যুদ্ধের হিসাব পাল্টে দিচ্ছে সাশ্রয়ী ড্রোন


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৫ জুন ২০২১, ১৩:৫৬

রাশিয়ার তৈরি টি-৭২ ট্যাঙ্ক একসময় প্রতিপক্ষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের কারণ ছিল। অথচ এ-রকম ট্যাঙ্ক ড্রোনের আঘাতে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গত বছর নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় এ-রকম অসংখ্য ট্যাঙ্ক ধ্বংসের ছবি স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে দেখা গেছে। প্রায় দুই দশক রাশিয়ার সমর্থনে আর্মেনিয়া নাগরনো-কারাবাখ দখল করে রাখলেও মাত্র ৬ সপ্তাহের যুদ্ধে আর্মেনিয়াকে আজারবাইজানের কাছে হার মানতে হয়। আর এ পরাজয়ের নেপথ্যেও মূল ভূমিকা রেখেছে তুরস্কের তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নতুন ড্রোনগুলো।

শুধু আজারবাইজানই নয়, তুরস্কের মিসাইল সমৃদ্ধ সাশ্রয়ী ড্রোনের কারণেই রাশিয়া সমর্থিত বাহিনী সিরিয়া এবং লিবিয়াতেও পরাজিত হয়েছে। রাশিয়ার টি-সেভেন্টি টু ট্যাঙ্কই শুধু নয়, বরং আরও অনেক ধরনের ট্যাঙ্ক, ট্রাক, কমান্ড পোস্ট, মর্টার পজিন এবং রাডার ইন্সটলেশন কাঠামোগুলোও তুর্কি ড্রোনের হামলায় ধ্বংস হয়েছে।

এরপর থেকে ছোট দেশগুলোর সেনাবাহিনীও ড্রোনের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই দেশগুলো এখন মিসাইল সমৃদ্ধ এ ড্রোনগুলো কিনে নিয়ে প্রতিপক্ষ বড়ো রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে মোতায়েন করতে শুরু করেছে। তুরস্কের ড্রোনগুলোর দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এসব ড্রোনের দিকে অনেক দেশের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলের এ পরিবর্তনে যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন কর্মপদ্ধতি এখন সামনে চলে আসছে।

গত বছর আঞ্চলিক সংঘাতগুলোতে ড্রোনের অভাবনীয় সাফল্যের পর সামরিক কৌশলগত ভারসাম্য এ মুহূর্তে তুরস্ক ও রাশিয়াকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। তুরস্কের তৈরি ড্রোনগুলো তুলনামূলক সস্তা। এ ড্রোনগুলোতে ব্যবহৃত ডিজিটাল প্রযুক্তিও বেশ সাশ্রয়ী। তাছাড়া ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য সমরযান ধ্বংসেও এ ড্রোনের জুড়ি মেলা ভার।

অন্যদিকে, তুরস্ক নিজেই রাশিয়া থেকে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করে ব্যবহার শুরু করে দেওয়ায় লিবিয়া, সিরিয়া ও আজারবাইজানে বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। ড্রোনের এ জনপ্রিয়তা প্রমাণ করছে যে, আগামী দিনের যুদ্ধকৌশল হবে সাশ্রয়ী তবে অধিক কার্যকর।

মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ড্রোন রফতানিকারক দেশ হলো চীন। ইরাক ও ইয়েমেনে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী এ ড্রোনগুলোকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপর হামলাও চালিয়েছে। নাইজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও ১০টি দেশও চীন থেকে কেনা ড্রোনগুলো ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। সার্বিকভাবে সমরযুদ্ধের খেলা পাল্টে যাচ্ছে।

বিচ্ছিন্ন একটি ড্রোন কিংবা একসাথে গুচ্ছ আকারে ভাসমান ড্রোন প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনীকে ভীষণ রকম হতবিহবল করে দেয়। প্রতিপক্ষ সেনারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ড্রোনের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য তারা নানা স্থাপনের আড়ালে লুকিয়ে আত্মরক্ষারও চেষ্টা করে। অনেক দামি যুদ্ধবিমান দিয়েও প্রত্যক্ষ সংঘাতে যতটুকু সফলতা পাওয়া যায় না, সাশ্রয়ী ড্রোন দিয়ে তার চেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যায়।

