যে সব ইউক্রেনিয়দের পরিবারের সদস্যরা যুদ্ধে লড়ছে, তাদের অনেকেই সামরিক নেতাদের ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। কারণ তারা অনভিজ্ঞ সেনাদেরকে ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়েছে। অনেক সময় সেনাদেরকে যথাযথ মেডিকেল ও মনস্তাত্বিক পরীক্ষা না করেই তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
কিয়েভের বাসিন্দা ৪৩ বছর বয়সী ভিক্টোরিয়া বিলান রাশচুকের স্বামী ভোলোদিমির একজন নাট্যকর্মী এবং তার যুদ্ধের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। সে এখন সিভিরোডোনেস্ক এলাকায় যুদ্ধ করছে। ভিক্টোরিয়া বলেন, এখন তিনি প্রতিবাদ জানানোর জন্য মাঠে নামতেও প্রস্তুত। গত মাসে তিনি চাঁদা তুলে ফ্রন্টলাইনের সেনাদের জন্য সুরক্ষা হেডফোন পাঠিয়েছেন, যাতে রকেটের বিকট শব্দে তাদের শ্রবণশক্তি নষ্ট না হয়। ভিক্টোরিয়া বলেন, সরকার তাদের সহায়তার জন্য যথেষ্ট তৎপর নয়। এই অবস্থা যত দীর্ঘ হবে, মানুষ ততই ভেঙ্গে পড়বে। এই ব্যাপারে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলেও তিনি কোন জবাব দেননি।
ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন অভিযান শুরু করে, তখন হাজার হাজার ইউক্রেনিয় নাগরিক স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে রাজি হয়েছে, যাদের আগের কোন সামরিক অভিজ্ঞতা নেই। যুদ্ধ প্রচেষ্টা সক্রিয় রাখার জন্য ইউক্রেন সরকারও ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় পুরুষদের দেশ ছাড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে, যাতে প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহার করা যায়। মে মাসে, জেলেন্সকি জানিয়েছিলেন, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীতে নারীসহ সাত লক্ষ সদস্য রয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই জেলেন্সকি নানাভাবে দেশের সেনা এবং সাধারণ নাগরিকদের নৈতিক মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণেরও চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার কামান হামলা বেড়ে গেছে। প্রতি দিন গড়ে একশ থেকে দুইশ ইউক্রেনিয় সেনা মারা যাচ্ছে। আহত হচ্ছে আরও প্রায় পাঁচশ। খোদ ইউক্রেনের কর্মকর্তারাই এ তথ্য জানিয়েছেন। ১৪ জুন এক বক্তৃতায় জেলেন্সকি এই জনবল ক্ষয়কে বেদনাদায়ক হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে ইউক্রেনিয়ানদের টিকে থাকতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার পরও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলে আসছেন যে, সেনাদেরকে সঠিকভাবে দেখভাল করা হচ্ছে। তাদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, খাবার, সরঞ্জাম সরবরাহ ও বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের সময় যত বাড়ছে, ইউক্রেনিয় নাগরিকরা ততই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে ফ্রন্টলাইনের সেনাদের জন্য মৌলিক দরকারি সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কিছু সামরিক পরিবারকে চাঁদা সংগ্রহে বাধ্য করা হয়েছে, যাতে সেই অর্থ দিয়ে মেডিকেল ও সামরিক সরঞ্জামাদি ফ্রন্টলাইনে পাঠানো যায়।
সভিতলানা লুকিয়ানেঙ্কোর স্বামী যুদ্ধের আগে তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতেন। এখন তিনি সিভিরোডোনেস্কের কাছে যুদ্ধ করছেন। সভিতলানার উদ্বেগের কারণ হলো ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দ্রুত নিহত ও আহত সেনাদের শূণ্যস্থান পূরণ করছে না। প্রতি দিনই তার স্বামীর জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সরকারকে জনবল আরও বাড়াতে হবে, আবার তাদেরকে প্রশিক্ষণও দিতে হবে। প্রশিক্ষণের যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই, আর এটা একটা বড় সমস্যা। সে কারণে, আমাদের মৃতের হার অনেক বেশি। সভিতলানা বলেন, তাদের কারণে আমরা এখন ক্ষুব্ধ।
