রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ১৯৯৯ সাল থেকে কখনও প্রেসিডেন্ট কখনও প্রধানমন্ত্রী হিসেব ক্ষমতায় আছেন। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি একজন নিকৃষ্ট স্বৈরাচার হিসাবে পরিচিত হলেও রাশিয়াকে তিনি পরাশক্তি হিসাবে আবার দাড় করিয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া আবার ন্যাটো জোটকে দুই দশকের মধ্যে চ্যালেঞ্জ জানাবে এমনটা কেউ ধারনা করতে পারেনি। কিন্তু এখন রাশিয়া সম্প্রসারনবাদী নীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানার মধ্যে ন্যাটো যাতে তৎপর হতে না পারে সে জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব খাটাচ্ছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াকে আর্ন্তজাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে হাজির করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুতিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিক পদত্যাগ করলে পুতিন চলে আসেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে।
তিনি যখন মস্কোর ক্ষমতায় তখন উত্তর ককেশাসে রুশ ফেডারেশনের সৈন্যরা জড়িয়ে পড়েছে চেচেনদের সাথে যুদ্ধে । সেই যুদ্ধে বেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল রুশরা। কিন্তু ঠান্ডা মাথার প্রেসিডেন্ট ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। একের পর এক ককেশাস অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করেছেন। কেজিবির সাবেক গোয়েন্দা সফল ভাবে চেচেনদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেন। মস্কোপন্থী অনুগত গোষ্টী তৈরি করেন। এক দশকের যুদ্ধের পর চেচেন স্বাধীনতাকামীরা পরাজয় বরন করে। ২০০৯ সালের এপ্রিলে চেচেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এরপর রাশিয়া নজর দেয় ককেশাসের আরেক প্রান্তে। জর্জিয়া থেকে আবখাজিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। রাশিয়া নানা ভাবে সহায়তা দিতে থাকে আবখাজ বিদ্রোহীদের। ২০০৮ সালে রুশ সৈন্যরা প্রবেশ করে আবখাজিয়ায়। এমনকি আবখাজিয়া ও দক্ষিন ওসেটিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া। শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চল রাশিয়ান ফেডারেশনের স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে পরিনত হয়। পশ্চিমা বিশ্ব জর্জিয়াকে সমর্থন দিলেও রুশ সেনাদের ঠেকানোর কোনো উদ্যগ গ্রহন করেনি। কারন তা হতো রাশিয়ার সাথে পুরোমাত্রায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। তখন যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান নিয়ে। ফলে রাশিয়া সফলভাবে আবখাজিয়া ও দক্ষিন ওশেটিয়াকে জর্জিয়া থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের নিরাপত্তা কৌশল সাজিয়েছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ওপর রাশিয়ার প্রভাবকে কেন্দ্র করে। ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশপন্থী সরকারের পতন ঘটে। পশ্চিমা পন্থী সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর পুতিন আর কালক্ষেপন করেননি। মার্চে ক্রিমিয়ায় সৈন্য পাঠায় রাশিয়া। আবখাজিয়ার মতো ক্রিমিয়াতে রুশপন্থী একটি মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে ক্রেমলিন। এই উপদ্বীপে ছিলো ইউক্রেনের নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার। এর কিছু দূরে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় নৌঘাটি সেভিস্তোপল। ফলে কৌশলগত দিক দিয়ে ক্রিমিয়া রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। প্রথম দফায় ক্রিমিয়ায় ইউক্রেন নৌবাহিনীর সদর দপ্তর দখল করে নেয় রুশপন্থী মিলিশিয়ারা। এ সময় ইউক্রেনের নৌবাহিনীর প্রধানকে আটক করে রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস বা এফএসবি।
রুশপন্থীরা ক্রিমিয়া দখলের পর ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার এক চুক্তিকে বৈধতা দেয় রাশিয়ার সাংবিধানিক আদালত। এরপর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশনে ঘোষণা দেন কোনো রক্তপাত ছাড়াই ক্রিমিয়াকে রাশিয়ায় সংযুক্ত করা হয়েছে। ক্রিমিয়া দখলের পর সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ন্যটো সদস্যপদ লাভের জন্য জোর চেষ্টা শুরু করে ইউক্রেন। এতে আরো ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে মস্কো। স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সাবেক সোভিযেত ইউনিয়নের আর কোনো দেশ ন্যটোর সদস্য হতে পারবে না।
ইউক্রেনকে আরো দূর্বল করার জন্য ডনবাস, ডনেটস্ক, লুহানস্ক অঞ্চলকে ইউক্রেন থেকে আলাদা করার উদ্যেগ নেয় মস্কো। দক্ষিন এবং পূর্ব ইউরোপের এসব অঞ্চলে রুশভাষী রাশিয়ান জাতিগত মানুষের বসবাস। রাশিয়ানপন্থীরা এসব অঞ্চলকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করতে চায়। রাশিয়া এসব অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিচ্ছে। ডনেটস্ক এবং লুহানস্ক রাশিয়ানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে রয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডনেটস্ক এবং লুহানস্ককে আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে। তারা এর নাম দিয়েছে ডনেটস্ক পিপলস রিপাবলিক এবং লূহানস্ক পিপলস রিপাবলিক। ২০১৪ সালের মে মাসের এক বিতর্কিত রেফারেন্ডামের মাধ্যমে এ দুটি রিপাবলিক গঠন করা হয়। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পুরোপুরি সহায়তা দিচ্ছে মস্কো। এদের ছত্রছায়ায় ইউক্রেনে অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছে মস্কো।