একটি ড্রোন খুব সহজে ২৪ ঘন্টা আকাশে ভেসে থাকতে পারে। ড্রোনগুলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষের ব্যবহৃত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দুর্বলতাগুলোকে খুঁজে বের করে সেখান দিয়ে প্রবেশ করে। ড্রোন পথ তৈরি করে দেয়ার পর সে স্থান দিয়ে প্রথাগত যুদ্ধবিমান এবং স্থলপথে পদাতিক বাহিনীও প্রবেশ করে শত্রুপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। ড্রোন শত্রু স্থাপনায় টার্গেট করে সফলভাবে মিসাইলও নিক্ষেপ করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী উন্নত প্রযুক্তির ড্রোন মোকাবেলায় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম উন্নত করছে। ড্রোনকে মিসাইল দিয়েও ধ্বংস করা যাচ্ছে না। বরং মিসাইল ব্যবহার করলে লাভের চেয়ে লোকসান হয় বেশি। মিসাইল ব্যবহারে যুদ্ধের ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়। ফলে পরাশক্তিগুলো বিকল্প উপায় খুঁজছে। এর অংশ হিসেবে মার্কিন এয়ারফোর্সের রিসার্চ ল্যাবোরেটরী স্কাইবর্গ এবং ভলকিরে নামক দুটো স্বল্পমুল্যের স্বয়ংক্রিয় এয়ারক্রাফট আবিস্কার করার চেষ্টা করছে। মার্কিন বিমান বাহিনীর এক কর্মকর্তা এ নিয়ে বলেন, আমাদের প্রতিপক্ষ এমন সব প্রযুক্তি নির্মাণ করছে যা আমাদের উত্তরাধিকারকে ভবিষ্যতে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। তাই আমরা এখন থেকেই ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপত্তা সুরক্ষা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন থেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু ড্রোন কেনাবেচায় এ দুটো দেশ পিছিয়ে আছে । কারণ তারা নিজেদের আবিস্কৃত ড্রোনগুলোকে অন্য কোনো দেশ এমনকী মিত্র দেশের কাছেও বিক্রি করতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের আশঙ্কা হচ্ছে যদি তাদের তৈরি ড্রোনগুলো অন্যান্য দেশ পেয়ে যায় তাহলে প্রত্যক্ষ সংঘাতে তারা কোনো সুবিধা পাবে না। এছাড়[া তাদের ড্রোন অন্যর হাতে চলে গেলে অন্যান্য দেশ মার্কিণ ও ইসরাইল ড্রোন মোকাবিলা করার মতো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও তৈরি করার সুযোগ পেয়ে যাবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের এ দৃষ্টিভঙ্গি শেষ পর্যন্ত তাদেরকে আর্থিক ও সামরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এ সংকট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বুঝতে পেরেছিলেন। ড্রোনের বাজারে চীন ও তুরস্কের একচেটিয়া আধিপত্য কমাতে তিনি মার্কিন ড্রোন বিক্রি ও রফতানি নীতিমালা অনেকটা সহজও করার চেষ্টা করেছিলেন। এর ফলে, বিশ্ববাজারে মার্কিন ড্রোনের কয়েকটি মডেলের বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়। এরপর প্রথম দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমীরাত এ বছরের জানুয়ারী মাসে ৩ বিলিয়ন ডলারে ১৮টি এম-কিউ নাইন ড্রোন কিনেছে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কারণে বিকল্প হিসেবে নতুন নতুন সাশ্রয়ী সমরাস্ত্র আসছে। গত কয়েক বছরে যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের কাছে ত্রাস হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে তাহলো তুরস্ক নির্মিত ড্রোন বেরাকতার টিবিটু। যুক্তরাষ্ট্রের এমকিউ নাইনের সাথে তুলনা করলে টিবিটুতে অস্ত্রের পরিমান কম। এ ড্রোনে চারটি লেজার গাইডেড মিসাইল বহন করা যায়। এ ড্রোনটির রেডিও নিয়ন্ত্রিত এ্যাপারেটাসগুলো এর অপারেশনাল দুরত্বকে ২শ মাইলের মধ্যে সীমিত রাখে। এমকিই নাইন এর তুলনায় প্রায় ৫গুন এলাকা কভার করতে পারে।

