নৌপথে শত্রুর মোকাবিলা বা প্রতিরক্ষার জন্য তৈরি করা হয় যুদ্ধজাহাজ। যুদ্ধজাহাজের মধ্যে ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট ও করভেট সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। আকার, প্রযুক্তি, সমরাস্ত্র ও কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন পার্থক্য রয়েছে এই রণতরীগুলোর মধ্যে। এগুলোর সংখ্যার ভিত্তিতেও অনেক সময় কোনো দেশের নৌবাহিনীর শক্তিমত্তা বোঝা যায়।
ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট ও করভেট- তিনটি যুদ্ধজাহাজই আজকের দুনিয়ায় নৌ-শক্তিমত্তার কমন একটি উপকরণ। তিনটি যুদ্ধজাহাজ অনেকটা একই ধরনের। তবে আকার-আকৃতি, যুদ্ধকরার ক্ষমতা ও কাজের ধরন অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট অনেক বেশি কাছাকাছি ধরনের দুটি রণতরী। এসব যুদ্ধজাহাজ তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে দিকটি বিবেচনা করা হয় সেটি হলো- এর কুইক রেসপন্স ক্যাপাসিটি। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় দ্রুততার সাথে যেন সেটি কাজে লাগানো যায়। পাশাপাশি এর প্রতিরক্ষা ও পাল্টা আক্রমণের বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়।
যে কোন সামরিক বা বেসামরিক জাহাজকে পাহাড়া দেয়া এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যই ডেস্ট্রয়ার তৈরি করা হয়। সামরিক বা বেসামিরক কোন নৌবহরে প্রতিরক্ষার প্রধান দায়িত্ব থাকে ডেস্ট্রয়ারের ওপর। বিমানবাহী রণতরীর নেতৃত্বে যে ব্যাটল গ্রুপ বা ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ থাকে তাতেও প্রতিরক্ষার প্রধান দায়িত্বটা থাকে ডেস্ট্রয়ারের ওপর। সাধারণত বিমানবাহী রণতরীগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতটা শক্তিশালী হয় না। তাই এই বিশাল জাহাজকে শক্রুর টর্পেডো, সাবমেরিন ও বিমান হামলা থেকে রক্ষার করার দায়িত্ব থাকে একটি বা দুটি ডেস্ট্রয়ারের ওপর। অর্থাৎ একটি ডেস্ট্রয়ার স্বাধীনভাবে যুদ্ধ করার চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করে নৌবহরের নিরপত্তার কাজে।
১৯০৪ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় স্প্যানিশ নৌবাহিনী প্রথম এ ধরনের নৌযান সাগরে নামায়। শত্রু বাহিনীর টর্পেডো বোটের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য এগুলো তৈরি করা হয়। তখন এর নাম দেয়া হয় টর্পেডো বোট ডেস্ট্রয়ার। ডেস্ট্রয়ার শব্দের অর্থা ধ্বংসকারী। সেই থেকেই এই যুদ্ধজাহাজের নাম হয়ে যায় ডেস্ট্রয়ার। দিনে দিনে আরো উন্নত হয় এই জাহাজ। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর থেকে ডেস্ট্রয়ারে যুক্ত হতে থাকে গাইডেড মিসাইল। যে কারণে এটি প্রতিরক্ষা ছাড়াও আক্রমণের কাজেও ব্যবহার শুরু হয়। সাধারণত ডেস্ট্রয়ার আকারে বড় হয় ফ্রিগেট ও করভেটের চেয়ে।
ডেস্ট্রয়ার শিপ সবচেয়ে বেশি আছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাদের এই সংখ্যা ৬৮টি। জাপানের ৩৭টি ও চীনের ৩৩টি ডেস্ট্রয়ার রয়েছে। রাশিয়ার আছে মাত্র ১২টি। সবমিলে ২৩টি দেশ ডেস্ট্রয়ার ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের জুমওয়াল্ট ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের দৈর্ঘ ৬১০ ফুট বা ১৯০ মিটার। দেশটির এ ধরনের ডেস্ট্রয়ার রয়েছে দুটি। এছাড়া তাদের আর্লিঘ বুর্ক ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের দৈর্ঘ্য ৫০৫ থেকে ১০ ফুট। অবশ্য ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির টাইপ ফোরটি ফাইভ ডেয়ারিং ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার বা ৪৯২ ফুট। আরো কিছু দেশের রয়েছে এমন ছোট আকারের ডেস্ট্রয়ার। ডেস্ট্রয়ারের গড় গতি ৩০ কিলোনটের আশপাশে।
