আফ্রিকার পরাশক্তি আলজেরিয়ার সামরিক শক্তি


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০১ জুলাই ২০২১, ১৩:২৮

দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বাধীনতা পাওয়া এক দেশ আলজেরিয়া। স্বাধীনতার পরও দেশটি জড়িয়েছে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো সামরিক দিক থেকে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে দেশটি। ফাইটার জেট, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, সাবমেরিনসহ সব দিকেই উল্লেখ করার মতো যুদ্ধসামগ্রী রয়েছে আলজেরিয়ার।

আফ্রিকা মহাদেশ ও আরব বিশে^র সবচেয়ে বড় দেশ আলজেরিয়া। সামরিক শক্তিতেও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম প্রধান দেশটি ওই অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধ শেষে ১৯৬২ সালে দেশটি ফ্রান্সের উপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দীর্ঘ ওই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিহত হয়েছেন দেশটির কয়েক লাখ মানুষ।

স্বাধীনতা লাভের পর দেশটির শাসকরা দ্রুত সামরিক শক্তি বৃদ্ধির গুরুত্ব উপলব্ধি করে। যে কারণে তারা সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার দিকে গুরুত্ব দেয়। এক্ষেত্রে দেশটি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে রাশিয়ার কাছ থেকে। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধ চলাকালে গঠিত প্রভিশনাল সরকারকেও প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে তারা। এমনকি স্বাধীন দেশ হিসেবে আলজেরিয়া আত্মপ্রকাশ করার কয়েক মাস আগেই মস্কো তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপন করে।

সম্পর্কের এই ধারা পরবর্তীতেও অব্যাহত থেকেছে। আর সব সেক্টরের মতো সামরিক খাতেও মস্কো ব্যাপক সহযোগিতা করেছ আলজেরিয়াকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পরাশক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়ে তাই দ্রুতই নিজেদের উন্নতি ঘটিয়েছে আলজেরিয়ার সশস্ত্র বাহিনী।

এক হিসেবে দেখা গেছে, আলেজিরয়ার স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত মস্কোর কাছ থেকে সামরিক সহযোগিতা পেয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলারের। ১৯৯৩ সালের এক হিসেবে দেখা গেছে আলজেরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্র ভাণ্ডারের ৯০ শতাংশ অস্ত্রই সোভিয়েত ইউনিয়নের।

মাঝখানে কিছুদিন আলজেরিয়ার শাসকরা ন্যাটো ব্লকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালেও ১৯৯৯ সালে আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আবার ঘনিষ্ঠ হয় মস্কো ও আলজিয়ার্সের সম্পর্ক। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে আলজেরিয়ার ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মওকুফ করে রাশিয়া এবং একই সাথে নতুন করে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করে।

মস্কোর এই আনুকূল্য পাওয়ার কারণে আলজেরিয়া দ্রুত সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করতে পেরেছে। রাশিয়ার তৈরি অনেক আধুনিক প্রতিরক্ষা সামগ্রী এসেছে আলজেরিয়ার হাতে। সামরিক শক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৪০ দেশের মধ্যে ২০২১ সালে আলজেরিয়ার অবস্থান ২৭ নম্বরে। সামরিক বাহিনীর পেছনে প্রচুর খরচও করে দেশটির সরকার। বর্তমানে আলজেরিয়ার ডিফেন্স বাজেট প্রায় ১৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।

আলজেরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অফিশিয়াল নাম পিপলস ন্যাশনাল আর্মড ফোর্সেস। বাহিনীটি চারটি ভাগে বিভক্ত। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর পাশাপাশি আছে টেরিটোরিয়াল এয়ার ডিফেন্স ফোর্স নামের আরেকটি বাহিনী। সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যার দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার নিয়মিত সদস্য। দেড় লাখ রয়েছে রিজার্ভ সদস্য। আর প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজার।

