এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কী?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৮ জুন ২০২১, ০৮:৩০

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী রণতরীকে বলা হয় ভাসমান বিমানঘাঁটি। বাইরে থেকে শুধু এর ফ্লাইট ডেক আর বিমানের উড্ডয়ন অবতরণই দেখা যায়। কিন্তু, ২০-২৫ তলা একটি জাহাজের ভেতরে রয়েছে বিশাল এক জগত। যে জগতে বাস করে কয়েক হাজার লোক। সেখানে থাকে তাদের জীবনধারণের সব ব্যবস্থাই। ছোটখাট একটি শহরও বলা চলে একে। থাকে বোমা, ক্ষেপণাস্ত্রসহ বহু গোলাবারুদ।

যুদ্ধবিমানের পুরো একটি বহর নিয়ে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ঘুরে বেড়ায় সাগর থেকে মহাসাগরে। সুবিধামতো জায়গায় নোঙর করে শত্রুর ওপর হামলা করতে পাঠায় একের পর এক যুদ্ধবিমান। আজকের দুনিয়ায় পরাশক্তিগুলোর পাওয়ার প্রজেকশন বা ক্ষমতা প্রদর্শনের উপকরণ এটি।

বিশাল রানওয়েযুক্ত ফ্লাইট ডেক ছাড়াও এতে থাকে বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জায়গা, অস্ত্র গুদাম, শক্তি উৎপাদনের জন্য একাধিক নিউক্লিয়ার রিয়্যাকটর, আধুনিক যুদ্ধ ও নেভিগেশন সরঞ্জাম, কয়েক হাজার লোকের থাকা, খাওয়া, শরীরচর্চাসহ সব কিছুর জায়গা। আধুনিক যুদ্ধ বহরের এক অভিনব সংস্করণ এই রণতরী, যা পুরো বিমানঘাঁটিকে নিয়ে চলে যায় শত্রুর ভূখণ্ডের কাছাকাছি। ফাইটার প্লেন, অ্যাটাক হেলিকপ্টারসহ অনেক ধরণের বিমান থাকে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে। এর একটিতে যতগুলো বিমান থাকে বিশে^র বেশির ভাগ দেশের নৌ বাহিনীর কাছে সব মিলেও অতগুলো বিমান নেই।

আধুনিক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে ইতিহাস খুব পুরনো না হলেও জাহাজ থেকে বিমান উড্ডয়নের চেষ্টা বহু যুগের। আমেরিকার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় ১৯০৩ সালে সফলভাবে বিমান নিয়ে প্রথম আকাশে ওড়ার কয়েকদিন আগে মার্কিন নৌ বাহিনীর একটি জাহাজ থেকে কার্টিস পুশার নামক পরীক্ষামূলক আকাশ যান নিয়ে ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন এক ইঞ্জিনিয়ার। ১৯১০ এর দশকের শুরুতে বৃটিশ ও ফরাসি নৌ বাহিনীর জাহাজ থেকে বিমান উড্ডয়ন করা হয়। জাহাজ থেকে বিমান উড্ডয়নের এই সফলতাই মূলত বিমানঘাঁটিকে ভাসমান কাঠামোতে রূপ দেয়ার চিন্তা এনে দেয় সমরবিদদের।

প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় জাপানি বাহিনীর ওয়াকিমায়া নামক জাহাজ থেকে বিমান উড়িয়ে প্রথম বিমান হামলা চালানো হয় প্রতিপক্ষের ওপর। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান ক্রুজার ও জামার্ন গানবোটের ওপর ছোড়া বোমা অবশ্য ঠিক জায়গায় পড়েনি। তবুও বিমান হামলার এই ধারণাটি ব্যাপক পছন্দ হয় সামরিক নীতি নির্ধারকদের। যার ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক বিমানবাহী রণতরী বা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার।

২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বিশে^ সক্রিয় রয়েছে এমন বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা ২০টি। ৯টি দেশের কাছে রয়েছে এগুলো। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে সবচেয়ে বেশি ১১টি। ব্রিটেন, ইতালি ও চীনের রয়েছে দুটি করে। এছাড়া রাশিয়া, ফ্রান্স, ভারত, স্পেন, থাইল্যান্ডের একটি করে। অবশ্য থাইল্যান্ড তার একমাত্র এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটিকে এখন ব্যবহার করে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার হিসেবে, আর ইতালি তার দুটির একটিকে মোতায়েন করেছে এন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য। আরো কিছু দেশের রয়েছে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার।

