বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশ রাশিয়া। রাশিয়ার সামনে কেবল একটি দেশ আছে সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বে প্রতিবছর যত অস্ত্র কেনাবেচা হয় তার ২০ শতাংশই সরবরাহ করে রাশিয়া। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে মস্কো বিশ্বের মোট ৪৫টি দেশে ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে। কারা কিনেছে রাশিয়ার এই অস্ত্র? রাশিয়ার সমরাস্ত্র তৈরি ও বিক্রিতে কত অর্থ ব্যয় হয়? রাশিয়ার কোন অস্ত্রগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি?
রাশিয়া যত অস্ত্র বিশ্বজুড়ে রফতানি করছে তার ৯০ শতাংশ অস্ত্রই যায় মাত্র ১০টি দেশে। রাশিয়ার অস্ত্রের সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা হলো ভারত। গত ৫ বছরে রাশিয়ার অস্ত্রের ২৩ শতাংশ কিনেছে ভারত। এই ৫ বছরে ভারত রাশিয়ার অস্ত্র কেনা বাবদ ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করেছে।
ভারত বছরে যত অস্ত্র আমদানি করে তার ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার সমরাস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা রাষ্ট্র হলো চীন। বেইজিং গত ৫ বছরে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার জন্য ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। এরপরই আছে আলজেরিয়া। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটি রাশিয়া থেকে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। রাশিয়ার অস্ত্র কেনার তালিকায় এরপর আছে মিসর। রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। পঞ্চম অবস্থানে আছে পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম। দেশটি রাশিয়া থেকে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। স্টকহোম ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা সিপরি এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
রাশিয়া এখন যেসব অস্ত্র রফতানি করছে তার মধ্যে রয়েছে বিমান, ইঞ্জিন, মিসাইল, সশস্ত্র যান ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। রাশিয়ার অস্ত্র রফতানির অর্ধেক অর্থাৎ ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশই হলো যুদ্ধবিমান।
রাশিয়ার সমরাস্ত্র বিক্রির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে চার বছরে সুখোই ও মিগ বিমানসহ নানা ধরনের ৪ ’শটি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে। ১৩টি দেশে এই বিমানগুলো রফতানি করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক বিমানই কিনেছে ভারত।
ভারত হলো পৃথিবীর ৬টি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটির হাতে আছে নিউক্লিয়ার শক্তিচালিত সাবমেরিন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সাবমেরিন রাশিয়া থেকে লিজ নিয়ে ভারত পরিচালনা করছে।
রাশিয়ার এই সমরাস্ত্রের বেশিরভাগই সেভিয়েত যুগের অস্ত্রের উন্নত সংস্করণ। পাশাপাশি, রাশিয়া তাদের এডভান্সড সিস্টেমগুলো অনেক উন্নত করেছে। এ ধরনের একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হচ্ছে এস ফোর হান্ড্রেড সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। উন্নত এই ডিফেন্স সিস্টেমটি রাশিয়া ইতোমধ্যেই চীন, ভারত, সিরিয়া এবং তুরস্কের কাছে বিক্রি করেছে। অন্য আরো বেশ কিছু দেশও এরই মধ্যে রাশিয়ার দূরপাল্লার কিছু মোবাইল সিস্টেম কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দূরপাল্লার প্রতিটি মোবাইল সিস্টেমের দাম পড়বে ৪’শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রাশিয়ার সবচেয়ে খ্যাতনামা ও জনপ্রিয় অস্ত্র হলো একে-৪৭ বা কালাসনিকভ। সেভিয়েত সেনাবাহিনীর জেনারেল মিখাইল কালাসনিকভ ৪০ এর দশকে প্রথম এই অস্ত্রটি উদ্ভাবন করেন। এই রাইফেলটি দামে বেশ সস্তা, বেশ টেকসই এবং সহজে ব্যবহার যোগ্য।
বিশ্বের প্রায় ১শটি দেশের পদাতিক বাহিনীর সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে এই রাইফেলটি ব্যবহৃত হচ্ছে। একে- ফোর্টি সেভেনের একে শব্দটির মূল নামটি হলো আভটোমাট কালাসনিকভা। রাশিয়ান ভাষায় এই শব্দটি দিয়ে অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় কালাসনিকভকে বোঝানো হয়। যেহেতু ১৯৪৭ সালে এই রাইফেলটি নির্মিত হয় তাই সবমিলিয়ে রাইফেলটির নাম হয়ে যায় একে ফোর্টি সেভেন।
এই মুহুর্তে আনুমানিক ১শ মিলিয়নয়েরও বেশি একে ফোর্টি সেভেন গোটা বিশ্বে কার্যকর রয়েছে। এ কারণে এই রাইফেলটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত এসল্ট রাইফেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে তাদের সেনাবাহিনীর উন্নয়নে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। বিশ্বে সামরিক খাতে এর চেয়ে বেশি অর্থ কোনো দেশ ব্যয় করে না। সিপরির হিসেব মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পরে থাকা ১০টি দেশ সম্মিলিতভাবে সামরিক খাতে যত অর্থ ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। সামরিক খাতে ব্যায়ের দিক দিয়ে রাশিয়া অনেক পিছিয়ে থাকলেও শীর্ষ দেশগুলোর একটি।
সামরিকখাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে চীন আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। এ খাতে চীনের ব্যয় ২৫২ বিলিয়ন ডলার। ভারত ব্যয় করছে ৭৩ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়া ৬২ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য সামরিক খাতে ৫৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
সামরিক খাতে রাশিয়ার ব্যয় বিগত তিন দশকে তাৎপর্যপূর্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে মস্কো সামরিক খাতে ৬২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যা দেশটির মোট জিডিপির ৪ শতাংশ।
রাশিয়ার সমরাস্ত্র শিল্পে ১৩শ’র বেশি কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্টানে এখন ২০ লাখেরও বেশি লোক নিয়মিত কাজ করছে। প্রতিরক্ষা কোম্পানীর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো রোসটেক। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই এই কোম্পানীটি প্রতিষ্ঠা করেন।
সেভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়া একটি ফেডারেশন হিসেবে আবির্ভুত হয়। তখন থেকে রাশিয়ায় নানা পর্যায়ে সংঘাত ও সহিংসতার সূত্রপাত হয়। ১৯৯৪ সালে ক্রেমলিন চেচনিয়ার বিরুদ্ধে একটি সামরিক আগ্রাসন শুরু করে। চেচনিয়া ছিল জর্জিয়ার সীমানার নিকট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট একটি দেশ।
এই আগ্রাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃত্বকে বিপর্যস্ত করা। যদিও ২০ মাসের যুদ্ধের শেষে তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয়। এর তিন বছর পর চেচনিয়াকে পুনরুদ্ধার করার জন্য রাশিয়া দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধ শুরু করে। চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘ গ্রোজনিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর হিসেবে আখ্যায়িত করে।
চেচনিয়ার পর ২০১৪ সালে ইউক্রেনে আক্রমন করে রাশিয়া এবং ক্রিমিয়াকে নিজেদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এক মাস পর, রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্ব ইউক্রেনের দোনেতস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চল দখল করে।
রাশিয়া শুধু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানার মধ্যে নয়, বাইরেও যুদ্ধ পরিচালনা করছে। ২০১৫ সালে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রবেশ করে। রাশিয়া সর্বাত্মকভাবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষাবলম্বন করে। রাশিয়ার ভারী অস্ত্রগুলো সিরিয়ার মাটিতে স্থানান্তর করা হয়। সিরিয়ার এই যুদ্ধের পরিণতিতে কয়েক মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে হয়ে যায়। নিহত হয় কয়েক লাখ মানুষ। এই যুদ্ধ চলতি বছর ১১ তম বর্ষে পদার্পন করলো।
যে কোনো যুদ্ধে নতুন ধরনের সমরাস্ত্রের পরীক্ষাগার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রাশিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও মিসাইলের বড় আকারের পরীক্ষা হয়েছে সিরিয়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারনে মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত সামরিক অবস্থান গড়ে তোলে রাশিয়া। দেশটি নৌ ও বিমান ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর লিবিয়ার যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া। সেখানে সরাসরি সৈন্য না পাঠিয়ে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপকে পাঠানো হয়। লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারের পক্ষে এরা যুদ্ধ করে।
এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখুন :
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ২০১৮ সালে বড়ো আকারের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই দেশটি রাশিয়াকে অনুরোধ জানায় যাতে রাশিয়ার তরফ থেকে সেখানে সামরিক ঠিকাদারদের পাঠানো হয়। তাদের মাধ্যমে স্থানীয় সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সেখানে নানাভাবে রাশিয়ার অস্ত্রের ব্যবহারের কারণে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলেছেন। রাশিয়া অবশ্য বরাবরই এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়ার সামরিক শক্তি সংহত করছে। গত এক দশকে রাশিয়ার সমরাস্ত্র শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এখন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার সমরাস্ত্রের বাজার ছোট করার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্টানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যাতে এসব প্রতিষ্টানের সাথে লেনদেন সীমিত করা যায়। ফলে আগামি দিনে রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হয়।