গোবি মরুভূমিতে চীনের পরমাণু অস্ত্রের গোপন মজুদ


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৭ জুলাই ২০২১, ১৪:১৩

চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় গানজু প্রদেশের গোবি মরুভূমিতে বিশাল পরমাণু অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে বেইজিং। এখানে অন্তত ১১৯টি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ করা হয়েছে। চীনের নতুন ধরনের পরমাণু অস্ত্র এখানে রাখা হচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা অতিসম্প্রতি সাটেলাইটের মাধ্যমে এই গোপন স্থাপনার সন্ধান পেয়েছেন। ৭০০ বর্গমাইলের এই স্থাপনা দেখে বিস্মিত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা।

অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার বড় করছে চীন। ক্যালিফোার্নিয়া-ভিত্তিক একটি বাণিজ্যিক গ্রুপের উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, উত্তর পশ্চামাঞ্চলীয় শহর ইউমানের কাছে গোবি মরুভূমিতে সিলো তৈরি করা হচ্ছে। জেমস মার্টিন সেন্টার ফর ননপ্রোলিফারেশন স্টাডিজ বলছে, ১১৯টি সাইটে পারমাণবিক ব্যালাস্টিক মিসাইল তৈরি রয়েছে। এগুলো যে কোনো সময়ই ব্যবহার করতে পারে চীন।

ক্যালিফোর্নিয়ার দ্য মিডলবুরি ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশাল স্টাডিসের চীনের পরমাণু কর্মসূচি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জেফ্রে লিউইস প্রথমে এ তথ্য সামনে আনেন। স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যায়, গোবি মরুভূমিতে গোলাকার মাটি খুড়ে দীর্ঘ পরীখা বানানো হয়েছে। সেখানে কন্ট্রোল সেন্টারের উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। লিউইস বলেছেন, এই নকশা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা কিসের জন্য তৈরি করা হয়েছে। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।

চীনের এই পরমাণু অস্ত্র তৈরির খবরে যুক্তরাষ্ট্র যে নড়েচড়ে বসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অস্ত্রের প্রতিযোগিতাও হয়তো আরও বাড়বে। আমেরিকা তার পরমাণু অস্ত্রের সম্ভার আরও আধুনিক করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন থেকেই কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনায় চীনকেও রাখতে চাচ্ছে। এতোদিন এ আলোচনা ছিল শুধু রাশিয়ার সঙ্গে। চীন ওই আলোচনায় রাজি হয়নি এই যুক্তি দেখিয়ে তার পরমাণু অস্ত্রের মজুদ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার তুলনায় অনেক কম। তবে এই আলোচনার বাইরে থাকার মাধ্যমে চীন তার অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়ে তুলছে।

সমরাস্ত্র বিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক স্টকহোম ইন্টারন্যাশাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসেবে, চীনের কাছে রয়েছে ৩৫০টির মত পরমাণু অস্ত্র। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে ৫৫৫০টি এবং রাশিয়ার হাতে ৬২৫৫টি। চীনের ২০১৯ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিরক্ষা নীতিতে বলা হয়েছে, তারা পরমাণু সক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখবে। কোনো দেশের বিরুদ্ধে প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার অঙ্গীকার করেছে চীন। এছাড়া পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী নয় এমন কোনো দেশের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না বলে দেশটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

চীনের এই পরমাণু অস্ত্রের সম্ভার অপ্রত্যাশিত ছিলো না বলে গবেষকরা মনে করেন। তবে এর গতি ও ব্যাপ্তি দেখে তারা বিস্মিত হয়েছেন। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের কমান্ডার অ্যাডমিরাল চার্লস এ রিচার্ড কংগ্রেসের কমিটিতে গোবি মরুভূমিতে চীনের এই পরমাণু অস্ত্রের সম্ভারের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চীন তার পরমাণু সিলো ব্যাপকমাত্রায় বাড়িয়ে চলেছে।

চীনের এসব পরমাণু অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রেও আঘাত হানতে সক্ষম। গোবির ওই সাইটটি ৭০০ বর্গমাইল আয়তনের। সেখানে ভূগর্ভস্থ বাংকার ও উৎক্ষেপণ কেন্দ্র আছে।