আলজেরিয়ার স্থল বাহিনীর ট্যাংক রয়েছে ২ হাজার ২৪টি, সাঁজেয়া যানের সংখ্যা ৭ হাজার। সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি বা ভ্রাম্যমান কামান ৩২৪ টি। টাউড আর্টিলারি বা অন্য যানবাহনের ওপর স্থাপনযোগ্য কামানের সংখ্যা ৩৯৬টি। আর রকেট প্রজেক্টর আছে ৩০০টি।

আলজেরিয়ার সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে রাশিয়ার তৈরি তৃতীয় প্রজন্মের টি-নাইনটি এসএ মেইন ব্যাটল ট্যাংক। তাদের এই ট্যাংকের সংখ্যা ৫৭২টি। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি টি-সেভেনটি টু, টি-সিক্সটি টু ও টি-ফিফটি ফাইভ এএমভি ট্যাংক রয়েছে তাদের হাতে। আলজেরিয়ার অন্যান্য স্থল যুদ্ধযানগুলোরও বেশির ভাগই রাশিয়ার তৈরি। কিছু আছে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের তৈরি। চীনের তৈরি কামান, মর্টার, রকেটও ব্যবহার করছে তারা।

আলজেরীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিন আছে ৮টি, আছে সমান সংখ্যক ফ্রিগেট ও ১০টি করভেট। এছাড়া মাইন অনুসন্ধানী নৌযান আছে ২টি। আর উপকূল জুড়ে টহল দেয়ার জন্য সামরিক নৌযানের সংখ্যা ৬৫টি। শক্তিতে নৌবাহিনী তুলনামূলক পিছিয়ে থাকলেও আজেরিয়ার বিমান বাহিনী বেশ শক্তিশালী।

আলজেরিয়ার মোট ১১টি বিমান ঘাঁটি রয়েছে । বিমান বাহিনীর মোট এয়ারক্রাফট আছে সাড়ে পাঁচশো। এর মধ্যে ১০২টি ফাইটার। ডেডিকেটেড অ্যাটাক ফাইটার আছে ২২টি। স্পেশাল মিশন এয়ারক্রাফট ৯টি আর অ্যাটাক হেলিকপ্টার সংখ্যা ৪৫টি। এছাড়া প্রশিক্ষণ বিমান ৮৭টি ও রিফুয়েলিং বিমান ৩টি।

১৯৬৩ সালে মরক্কোর সাথে সীমান্তে সঙ্ঘাতের পর বিমানবাহিনীকে আধুনিকায়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেয় আলজেরিয়া। দ্রুততার সাথে তারা মিগ-সেভেনটিন, মিগ-টুয়েন্টি ওয়ানসহ বেশ কিছু লাইট বোম্বার কেনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। পরবর্তীতে নতুন ধারার বিভিন্ন যুদ্ধ বিমান যুক্ত হয়েছে দেশটির বহরে।

বর্তমানে আলজেরিয়ার আকাশসীমা পাহাড়া দেয় রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক সুখোই সু-থার্টি অ্যাটাক ফাইটার। ন্যাটো যেটির নাম দিয়েছে ফ্ল্যাঙ্কার। যে কোন আবহাওয়ায় এয়ার-টু-এয়ার ও এয়ার-টু-সারফেস আক্রমণের জন্য এই ফাইটার বিশে^ সেরাদের একটি। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-ফিফটিন স্ট্রাইক ইগলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এই ফাইটারটি তৈরি করেছিলো মস্কো। ২০১৫ সালে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকারের পক্ষে যুদ্ধে নেমে এই ফাইটারটি ব্যবহার করেছিল রুশ বিমান বাহিনী। লং রেঞ্জের অ্যারে রাডারযুক্ত বিমানটি আলজেরীয় বহরে আছে ৫৭টি। আরো ১৬টি কেনার জন্য চুক্তি করেছে তারা।

এছাড়া সু-টুয়েন্টি ফোর অ্যাটাক ফাইটার আছে ২২টি। মিগ-২৫ ইন্টারসেপ্টর আছে ১৩টি। আছে ৩২টি মিগ-২৯ মাল্টিরোল ফাইটার। এসব ফাইটার থেকে বিভিন্ন পাল্লার ক্রুজ মিসাইল ছোড়া যায়। এছাড়া আছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি কয়েকটি নজরদারি বিমান।