এ ড্রোনটিকে সামরিক বিশ্লেষকরা সাবেক সেভিয়েত আমলের কালাসনিকভ একে ফোর্টি সেভেনের সাথে তুলনা করেছেন। কালাসনিকভের একে ফোর্টি সেভেন যেমন বিংশ শতকের যুদ্ধের ধরণ পাল্টে দিয়েছিল। তুরস্কের বেরাকতার ড্রোনও ঠিক তাই করছে। প্রতি সেটে ৬টি বেরাকতার টিবিটু ড্রোন, গ্রাউন্ড ইউনিট এবং অন্যান্য অপারেশনাল যন্ত্রপাতি নির্মাণ করা হয়। পুরো সেটটি নির্মাণে যে পরিমান ব্যয় হয় মার্কিনিদের একটি এমকিউ নাইন তৈরিতে তার চেয়ে বহুগুণ অর্থ ব্যয় হয়।

তুরস্কের বেকার নামক সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ড্রোনগুলো উৎপাদন করে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেকার যাত্রা শুরু করে ১৯৮৪ সালে। প্রথমদিকে তারা অটোপার্টস তৈরি করতো। কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন তৈরি করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কাতার ও ইউক্রেন তুরস্কের ড্রোনের নিয়মিত ক্রেতা। অন্যদিকে, ন্যাটোভুক্ত সদস্যরাষ্ট্র পোল্যান্ডও ২৪টি তুর্কি ড্রোন কেনার ঘোষণা দিয়েছে। আরো কয়েকটি ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্রও তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার আরও কিছু দেশও বেরাকতার ড্রোনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে সিরিয়ার আকাশে সফলভাবে পারদর্শিতা দেখানোর পর টিবিটু ড্রোন আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসে।

সে সময়ে রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে সিরিয়ার সেনা বাহিনী ইদলিব প্রদেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। অন্যদিকে বিরোধীদেরকে সহায়তা করছিল তুরস্ক। শুরুতে তুরস্ক এ যুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়নি। কিন্তু সিরিয়ান বাহিনীর হামলায় ৩০ জন তুর্কি সেনা নিহত হওয়ার পর তুরস্ক সেনাবাহিনী সিরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যুহকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে সিরিয়ার আরো ভেতরে প্রবেশ করে। তুরস্কের সেই অভিযানের মূল শক্তিই ছিল ড্রোন।

তুর্কি ড্রোনগুলো শব্দ কম করেই উড়তে পারে ফলে রাডারে সহজে ধরা পড়ে না। একটানা বেশ কয়েকঘন্টা আকাশে ভাসতে পারে বলে বেশ সময় নিয়েই এ ড্রোনগুলো প্রতিপক্ষের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দুর্বলতাগুলো বের করতে পারে। ড্রোনগুলো যখন আকাশপথে হামলা চালায় একই সময়ে পদাতিক বাহিনীও প্রতিপক্ষের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করে হামলা চালায়।

তুরস্কের সামরিক শিল্পখাতের প্রধান ইসমাইল দেমির মনে করেন, বেরাকতার ড্রোনের দাম কম হওয়ায় সেনাবাহিনী এ ড্রোনগুলো বেশি হারে ব্যবহার করারও ঝুকি নিতে পারে। দুই-তিনটি ড্রোন যদি ব্যর্থও হয়, আরো ড্রোন পাঠাতে বাহিনীকে বেগ পেতে হয় না। সাশ্রয়ী মূল্য নীতিনির্ধারকদেরকেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। টিবিটু ড্রোন লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধকে থামিয়ে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এর ফলে ফল জাতিসংঘের সমর্থিত জাতীয় ঐকমত্যের সরকারও বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করে।

রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কিছু দেশ লিবিয়ার বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারকে সহায়তা করছে। সে সাহায্য নিয়ে হাফতার এক সময়ে রাজধানী ত্রিপোলি দখলের কাছাকাছি চলে আসে। তুরস্ক এ সময় দেশটির সরকারকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও ড্রোন সরবরাহ করে। ২০২০ সালে তুরস্ক লিবিয়ায় তাদের সামরিক কর্মকাণ্ড আরও সম্প্রসারিত করে। একের পর এক ড্রোন ব্যবহার করে লিবিয়াতেও ব্যাপক সফলতা পায় তুরস্ক। লিবিয়ার বিদ্রোহীরা রাশিয়ার দেওয়া ডিফেন্স সিস্টেম পান্টসির ব্যবহার করত। কিন্তু বেরাকতার সেই সিস্টেমকেও বিপর্যস্ত করে দিতে সক্ষম হয়। ফলে, খলিফা হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলি থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।