রাশিয়া-ন্যাটো যুদ্ধের শঙ্কা


  • মোতালেব জামালী
  • ০৬ জুলাই ২০২১, ১২:২৭

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বহুল প্রত্যাশিত বৈঠকটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটবে। এমনকি যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এরইমধ্যে এর আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাইডেনের রাশিয়া-বিরোধী বক্তব্য শীর্ষ সম্মেলনকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস ডিফেন্ডার গত ২৩ জুন যখন ক্রিমিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করে, তখনই যুদ্ধের ঘণ্টা বেজে গেছে। এই যুদ্ধজাহাজটি ন্যাটোর একটি নৌমহড়ায় অংশগ্রহণের জন্য কৃষ্ণসাগরে অবস্থান করছিল। মহড়া শুরুর আগে জাহাজটি ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর পরিদর্শন করে। এরপর সেখান থেকে জর্জিয়ার বাতুমি বন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। জাহাজটি ক্রিমিয়া উপদ্বীপে রাশিয়ার দাবি করা জলসীমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রুশ সামরিক বাহিনীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রাশিয়ার সেনারা এইচএমএস ডিফেন্ডারকে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এমনকি তারা পানিতে বোমাও ফেলে। এরপর ব্রিটিশ জাহাজটি দ্রুত আন্তর্জাতিক নৌসীমায় চলে যায়।

রাশিয়া অভিযোগ করেছে, ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস ডিফেন্ডার ক্রিমিয়ায় তাদের জলসীমায় অনুপ্রবেশের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র তাদের পি-৮ পসিডেন নামের একটি গোয়েন্দা বিমানের সাহায্যে মনিটরিং ও সমন্বয় করেছে। জাহাজটি ক্রিট থেকে উড্ডয়ন করার পর থেকে এটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস ডিফেন্ডারকে সবসময় রাশিয়ার তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করেছে। রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন ও যুদ্ধবিমানের গতিবিধি সম্পর্কেও এইচএমএস ডিফেন্ডারকে তথ্য সরবরাহ করেছে গোয়েন্দা বিমানটি।

অন্যদিকে মার্কিন এই গোয়েন্দা বিমানটির গতিবিধি আগে থেকেই অনুসরণ করছিল রাশিয়া। এ কারণে রুশ বাহিনীও মার্কিন গোয়েন্দা বিমানের এসব তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত ছিল। প্রেসিডেন্ট পুতিন দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে জানান যে, তাদের গোয়েন্দা বিমানের তৎপরতা রুশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি তাকে অবহিত করেছেন। মার্কিন গোয়েন্দা বিমানের লেজে যে নম্বর লেখা আছে, সেই নম্বরটিও পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছেন।

ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস ডিফেন্ডারের রাশিয়ার জলসীমায় অনুপ্রবেশকে ন্যাটো পুরোপুরিভাবে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু এখন ন্যাটোই দাবি করছে যে, রাশিয়া অব্যাহতভাবে এই অঞ্চলের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করছে। রাশিয়া বলছে, ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজটির ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের সাথে ন্যাটোর সংহতি প্রকাশ করা। কেননা মস্কোর সাথে ইউক্রেনের বিরোধ চলছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাটোর এই তৎপরতা ইউক্রেনের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। এখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের সামরিক ব্যবস্থা নিতে রাশিয়ার অবস্থানকে আরো জোরালো করেছে। বিরোধপূর্ণ ক্রিমিয়া উপদ্বীপের নৌসীমায় ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজের অনুপ্রবেশের পর বিষয়টি বাইডেন-পুতিন শীর্ষ বৈঠকের আগেই পুতিনকে বড় ধরনের সামরিক মহড়া আয়োজনের সুযোগ করে দিয়েছিল। শুধু রাশিয়ান ভূখন্ডেই নয়, বিরোধপূর্ণ ক্রিমিয়াতেও এই মহড়ার আয়োজন করে রুশ বাহিনী।

রাশিয়ার এই মহড়া ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য হুমকি- এ কথা জানিয়ে ন্যাটো মহড়া বন্ধ করার দাবি জানালে প্রেসিডেন্ট পুতিন মহড়া বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে তার সৈন্যদের ঘাঁটিতে ফিরে আসতে বলেন। কিন্তু সৈন্য প্রত্যাহর করা হলেও মহড়া অনুষ্ঠানে সহায়তার জন্য যে সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র নেয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগই সেখানেই রয়ে গেছে।

জো বাইডেনের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের আগে পুতিনের এই সৌজন্য প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যই ছিল বল বাইডেনের কোর্টে ঠেলে দেয়া। জেনেভায় অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে পুতিন বাইডেনের কাছে এই দাবি জানান যে, ইউক্রেন ইস্যুটি কোন বৈরিতামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে মিনস্ক ২ প্রটোকল অনুসারে সমাধান করতে হবে।