রাশিয়ার তৈরি সর্বাধূনিক সু-৫৭ স্টিলথ ফাইটার কেনার ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে আলজেরিয়া। সব কিছু ঠিক থাকলে তুরস্কের পাশাপাশি আলজেরিয়াও পেতে যাচ্ছে আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তৈরি এই যুদ্ধ বিমান। বিভিন্ন সূত্রের খবর, আলজেরিয়া ১৪টি সু-৫৭ কেনার ব্যাপারে জোর আলোচনা চালাচ্ছে মস্কোর সাথে। এছাড়া সু-৩৪ ও সু-৩৫ যুদ্ধবিমানও পেতে চায় তারা।

চীন থেকেও ফাইটার জেট কেনার ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে দেশটির সামরিক কর্তারা। চীনের তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের জেএফ-সেভেনটিন থান্ডার জেট আলজেরিয়ার কাছে বিক্রির ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে বেইজিং। এই উদ্যোগগুলো আলোর মুখ দেখলে আলজেরিয়ার বিমান বাহিনী আফ্রিকা ও আরব অঞ্চলে যে কোন দেশের বিমান বাহিনীর সাথে টক্কর দেয়ার সামর্থ অর্জন করবে সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দিক থেকেও বেশ এগিয়েছে আলজেরিয়ার সশস্ত্র বাহিনী। তাদের টেরিটোরিয়াল এয়ার ডিফেন্স ফোর্স নামের বাহিনী আকাশ প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। এয়ার ডিফেন্সের ক্ষেত্রে আলজেরিয়ার রয়েছে বেশ কিছু উন্নত ডিফেন্স ব্যাটারি।

ইতোমধ্যেই আলজেরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছে বলে বিভিন্ন খবরে প্রকাশ হয়েছে। আলজেরিয়ার কাছে এর চারটি রেজিমেন্ট আছে বলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়। এস-৪০০ এই মূহুর্তে বিশে^র সর্বাধূনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। তবে এ বিষয়ে মস্কো কিংবা আলজিয়ার্স প্রকাশ্যে কোন ঘোষণা দেয়নি।

অবশ্য আরো অনেক আগ থেকে এর পূর্ববর্তী সংস্করণ এস-৩০০ ব্যবহার করে আসছে আলজেরিয়া। এস-৩০০ এর পূর্ণাঙ্গ আটটি রেজিমেন্ট রয়েছে তাদের। এর প্রতিটি রেজিমেন্টে আছে ১২টি মিসাইল লঞ্চার, যার প্রতিটি ছুড়তে পারে ৪টি করে সারফেস টু এয়ার মিসাইল। রাশিয়ার তৈরি ৩৮টি প্যান্টসার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও আছে দেশটির। আছে জার্মানির তৈরি স্বল্প পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম স্কাইশিল্ড।

আলজেরিয়ার আরো আছে চীনের তৈরি এইচকিউ-৯ সারফেস টু এয়ার মিসাইল। এই দূরপাল্লার মিসাইলটি যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের সমপর্যায়ের। আরো আছে রাশিয়ার তৈরি বাক-এম টু মিসাইলসহ বেশ কিছু মাঝারি ও স্বল্প পাল্লার মিসাইল সিস্টেম।

আমদানি নির্ভর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আলজেরিয়া কিছু সামগ্রী নিজেরাও উৎপাদন করে। দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পে কিছু অস্ত্র ছাড়াও, বিভিন্ন দেশের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সামরিক যান, হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব সামগ্রী রফতানিও করে আলজেরিয়া। রাশিয়ার সু-ফিফটি সেভেন ফাইটার নির্মাণ প্রকল্পে জড়িত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে আলজেরিয়া। সেটি হলে এয়ারক্রাফট নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হবে দেশটি।