আকার, গতি ও অস্ত্রভাণ্ডারে ডেস্ট্রয়ারের চেয়ে কিছুটা পির্ছিয়ে রয়েছে ফ্রিগেট। অপেক্ষাকৃত কম গতির সাপ্লাই জাহাজ বা এ ধরনের অন্য জাহাজগুলোকে নিরাপত্তা দেয় ফ্রিগেট। এগুলোর গড় গতি ২৫ কিলোনট।
নৌ-সেক্টরে ফ্রিগেট খুব পুরনো এক যুদ্ধজাহাজ। সেই পালতোলা জাহাজের যুগ থেকেই বিশে^ ফ্রিগেটের প্রচলন। সপ্তদশ শতাব্দীতে, দ্রুতগামী ও নিপুণভাবে পরিচালনসক্ষম যুদ্ধজাহাজকে ফ্রিগেট বলা হতো। এরপর যুগে যুগে এর দ্রুত উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে নৌপথে শক্রুর মোকাবেলা করে ফ্রিগেট। ফ্রিগেট বেশির ভাগ সময় সমুদ্রসীমায় স্বাধীনভাবে যুদ্ধ করার জন্য মোতায়েন করা হয়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে নৌবহরের সাথেও থাকে এটি।
রাশিয়ার অ্যাডমিরাল গোলশকভ ক্লাস ফ্রিগেটগুলোর দৈর্ঘ্য ১৩০ মিটারের আশপাশে। বিশে^ সব মিলে ৫৫টি দেশের নৌবহরে ফ্রিগেট রয়েছে। চীনের আছে সবচেয়ে বেশি ৫২টি ফ্রিগেট। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে তাইওয়ান। তাদের ফ্রিগেট সংখ্যা ২৪টি। যুক্তরাষ্ট্রের আছে ২২টি। সব মিলে প্রায় ৬০টি দেশের নৌবাহিনীতে রয়ৈছে এই যুদ্ধজাহাজ। সামরিক শক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য মতে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর রয়েছে চীনের তৈরি ৭টি ফ্রিগেট।
ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ার প্রায় একই ধরনের যুদ্ধজাহাজ হওয়ার কারণে এ দুটির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা কঠিন। দুই ধরনের জাহাজেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যব¯’া থাকে। থাকে শত্রু যান সনাক্ত করার উন্নত সেন্সর ও রাডার। এসকর্ট কিংবা নিজস্ব সুরক্ষার জন্য এগুলো এই জাহাজের প্রধান উপকরণ। সাধারণত একটি ক্যারিয়ার স্ট্রাকই গ্রুপে ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট দুই ধরনের জাহাজই থাকে।
একটি ডেস্ট্রয়ারে ৩০০জন পর্যন্ত ক্রু থাকে। ফ্রিগেটে থাকে দেড়শো থেকে ২০০ জন পর্যন্ত। দুই ধরনের জাহাজের অস্ত্র ভাণ্ডারে বড় পার্থক্য রয়েছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ডিউক ক্লাস ফ্রিগেটে এন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের বিশেষ প্রযু্িক্ত রয়েছে। এগুলো সাবমেরিন সনাক্ত করার ব্যবস্থা ও সাবমেরিন বিধ্বংসী টর্পেডো ছোড়ার ক্ষমতা থাকে।
এ ধরনের ফ্রিগেটে সাধারণত হেলিপ্যাড ও হ্যাঙ্গার থাকে হেলিকপ্টার অবতরণ ও বহনের জন্য। এসব হেলিকপ্টারের ক্ষমতা থাকে পারমাণবিক সাবমেরিন সনাক্ত করা ও আঘাত করার। ব্রিটিশ ডিউক ক্লাস ফ্রিগেটে থাকে দুটি টুইন স্টিং টর্পেডো টিউব। আর এতে বহনযোগ্য হেলিকপ্টারে থাকে চারটি পর্যন্ত টর্পেডো টিউব।