বাইডেন-পুতিন শীর্ষ বৈঠকের পর অবশ্য কোন পক্ষই নতুন করে আর কোন ধরনের উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। বাইডেন এইচএমএস ডিফেন্ডারের ক্রিমিয়ার বিরোধপূর্ণ জলসীমায় প্রবেশের অনুমতি কেন দিয়েছিলেন তা এখনো জানা যায়নি। অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কেন তার দেশের নৌবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ রণতরী হারানোর ঝুকি নিয়েছিলেন সেটাও স্পষ্ট নয়। কেননা এইচএমএস ডিফেন্ডারের রাশিয়ার দাবি করা জলসীমায় অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে ব্রিটেন বা ন্যাটোভূক্ত অন্য দেশের কি লাভ হতো সেটাও এখনো অজানাই রয়ে গেছে। তবে রাশিয়া এটাকে পশ্চিমা বিশে^র দ্বৈত নীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই বিবেচনা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে কৃষ্ণসাগরে ‘সী ব্রিজ ২০২১’ নামে একটি বড়ো ধরনের সামরিক মহড়া দিচ্ছে। মার্কিন নৌবাহিনীর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সামরিক মহড়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো এই মহড়ায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশ অংশ নিচ্ছে। এতে বিশে^র ৬টি মহাদেশের ৩২টি দেশের ৫ হাজার সৈন্য, ৩২টি জাহাজ, ৪০টি যুদ্ধ বিমান, ১৮টি স্পেশাল অপারেশন ও ডাইভ টিম অংশ নেবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন যৌথভাবে এই বৃহৎ মহড়ার আয়োজন করেছে। এই মহড়ার মাধ্যমে রাশিয়াকে সুস্পষ্টভাবে এই বার্তাই দেয়া হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইউক্রেনের নিরাপত্তা বলয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ন্যাটোর সদস্য হিসেবে ইউক্রেনের সাথে ন্যাটের ‘অংশিদারিত্ব’ও একই অর্থ বহন করে।

ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর এই হুমকিকে মস্কো কিভাবে দেখছে? প্রেসিডেন্ট পুতিন তার দেশের দক্ষিনাঞ্চলীয় প্রতিবেশি দেশ ইউক্রেনকে নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে খুবই স্পর্শকাতর ইস্যু ও রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য একটি রেড লাইন হিসেবে বিবেচনা করছেন।

ইউক্রেন এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সে সময় ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ছিল ইউক্রেনের সাথেই একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রজাতন্ত্র। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ক্রিমিয়া হয় ইউক্রেনেরই স্বায়ত্বশাসিত একটি অঞ্চল।

রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল তার মাধ্যইে দেশটি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ফিরে পেয়েছিল। এই চুক্তিতে এটাও বলা হয়েছিল যে, ক্রিমিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বন্দর সেভাস্তিপোল উভয় দেশই ব্যবহার করবে। কেননা রাশিয়ার দক্ষিনাঞ্চলীয় নৌবহরের সদও দফতর এই বন্দরেই। এবং ইউক্রেনের ছোট নৌবাহিনীও এই বন্দরেই অবস্থান করে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানকোভিচের সাথে পশ্চিমা বিশে^র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাশিয়া মেনে নিতে পারেনি। ফলে ২০১৪ সালে রাশিয়ার ইন্ধনে ইউক্রেনে এক গণআন্দোলনে প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও ক্রিমিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। সেখানের সেভাস্তিপোল বন্দরে থাকা ইউক্রেনের নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ, সব অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রাশিয়া আটক করে। পরে অবশ্য কয়েকটি জাহাজ ছেড়ে দেয় রাশিয়া।

পরে ক্রিমিয়ায় অনুষ্ঠিত কথিত এক গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত করে নেন। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে ক্রিমিয়া এখনো ইউক্রেনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করেই বসে থাকেনি। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি প্রদেশে বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে এলাকাগুলো ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করারও উদ্যোগ নেন।

এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইউক্রেন সরকার ক্রিমিয়ায় বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। উত্তর ক্রিমিয়া ক্যানেল দিয়ে ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ইউক্রেন সেই ক্যানেলে দুটি বাঁধ নির্মান করে ক্রিমিয়ায় পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে ক্রিমিয়ায় কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাশিয়া ক্রিমিয়ায় কয়েকটি জলাধার নির্মান করেছে।

বিশ্লষকরা মনে করছেন, ক্রিমিয়ায় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে রাশিয়া ইউক্রেনের নির্মিত বাঁধ দুটো দখল করতে পারে। এমনকি ইউঝোনোক্রইনস্ক পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও দখল করে নিতে পারে। ফলে এ দুটি ইস্যু নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তখন ন্যাটো চুপ করে বসে থাকবে না। সংস্থাটি তার সদস্য দেশের সহায়তায় অবশ্যই এগিয়ে আসবে। এতে রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

ধারণা করা হয়েছিল যে, জেনেভায় বাইডেন-পুতিন শীর্ষ বৈঠকে ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া ইস্যু নিয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতিই হয়েছে। এ পরিস্থিতি যুদ্ধের আশঙ্কাকেই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।