অর্থাৎ বাকি ৮টি দেশের যে সংখ্যক বিমানবাহী রণতরী রয়েছে তার চেয়ে বেশি আছে যুক্তরাষ্ট্রের একার। এবং যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলোই পারমাণবিক শক্তিচালিত। ফ্রান্সের চার্লস ডি গল নামের দ্বিতীয় রণতরীটি পারমাণবিক শক্তিচালিত। ব্রিটেন খরচের কথা চিন্তা করে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী বানায়নি, কারণ এরকম একটি জাহাজ কয়েক দশক ডিজেল ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনে চলতে যে খরচ হয়, তার চেয়েও বেশি খরচ হয় নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর বসাতে।

পারমাণবিক শক্তিচালিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের বৈশিষ্ট হচ্ছে এতে রিফুয়েলিং বা কোনো জ¦ালানি নিতে হয় না। এমনকি টানা ২০ বছর চলতে পারে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর পরিবর্তন না করেই। এগুলোর ইঞ্জিন, অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুৎ সরবরাহসহ সব শক্তিরই জোগান দেয় নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি মধ্যে ১০টি নিমিৎজ ক্লাস ও অন্যটি জেরাল্ড আর ফোর্ড ক্লাস, যেটি সর্বশেষ ২০১৭ সালে যুক্ত হয়েছে সার্ভিসে। যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো ক্যারিয়ারই আয়তনে বিশাল। গড়ে এগুলোতে ৮০টি বিমান থাকে। অন্য দেশেরগুলোতে বিমান ধারণ সংখ্যা আয়তন ভেদে ৩০ থেকে ৬০টি। যেমন রাশিয়ার অ্যাডমিরাল কুজনেতসভে বিমান বহন করা যায় সর্বোচ্চ ৫০টি।

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের উপরের ডেক অর্থাৎ যেখানে রানওয়ে থাকে সেটিকে বলা হয় ফ্লাইট ডেক। এখান থেকেই বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। রানওয়ের পাশেই থাকে একটি কাঠামো সেটিকে বলা হয় আইল্যান্ড। আইল্যান্ডে থাকে ব্রিজ অর্থাৎ যেখান থেকে ক্যারিয়ারের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর থাকে ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম। বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের নির্দেশনা দেয়া হয় এখান থেকে।

একটি এয়াক্রাফট ক্যারিয়ারে যেটুকু রানওয়ে থাকে তার মাধ্যমে ফাইটার জেটের উড্ডয়ন সম্ভব নয়। যে কারণে উড্ডয়নের জন্য ব্যবহার করা হয় একটি সহায়ক যন্ত্র যেটিকে বলা হয় ক্যাটাপাল্টস। এই যন্ত্রের খাদে বিমানের চাকা রাখা হয়, তার পর যন্ত্র বিমানটিকে রানওয়ের শেষ মাথা পর্যন্ত প্রচণ্ড গতিতে ছুটিয়ে নিয়ে যায় এবং এরপর আকাশে উড়তে পারে বিমানটি। মার্কিন রণতরীগুলোতে চারটি করে ক্যাটাপাল্টস থাকে, তাই প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি করে বিমান উড্ডয়ন সম্ভব এগুলো থেকে। আবার ল্যান্ডিংয়ের সময় এক ধরনের হুক ব্যবহার করা হয়, যেগুলো ডেকের সাথে থাকা শক্ত দড়িতে আটকে বিমানটি দ্রুত থেমে যায়।

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে যতগুলো বিমান বহন করা যায় তার সবগুলো রানওয়েতে রাখা সম্ভব নয়। যে কারণে নিচের ফ্লোরে বিমান রাখার আলাদা জায়গা বানানো হয়। বিশাল আকারের লিফটের সাহায্যে হ্যাঙ্গার থেকে ডেকে আবার ডেক থেকে হ্যাঙ্গারে বিমান ওঠানামা করানো হয়। ফ্লাইট ডেকে কাজ করে শতাধিক ক্রু। তারা বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে সহায়তা করে। উড্ডয়নের জন্য বিমান প্রস্তুত করাও তাদের কাজ।

