ভূমধ্যসাগর ঘিরে রাশিয়ার যুদ্ধ-প্রস্তুতি


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৫ জুলাই ২০২১, ১৪:২৭

রাশিয়ার বিমানবাহিনী সম্প্রতি দুটি মিগ-৩১-কে সিরিয়ায় তাদের প্রধান বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন করেছে। এর মধ্যে একটি মিগ বিমানের ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, বিমানটি খেমেইমিম বিমানঘাঁটি থেকে উড়ছিল। এই বিমানঘাঁটি লাটাকিয়ার দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকায়। বিমানটির সাথে আছে বড় আকারের একটি কিনঝাল হাইপারসনিক মিসাইল। রাশিয়া এমন এক সময় এই বিমান মোতায়েন করল, যখন ব্রিটেনের নৌবাহিনী রয়াল নেভির নতুন একটি বিমানবাহী রণতরী এইচএমএস কুইন এলিজাবেথ এবং আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ ভূমধ্যসাগরের আশপাশেই টহল দিচ্ছে।

ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে সম্প্রতি একটি এফ-৩৫ স্টেলথ বিমান উড়ে গিয়ে ইরাকের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালিয়েছে। এর কয়েকদিন পর ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার এইচএমএস ডিফেন্ডার কুইন এলিজাবেথ ব্যাটল গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভূমধ্যসাগর থেকে রওনা দিয়ে কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করে। পরে ডেস্ট্রয়ারটি রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়ায় পাশ দিয়ে যাতায়াত করে। এরপরই রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে দেখা দেয় উত্তেজনা।

কৃষ্ণসাগরে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজকে লক্ষ্য করে রাশিয়ার সতর্কতামূলক গুলি ছোড়ার ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে দুই দেশের মধ্যে। রাশিয়া বলছে, কৃষ্ণসাগরে তাদের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘এইচএমএস ডিফেন্ডার’। ফাঁকা গুলি ছুড়ে সতর্কবার্তা দেয় সেখানে টহলে থাকা রুশ জাহাজ। কিছুক্ষণের মধ্যে যুক্ত হয় মস্কোর যুদ্ধবিমান।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মস্কোর দাবিকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সেখানে কোনো ধরনের গুলির ঘটনা ঘটেনি। নিজেদের জাহাজটি ইউক্রেনের জলসীমায় ছিল বলেও দাবি দেশটির। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস জানান, আমাদের যুদ্ধজাহাজ আন্তর্জাতিক জলসীমানাতেই অবস্থান করছিল। একই সময়ে ওই অঞ্চলে বন্দুক মহড়া হয় রাশিয়ার। কিন্তু আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি অথবা বোমা ছোড়া হয়নি। এর পরপরই কৃষ্ণসাগরে ফের উসকানি না দিতে ব্রিটেনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। এমন ঘটলে ক্রিমিয়া উপকূলে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে বোমা ছোঁড়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছে রাশিয়া।

রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আইনকে না মানলে আমরাও যুদ্ধজাহাজে বোমা নিক্ষেপ করব। কারণ ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ রাশিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, তাদের যুদ্ধজাহাজ আন্তর্জাতিক আইন মেনেই চলছে। সেটি ইউক্রেনের জলসীমায় চলছিল এবং চলার অধিকার আছে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস দাবি করেছেন, রয়্যাল নেভি আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে এবং যুদ্ধজাহাজের চলাচলও অব্যাহত রাখবে। ব্রিটেন ইউক্রেইনের জোর সমর্থক। তাদের যুক্তি: কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেইনের ওডেসা বন্দর থেকে জর্জিয়ায় যাওয়ার জন্য এইচএমএস ডিফেন্ডারের জন্য ওটাই ছিল সবচেয়ে সহজ পথ। কিন্তু পথটি ক্রিমিয়া উপদ্বীপের কয়েক মাইল দূর দিয়ে যায়। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে।