তবে ফ্রিগেটের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ততটা শক্তিশালী নয়। এই যুদ্ধজাহাজ তার আশপাশে থাকা নৌযানগুলোকে আকাশ হামলা থেকে রক্ষা করতে খুব একটা সক্ষম নয়। প্রধানত এন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার ও স্বল্প পাল্লার এয়ার ডিফেন্স প্রযুক্তি থাকে এতে।
সে তুলনায় ডেস্ট্রয়ার অনেক বেশি শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ। অনেক ডেস্ট্রয়ার জাহাজ ও বিমান বিধ্বংসী গাইডেড মিসাইল ছোড়ার জন্যই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জুমওয়াল্ট ও আর্লিঘ ক্লাস, রাশিয়ার সোভারমেনি ক্লাস ও ব্রিটেনের ডেয়ারিং ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে রয়েছে এসব প্রযুক্তি। উদাহরণর স্বরূপ বলা যায়, ব্রিটিশ ডেয়ারিং ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের সি ভাইপার কম্প্রিহেনসিপ ডিফেন্স সিস্টেম ৪০০ কিলোমিটার দূর থেকে টার্গেট সনাক্ত করতে পারে। আর এসব টার্গেটের উদ্দেশ্যে ছড়তে পারে অ্যাস্টার ফিফটিন ও অ্যাস্টার থার্টি সারফেস টু এয়ার মিসাইল। যুক্তরাষ্ট্রের জুমওয়াল্ট ক্লাস ডেস্ট্রয়ার ছুড়তে পারে সি স্প্যারো মিসাইল ও টোমাহক সাবসনিক ক্রুজ মিসাইল।
গাইডেড মিসাইল ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের এই ক্ষমতার কারনেই নৌযুদ্ধে ডেস্ট্রয়ার অনেক এগিয়ে থাকে ফ্রিগেটের চেয়ে। উদারহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আর্লিঘ ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ১টি ১২৭ মিলিমিটারের লাইটওয়েট গান, ২০ মিলিমিটার ফ্যালানক্স ডিফেন্স গান, ২টি হারপুন এন্টিশিপ মিসাইল, টোমাহক ল্যান্ড অ্যাটাক মিসাইল রয়েছে। এছাড়াও আছে এন্টি ব্যালেস্টিক মিসাইল ও সারফেস টু এয়ার মিসাইল।
করভেট হচ্ছে সবচেয়ে ছোট যুদ্ধজাহাজ। অন্য ভাবেও বলা যায়, যেসব নৌযান যুদ্ধজাহাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির নাম করভেট। সাধারণত ৫৫ থেকে একশো মিটার দৈর্ঘ্য হয় করভেটের। উপকূল পাহাড়া দেয়া, ছোট খাট যুদ্ধে ভুমিকা রাখার কাজে করভেট ব্যবহৃত হয়।
বিশ^জুড়ে উন্নত সব প্রযুক্তি ও নৌযান আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় পরাশক্তিগুলো তাদের নৌবহরে করভেটের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রর দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পরপরই তাদের সবগুলো ফøাওয়ার ক্লাস করভেটকে অবসরে পাঠিয়েছে। চীন মাত্র একটি করভেট ব্যবহার করে। তবে রাশিয়ার নৌবাহিনীতে এখনো প্রায় ৮০টির মতো করভেট সক্রিয় রয়েছে। করভেটে স্বল্প পাল্লার মিসাইল, কামান ও এন্টি সাবমেরিন রকেট থাকে। তবে এর রাডার ও সেন্সর ততটা উন্নত নয়।
ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট হাতে গোনা কয়েকটি দেশের কাছে থাকলেও বিশে^র অনেক দেশের কাছেই করভেট রয়েছে। বাংলাদেশের নৌবাহিনীর রয়েছে ৬টি করভেট। উইকিপিয়িার তথ্য মতে, চীনের তৈরি চারটি টাইপ জিরো ফাইভ সিক্স করভেট ব্যবহার করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। দৈর্ঘ্য ৯০ মিটার বা ৩০০ দৈর্ঘের করভেটগুলোতে ৭৬ মিলিমিটার গান, সি-৮০২ এন্টি শিপ মিসাইল এবং এফএল থ্রি থাউজেন্ট সারফেস টু এয়ার মিসাইল রয়েছে। এর সর্বোচ্চ গতি ২৫ নট বা ঘণ্টায় ৪৬ কিলোমিটার। এছাড়া ইতালির তৈরি মিনারভা ক্লাস করভেট ব্যবহার করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড বাহিনী।