সব মিলে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে কাজ করে কয়েক হাজার লোক। এর মধ্যে থাকে বৈমানিক, জাহাজ ক্রু, এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, নৌ সেনা, ফায়ার সার্ভিস কর্মী, চিকিৎসক, নার্স, বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে একটি সোসাইটিতে প্রয়োজনীয় এমন সব লোকবল। প্রতিটি বিভাগের কর্মীদের আলাদা রঙের পোশাক থাকে। যেমন হলুদ রঙের পোশাক পরা ক্রুরা বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের নির্দেশনা দেয়। নীল পোশাকের ক্রুরাও এই কাজে সহায়তা করে। আবার যারা গোলাবারুদ আনা-নেয়া ও বিমানের সাথে সংযুক্ত করার কাজ করে তাদের পোশাকের রঙ লাল। বিমান মেনটেইনেন্সে কাজ করে সবুজ পোশাকের কর্মীরা। এমনিভাবে বিশাল এই জাহাজের প্রতিটি বিভাগের কর্মীদের আলাদা করা যায় পোশাক দেখে।

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের কর্মীদের বড় একটি অংশকেই ভেতরে কাজ করতে হয়। এমনকি অনেক দিন পর্যন্ত তাদের সূর্যের আলোও দেখার সুযোগ হয় না। কারন ফ্লাইট ডেক জায়গাটি স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখানে সবার যাওয়ার অনুমতি থাকে না। নিচের দিকে কিছু জায়গায় জানালা ও বারান্দা থাকলেও সেগুলোও বিশেষ বিশেষ জায়গায়।

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ভেতরে এই বিশাল জনবলের জন্য অফিস রুম, আবাসন ব্যবস্থা ছাড়াও থাকে রেস্ট্রুরেন্ট, গ্রোসারি শপ, মেডিকেল ফ্যাসিলিটিস সেলুনসহ অনেক কিছু। তবে এর বড় একটি অংশ জুড়ে থাকে গুদাম। কারণ অন্তত এক মাসের জন্য এতগুলো মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ছাড়াও অস্ত্র গোলাবারুদ মজুদ রাখা হয়। সাবধানতা হিসেবে অস্ত্রগুলো সাধারণত একেবারে নিচের দিকে মজুদ করা হয়, যেসব ফ্লোর পানির নিচে থাকে।

কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে দ্রুত এসব ডেকে পানি প্রবেশ করিয়ে বিস্ফোরণ ঠেকানো যায় তাই এ ব্যবস্থা। প্রয়োজনের সময় লিফটের মাধ্যমে অস্ত্রগুলো তোলা হয় ফ্লাইট ডেকে। একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের পেছনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়।

বর্তমানে বিশে^র সবচেয়ে বড় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের জেরাল্ড আর ফোর্ড ক্লাসের প্রথম তরীটি। ২০১৭ সালে এটি পানিতে নেমেছে। এটি লম্বায় ১০৯২ ফুট। ফ্লাইট ডেকের প্রস্থ ২৫২ ফুট। নিচের দিকের প্রস্থ ১৩৪ ফুট। উচ্চতা ২৫০ ফুট। ডেক বা তলা আছে ২৫টি। দুটি পারমাণবিক রিয়্যাকটর এই বিশাল জাহাজের শক্তি যোগান দেয়। এটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৩ বিলিয়ন বা ১৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এটি নির্মাণ করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান নর্থ থ্রপ গ্রুম্যান। এটির ক্রু সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের কিছু বেশি। এই জাহাজের গতি ৩০নটস বা ঘণ্টায় প্রায় ৫৬ কিলোমিটার।

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব একটা জোরালো হয় না। যে কারণে বেশির ভাগ দেশের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো চলাচল করে বিশাল বহর নিয়ে। এই বহরকে বলা হয় ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ। এই গ্রুপে মিসাইল ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার, ফিগেট, সাবমেরিন ও সাপ্লাই শিপ থাকে। এই জাহাজগুলো মূলত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে পাহারা দেওয়ার কাজ করে। অবশ্য রাশিয়ার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এডমিরাল কুজনেতসভে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ শক্ত যে কারণে এটি একাই সাগরে চলাচল করে।