কিছু ফ্রন্টলাইন সেনাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই বলে যে অভিযোগ উঠেছে, জেলেন্সকি তা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ফ্রন্টলাইন থেকে আমি যে রিপোর্ট পাচ্ছি, আর সমাজের ভেতরে যে আলোচনা চলছে, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধ চলমান এলাকাগুলোতে সবাই ঝুঁকির মধ্যে আছে, এবং নিজেদেরকে সুরক্ষার জন্য তাদের কাছে সবকিছুই থাকতে হবে। রাষ্ট্র এই জিনিসগুলো সরবরাহ করছে। কিয়েভের বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী লুইজা ডোর্নারের স্বামী ডোনবাস অঞ্চলে যুদ্ধ করছেন। তিনি বলেছেন, জেলেন্সকি আর সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তাদের কথাবার্তা পুরোটাই অন্তসারশূন্য। স্বামীর সাথে টেলিফোনে কথা বললেই তিনি বুঝতে পারেন যে, তারা কি ধরণের আতঙ্ক আর পরিশ্রান্ত অবস্থার মধ্যে আছে। তিনি বলেন, সরকারের কথাবার্তা আর বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিদিনই সেনাদেরকে উচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবী ইউনিট, টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স ফোর্সের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে আছেন ইগর খোর্ট। তিনি জানিয়েছেন, রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর কিয়েভে তাদের প্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। নতুন সেনাদেরকে মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
ওয়শিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন মেরিন কর্নেল মার্ক ক্যানসিয়ান এই পাঁচদিনের প্রশিক্ষণকে খুবই অপর্যাপ্ত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনিয়ানদেরকে কোন একটা সমাধান বের করতে হবে। এটা একটা ম্যারাথনের মতো, একশ মিটারের স্প্রিন্ট নয়। মার্কিন মেরিনদেরকে কোথাও পাঠানোর আগে তাদের কমপক্ষে ২০ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
যথেষ্ট প্রশিক্ষণ আর প্রস্তুতি ছাড়া ফ্রন্টলাইনে যে সেনাদেরকে পাঠানো হচ্ছে, এর দায় কার - এমন প্রশ্নের জবাব খোর্ট বলেন, তারা নিজেরাই এখানে যোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, জন এফ কেনেডি তার প্রথম বক্তৃতায় বলেছিলেন, এই প্রশ্ন করো না যে, দেশ তোমার জন্য কি করবে, বরং নিজেকে প্রশ্ন করো দেশের জন্য তুমি কি করতে পারবে। ইউক্রেনিয়রাও দেশের জন্য এখন অসম্ভবটাই করছে।
সরকারের যুদ্ধ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জনগণের সমর্থনে যে ভাটা পড়েছে, সেটা এই মুহূর্তে জেলেন্সকির জন্য একটা রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ক্যানসিয়ান মনে করেন, ক্ষমতায় পরিবর্তন আসলে যুদ্ধের গতিও পাল্টে যেতে পারে।
তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদে এটা আসলে একটা রাজনৈতিক সমস্যা। এখানে কিছু না করা হলে এটা সামরিক সমস্যায় রূপ নেবে। এখন দেখার বিষয় হলো ইউনিটগুলো ভেঙ্গে পড়ছে কি না। কোন ইউনিট যুদ্ধ করতে অস্বীকার করছে কি না। অথবা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে কেউ চলে যাচ্ছে কি না।
সরকারের ব্যাপারে হতাশা ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। সেখানে লাভিভ শহরের মতো তুলনামূলক নিরাপদ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার জন্য অনেকে আগ্রহী হয়েছিল। কিছু নারী জানিয়েছেন, তাদের স্বামীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এই শর্তে যোগ দিয়েছিল যে, তারা নিজেদের এলাকার রক্ষার জন্য সাহায্য করবে। কিন্তু তাদেরকে এখন ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
৫২ বছর বয়সী ওলেনা ঝাবিয়াক শেরেমেত বলেন, তার স্বামী যুদ্ধের শুরুর দিকে বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। সে লাভিভ এলাকার চেকপয়েন্টগুলোতে কাজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এপ্রিলের শুরুর দিকে, তাকে ব্যাগ গুছিয়ে পূর্বাঞ্চলের দিকে যেতে বলা হয়। যদি সে যেতে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে পরিত্যাগকারী হিসেবে ঘোষণা দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এর পর থেকে স্বামীকে আর দেখেননি ওলেনা।
যাদেরকে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়েছে তাদের অনেককে এটুকুও শেখানো হয়নি যে, কিভাবে গুলি করতে হয়। হঠাৎ করে তাকে একেবারে গুলির বৃষ্টির মধ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
ওলেনাসহ অন্য নারীরা সরকার ও সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, কেন তাদের প্রিয়জনদেরকে তাদের নিজের জেলা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু তারা সরকারের কাছ থেকে কোন জবাব পাননি।
মৃতের সংখ্যা যে বেশি হচ্ছে, এতে মোটেই অবাক নন ওলেনা। তিনি বলেন, তারা শত্রুদের কোনভাবেই ঠেকাতে পারবে না, কারণ তাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। আর এর স্বাভাবিক ফল হলো জানমালের ব্যাপক ক্ষতি।