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার লক্ষ্য বেশ সুদূর প্রসারী। লুহানস্ক বা ডনেটস্ক দখল নয় পুরো ইউক্রেন নিয়ন্ত্রনে রাখতে চায় রাশিয়া। এরমধ্যদিয়ে ন্যাটোভুক্ত সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোকে বিশেষ বার্তা দিতে চায় মস্কো। এরমধ্যে রয়েছে লিথুনিয়া, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়ার মতো দেশগুলো।
ইউক্রেন অভিযানকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার মিত্র বেলারুশে সৈন্য ও ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করেছে রাশিয়া। ফলে বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলো এখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। ইউক্রেনের উত্তরের বিশাল সীমান্ত রয়েছে বেলারুশের সাথে। অপর দিকে পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, লাটভিয়া এবং লিথুনিয়ারও অবস্থান বেলারুশ সীমান্তে। বেলারুশ ছাড়া পূর্ব ইউরোপের সমস্ত দেশ রাশিয়ান সম্ভাব্য আগ্রাসন নিয়ে শঙ্কিত। ইউক্রেনের পর মস্কোর নজর যে এসব দেশের দিকে আসবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
প্রেসিডেন্ট পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোকে দূর্বল করতে একটি মাত্র কৌশল প্রয়োগ করেছেন। যে দেশ রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা সৃষ্টি করে দেশটির একটি অংশ বিচ্ছিন্ন করেছেন। এরপর সেই অংশকে রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত করেছেন। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন হওয়া দেশগুলো ভূখন্ড হারাতে বসেছে।
শুধুমাত্র পূর্ব ইউরোপ নয় মধ্যএশিয়ার দেশগুলো যাতে রাশিয়ার রাডারের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য গঠন করা হয়েছে সামরিক জোট। কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিট্রি অর্গানাইজেশনের আওতায় এসব সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে অপর দেশ সহযোগিতা করবে। জোটভুক্ত দেশগুলো অন্য দেশের সাথে সামরিক চুক্তি করতে পারবে না । এই জোটে রয়েছে কাজকস্তান, রাশিয়া, আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান, তাজাকস্তান ও কিরঘিজস্তান। কিছুদিন আগে এই চুক্তির আওতায় তাজিকস্তানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দমনে রাশিয়া সৈন্য পাঠায় মস্কো।
প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোর সীমানাকে রেডলাইন ঘোষণা করেছে। জর্জিয়া থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত রাশিয়া যেভাবে তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যটো জোটের ওপর আস্থা হারাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন হওয়া দেশগুলো আশা করেছিলো ন্যাটোর নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমে এসব দেশ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এসব দেশ এখন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে।
ন্যাটো জোটের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আশ্বস্ত করা হয়েছে এসব দেশের নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। পূর্ব ইউরোপের লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও বুলগেরিয়ায় মতো দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ডেনমার্কের সেনা পাঠানোর কথাও জানিয়েছে ন্যাটো। ইতোমধ্যে যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধ বিমান মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে এই সামরিক জোট। এর ফলে আগামি দিনে রাশিয়ার সাথে এসব দেশের দূরত্ব আরো বাড়বে।
বড় ধরনের প্রতিরোধ ছাড়া যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান সফল হয় তার প্রভাব হবে সুদুর প্রসারী। ন্যটোর ওপর এসব দেশের আস্থা আরো কমে যাবে। এরপর হয়তো প্রেসিডেন্ট পুতিন পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশগুলো নিয়ে নতুন পরিকল্পনা গ্রহন করবেন। পূর্ব সীমান্তে ন্যাটোর তৎপরতা কমানো হবে রাশিয়ার প্রধান টার্গেট।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন চালিয়েছে। তখন পুতিন নীরবে রাশিয়ার শক্তি বাড়িয়েছেন। নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টা করেছেন কৌশলগত এলাকাগুলোতে।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সামর্থ্যর অভাব, ইউরোপে বিভক্তির সুযোগ নিয়ে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন পুতিন। ধারনা করা হচ্ছে তিনি ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন । ইতোমধ্যে তার ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে আইন সংশোধন করা হয়েছে। তখন তার বয়স হবে ৮৩ বছর। হয়তো এরমধ্যে তিনি রাশিয়াকে অপ্রতিদ্বন্দ্বি শক্তি হিসাবে দাড় করাতে সফল হবেন। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা আরো বেশি আস্থা হারাবেন।