণ হলো, ড্রোনের ব্যবহারে সাধারণ সেনার মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। তাছাড়া ড্রোন ব্যবহার করে দূর থেকে বেশ স্বস্তির সাথে প্রতিপক্ষের স্থাপনাকে নিশানা করা যায়।
মার্কিন ড্রোন হামলায় এক সময়ে ব্যাপক সংখ্যায় বেসামরিক নাগরিক নিহত হতো। এ অভিযোগ আসার পর প্রেসিডেন্ট ওবামা ড্রোন ব্যবহারের অনেকগুলো বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিলেন। এরপর বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার পরিমাণও বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে এসব বিধি-নিষেধের অনেকটাই তুলে নেন। চীন ও তুরস্কসহ অনেক দেশ ড্রোন ব্যবহারে সফলতা পাওয়ায় মার্কিনীরা আরও বেশি আগ্রাসী মনোভাব নিয়েই সামনের দিনগুলোতে ড্রোন ব্যবহার করবেন বলেই বিশ্লেকরা আশঙ্কা করছেন।