রাশিয়া ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর মধ্যে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা ঘটেছে সেভাস্টোপল বন্দরের খুব কাছে। কৃষ্ণসাগরের এই বন্দরে রাশিয়ার একটি বিশাল নৌঘাঁটি রয়েছে। ন্যাটো সদস্য ব্রিটেনের ডেস্ট্রয়ার যখন রাশিয়ার দাবি করা জলসীমার ভেতর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনাটিকে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করে।

রাশিয়ার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আরও বাড়িয়েছে এ অঞ্চলে ন্যাটোর সপ্তাহব্যাপী নৌ মহড়া আয়োজনে। রাশিয়া এ নৌ মহড়াকে আপত্তি তুললেও ন্যাটোর নীতি নির্ধারকেরা তাতে খুব একটি গ্রাহ্য করেননি। ডিফেন্ডার টোয়েন্টি ওয়ান নামের এ মহড়ার মধ্য দিয়ে ন্যাটো সেনারা বড়ো পরিসরের একটি মহড়ায় অংশ নেয়ার সুযোগ পায়।

ন্যাটোর মহড়ার বিপরীতে রাশিয়া হাইপারসনিক মিসাইলসহ যে মিগ থার্টিওয়ানগুলো মোতায়েন করেছে তা জাহাজ বিধ্বংসী হিসেবে খুবই শক্তিশালী। শুধু মিগ থার্টিওয়ান পাঠিয়েই রাশিয়া ক্ষান্ত হয়নি। গত মাসে রাশিয়ার বিমানবাহিনী তিনটি টিইউ টোয়েন্টিু এম বোম্বারও খিমেইমিম বিমানঘাঁটিতে পাঠায়। এই বোমারু বিমানগুলোর সাথে কেএইচ টোয়েন্টি টু এন্টি শিপ ক্রুজ মিসাইলও পাঠানো হয়।

মিগ থার্টিওয়ান এবং টিইউ টোয়েন্টিু এম বোমারু বিমান একসাথে এ এলাকায় থাকায় ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন থাকা ন্যাটোর নৌযানগুলো বড়ো আকারের ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এর আগে সিরিয়ায় যেসব মিগ থার্টিওয়ান মোতায়েন ছিল তাতে কিনঝাল মিসাইল থাকতো। এগুলোর গতি ম্যাক টেন স্পিডে। ১২শ মাইল পথও এ মিসাইলগুলো অতিক্রম করতে পারে। এ কারণে কিনঝাল হাইপারসনিক মিসাইল প্রতিপক্ষের জন্য রীতিমতো আতংকের কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে।

সিরিয়ায় কিনঝাল মিসাইল মোতায়েনকে রাশিয়ার সামরিক প্রস্তুতির অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছে। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিরিয়ায় রাশিয়া শুধু কিনঝাল নয় বরং আরও অনেক অস্ত্রের কার্যকারিতাই পরীক্ষা করেছে। সিরিয়ার আবহাওয়া ও তাপমাত্রা রাশিয়া থেকে অনেকটাই আলাদা। রাশিয়া নিজেদের জলবায়ুতে যে অস্ত্রগুলোকে কার্যকর মনে করছে, তা ভিন্ন পরিবেশে আসলেই কতটা কার্যকর, তা নিশ্চিত হওয়া রাশিয়ার দিক থেকে প্রয়োজন ছিল।

সিরিয়ার বিমানঘাঁটিতে মিগ মোতায়েন করার মধ্য দিয়ে এই ঘাঁটিটি রাশিয়া হাইপারসনিক প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে এলো। টিইউ টোয়েন্টিু এম বোমারু বিমানের তুলনায় মিগ থার্টি ওয়ান দিয়ে অল্প সময়ে বেশি সফলতা পাওয়া যায়। মিগ থার্টিওয়ানকে সিরিয়ায় নিয়মিত অপারেশনে ব্যবহার করার পাশাপাশি রাশিয়ার বিমানবাহিনী সিরিয়ায় বেশ কয়েকটি পেট্রোল প্লেনও পাঠায়। আধুনিক এসব পেট্রোল বিমান প্রথাগত টি-ওয়ান ফোর্টিটু পেট্রোল বিমানের চেয়েও বড়ো ও কার্যকর। পেট্রোল বিমানগুলো ড্রোনের সাথে সমন্বয় করে কাজ করায় প্রতিপক্ষের নৌবাহিনীকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।