চীনের সামরিক শক্তি নিয়ে সর্বশেষ গত শরতে প্রকাশিত পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের কাছে ব্যবহারের উপযোগী পরমাণু অস্ত্র আছে ২০০ এর নীচে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ আছে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। তবে জল, স্থল ও আকাশ থেকে ছোড়ার উপযোগী কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র বানাতে চাইছে চীন। পেন্টাগনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন শুধু হামলা ঠেকাতে বা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র তৈরি করছে না। এ ধরনের অঙ্গীকার থেকে চীন সরে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার ওই থিঙ্কট্যাঙ্কের গবেষণায় বলা হয়েছে, গোবি মরুভূমিতে চীনের এই পরমাণু অস্ত্রের সম্ভার নির্মাণ শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। এখানে ডিএফ-৪১ নামের আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে চীনের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ওই অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। এই পরমাণু অস্ত্রটি ভ্রাম্যমাণ উৎক্ষেপন কেন্দ্র থেকে ছোড়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

পেন্টাগন বলেছে, ভূগর্ভস্থ সিলোর কিছু কেন্দ্র থেকে এ ধরনের পরমাণু অস্ত্র নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করছে চীন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে গোবি মরুভূমির ওই কেন্দ্রের নির্মাণকাজের গতি বেড়েছে বলে গবেষক লিউইস জানিয়েছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে দ্য ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া থেকে ৬০০ মাইলে পূবে জিলান্তাইয়ের কাছে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছে পরমাণু সিলো সম্প্রসারণ করছে। গোবির এই পরমাণু কেন্দ্র তৈরির মানে এই নয় যে চীন সেখানেই নতুন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র রাখবে। বরং এটি পরমাণু অস্ত্র বিভিন্ন স্থানে রাখার কৌশল যাতে শত্রুপক্ষ একযোগে হামলা চালিয়ে সব পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করতে না পারে। শীতল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এই কৌশল অবলম্বন করতো।

চীনের এই উদ্যোগের পর যুক্তরাষ্ট্রের আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পুনঃস্থাপন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

গোবি মরুভূমিতে চীনের এই পরমাণু অস্ত্রের খবরে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস উত্তেজনা প্রশমনের আলোচনায় চীনকে বসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন ও অন্যান্য পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যে, চীনের পরমাণু অস্ত্রাগার দ্রুতই সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগে যা কল্পনা করা হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি পরমাণু অস্ত্র বাড়াচ্ছে তারা। এভাবে অস্ত্র বৃদ্ধি উদ্বেগের। এতে বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

কিউবায় রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে নিয়ে শীতলযুদ্ধের সময় তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। তখন রাশিয়ার কাছে ৩০০ থেকে ৫০০ পরমাণু অস্ত্র ছিল। সেই দেশটি কিন্তু পরে প্রচুর পরমাণু অস্ত্র বানিয়েছে। চীনও এখন সেই সময়কার রাশিয়ার অবস্থায় আছে। তবে তারা পরমাণু অস্ত্রের সম্ভার বাড়িয়েই চলেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্রের এই প্রতিযোগিতার জন্য দায়ী মূলত যুক্তরাষ্ট্র। উভয় দেশই মনে করে যে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হুমকির কারণেই তারা মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এতো অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে যা দিয়ে তারা এই দুটো দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

গবেষক লিউইস মনে করেন, ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের কারণেই অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়েছে। আগামী দুই দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র আধুনিকায়নের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে পেন্টাগন। এর মধ্যে রয়েছে আকাশ থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং অন্তত নতুন দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি।

গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন চীনের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুকি কমাতে চায়। চীন যাতে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয় সে পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে সাম্প্রতিক সময়ের চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা যেভাবে বাড়ছে তাতে এ ধরনের উদ্যোগ সফল হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকেও সবচেয়ে বড় হুমকি বলে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছে। বেইজিংকে মোকাবিলা করতে ওয়াশিংটন তাই সর্বশক্তি নিয়োগ করার প্রস্তুতি নিয়েছে। এজন্য জি সেভেনভুক্ত দেশগুলোকেও পাশে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কথায় আস্থা রেখে অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে সরে যাবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই সামনের দিনগুলোতে চীন সামরিক প্রযুক্তিতে আরও বেশি বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি মোকাবিলা করতে চাইবে বলেই মনে করা হচ্ছে।