ডাবল আই থার্টি এইট, টিইউ ওয়ান ফোর্টিটু এস এবং ড্রোনগুলো হলো স্পট শিপ। অন্যদিকে, মিগ থার্টিওয়ান এবং টিইউ টোয়েন্টিটু বোমারুগুলো এ ধরনের স্পট শিপের ওপর বোমা হামলা চালায়। যখন থেকে ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্রগুলো ভূমধ্যসাগরে জাহাজ মোতায়েন শুরু করেছে তখন থেকে রাশিয়াও সেখানে এন্টি শিপ ফোর্স পাঠানো শুরু করে। বিশ্লেষকরা বলছেন আগামী দিনে এ অঞ্চলে কী ঘটবে তা বলা কঠিন। তবে রাশিয়া যেভাবে ব্রিটেনের নৌযান মোতায়েন নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা মোটেও ভালো ইংগিত করছে না। আগামী দিনে উভয় দিক থেকেই আরও বেশি আক্রমনাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

এদিকে রাশিয়া ওরিয়ন-ই নামক কমব্যাট ড্রোনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ড্রোনের বাজারে প্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যেই রাশিয়ার এ ড্রোন নিয়ে অনেক দেশই আগ্রহ দেখিয়েছে। এর আগে ওরিয়নের যে সংস্করনটি রাশিয়া ছেড়েছিল তাতে বিমান উপযোগী কোনো অস্ত্র ছিল না। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অস্ত্র রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রোসোবর্ন এক্সপোর্ট ক্রোনশটাট নামে আরেকটি কোম্পানীর সাথে মিলে মনুষ্যবিহীন এই ড্রোন উদ্ভাবন করেছে।

রাশিয়ার এ ড্রোনগুলোতে সর্বাধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থা যুক্ত থাকছে। সম্ভাব্য ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন কিছু প্রযুক্তিও সংযুক্ত করা হয়েছে। ২০২১ সালের শেষ দিকে এই ড্রোনের আনুষ্ঠানিক উৎপাদন ও বিক্রিতে যাবে রাশিয়া। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন রাশিয়ার এই ওরিয়ন-ই কমব্যাট ড্রোনটি বিশ্ব অস্ত্র বাজারে তাক লাগিয়ে দেবে। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত তুর্কী ড্রোন বেরাকতারের চেয়েও বড়ো চমক হিসেবে ওরিয়ন ড্রোনগুলো আসতে পারে।

রোসোবর্ন এক্সপোর্ট এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ওরিয়ন ড্রোনের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তারা জানিয়েছে, নতুন ড্রোনগুলোর রফতানি সম্ভাবনা খুবই বেশি। তাছাড়া এ ড্রোনগুলোতে সুনির্দিষ্ট কিছু ট্যাকটিকাল এবং কমব্যাট পারদর্শিতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। ওরিয়ন ড্রোনগুলো ২শ কেজির মতো কমব্যাট লোড বহন করতে পারবে।

গত বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সমরাস্ত্র সংক্রান্ত একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে। যেখানে তারা প্রথমবারের মতো দীর্ঘ সময় আকাশে ভেসে থাকার মতো এবং টার্গেটে সঠিকভাবে বোমা নিক্ষেপ করার মতো ড্রোনের ধারণা প্রদান করে। একই ক্যালেন্ডারে রাশিয়ার তরফ থেকে স্টেলথ ভারী কমব্যাট ড্রোন ওখোটনিক বা হান্টার চালু করারও ঘোষণা দেয়া হয়। আগামী বছর থেকেই পরীক্ষামূলকভাবে অখোটনিকের উড্ডয়ন শুরু হবে। পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সময়েই এয়ার টু এয়ার মিসাইলও ব্যবহার করা হবে। পাশাপাশি, আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য অস্ত্রগুলোকেও ব্যবহারের পরিকল্পনাও রয়েছে।