তাইওয়ান ৩৬ হাজার ১৯৩ বর্গকিলোমিটারের একটি দ্বীপ। তাইওয়ানের রয়েছে নিজস্ব সংবিধান ও সরকার ব্যবস্থা। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসন চললেও তাইওয়ানে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠিত হয়। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হয়। দেশটির ৩ লাখ সদস্যের একটি সেনাবাহিনীও রয়েছে। তথাপি ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা দ্বন্দ্বের কারণে রাষ্ট্র হিসেবে তাইওয়ানের মর্যাদা কী- তা স্পষ্ট নয়। অন্যভাবে বলা যায়- সব উপাদান থাকার পরেও তাইওয়ান স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পায়নি।
তাইওয়ান আর চীনের এই বিরোধীতার ইতিহাস বহু পুরনো। ১৮৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধের পর তাইওয়ান যায় জাপানের দখলে। আর দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপান আত্মসমার্পন করার পর ভূখ-টির দায়িত্ব নেয় চীন।
১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবে চিয়াং কাই-শেকের সরকারকে উৎখাতন করে চীনে ক্ষমতা দখল করে মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি। প্রাণ বাঁচাতেচিয়াং কাই-শেকের সেনাবাহিনী ও সরকারের শীর্ষ নেতারা তাইওয়ানে আশ্রয় নেন। তারা তাইওয়ান থেকেই চীনের বৈধ সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাইওয়ানের সরকারকেই চীনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে থাকে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদেও চীনের প্রতিনিধিত্ব করে তাইওয়ানে পালিয়ে যাওয়া সেই সরকার।
কিন্তু বেইজিংয়ের কমিউনিস্ট শাসকরা তাদের দক্ষ কূটনীতি দিয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয়। ধীরে ধীরে অনেক দেশই তাইওয়ানের বদলে বেইজিংয়ের সরকারকেই স্বীকৃতি দিতে শুরু করে। বিশ^ব্যাপী চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব এতে ভুমিকা রাখে। ১৯৭১ সালে তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষাকারী দেশের সংখ্যা কমতে কমতে ১৫তে নেমে আসে। এরপর আরো কয়েকটি দেশ তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, হাইতি, প্যারাগুয়ে’র মতো দেশগুলোর কোনটিই আবার বিশ^রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য নয়। যে কারণে রাষ্ট্র হিসেবে সব উপাদান থাকার পরও তাইওয়ানের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নেই। অন্য দিকে চীন মিশে যায় বিশ্ব রাজনীতিতে।
চীন-তাইওয়ান বিরোধে সর্বশেষ উত্তেজনা ছড়িয়েছে ন্যান্সি পেলোসির সফর।এশিয়া সফরের শুরু থেকে বিষয়টিতে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সফরের শিডিউল ঘোষণার সময় তাতে তাইওয়ানের নাম ছিলো না। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে ওয়াশিংটন ও তাইপের কর্মকর্তারা বিষয়টি প্রকাশ করেন। এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছর পর শীর্ষস্থানীয় কোন মার্কিন রাজনীতিক পা রাখেন তাইওয়ানে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ^ রাজনীতি গত ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তাল। এমন একটি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন এত বড় পদক্ষেপ নিলো তা নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ হচ্ছে। চীনে আগে থেকেই এই সফর নিয়ে সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। তারপরও বিশ^ রাজনীতির এই টালামাটাল সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন স্পিকারকে তাইওয়ান পাঠালো তার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কারণটি সম্ভবত চীনকে যুদ্ধে টেনে আনা।
রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী এখন দুটি দেশ। রাশিয়া ও চীন। রাশিয়াকে ইতোমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধে টেনে আনা হয়েছে। মস্কোর কর্মকর্তারা বারবারই বলছেন, ওয়াশিংটনের উস্কানির কারণেই তারা ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছেন। ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করা এবং দেশটিতে পশ্চিমা সমরাস্ত্র মোতায়েন করার মার্কিন পরিকল্পনাই ছিলো রাশিয়ার জন্য প্রধান উদ্বেগের কারণ। এবং সেটা ঠেকাতেই তারা যুদ্ধে নেমেছে।
যুদ্ধে রাশিয়ার বিপক্ষে ইউক্রেনকে অর্থ, সমরাস্ত্র ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। লড়াইটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখ- থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে। ফলে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কোন প্রভাব দেশটিতে নেই। কিন্তু রাশিয়াকে এই যুদ্ধে লড়তে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষেও এবং সেটা কয়েকটি ফ্রন্টে। ইউক্রেনের মাঠে তাদের যেমন মার্কিন অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে, আবার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবেও লড়তে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বিপক্ষে। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক অবরোধের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে না মস্কো। যা তাদের আরো দুর্বল করে দেবে। আর রাশিয়া দুর্বল হওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা ভোগ করতে যুক্তরাষ্ট্র।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনকেও আরেকটি যুদ্ধে টেনে আনা যায়- সেটিও হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক। কারণ তাইওয়ান নিয়ে যদি যুদ্ধ বাধে সেটি হবে তাইওয়ানের ভূখ-ে। এই স্থানটিও যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখ-ের থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে। তাদের ভূখ-ে না পড়বে মিসাইল, না আসবে উদ্বাস্তুর ঢল। কিন্তু তাইওয়ানকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে ওয়াশিংটন ঠিকই বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে পরোক্ষ লড়াই করবে।
তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালালে তাকে উপলক্ষ্য করে চীনের ওপর একগাদা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার রাস্তাও খুৃজে পাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। যুদ্ধের ধকল সামলাতে না পারলে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে চীন। ক্রমেই অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো চীনকে শায়েস্তা করার এই রাস্তাটিই হয়তো ওয়াশিংটন খুজছে।
চীন যদি আমেরিকার এই পদক্ষেপকে হজম করে কিংবা শুধু হুমকি দিয়েই শেষ করে তাহলে ধরে নিতে হবে- তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয়ার রাস্তা পেয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো তারা সেই পদক্ষেপ নিয়েও ফেলবে। সেটা হলে একদিকে চীনকে যেমন তার ভূখ- হারাতে হবে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে পেয়ে যাবে আরেকটি সামরিক ঘঁটি।
মার্কিন সহযোগিতায় তাইওয়ান স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে সবার আগে তারা দ্বীপ দেশটিতে এসে সামরিক ঘাঁটি গাড়বে। তাহলে ওয়াশিংটন চীনের উঠানে সমরাস্ত্র মোতায়েনের সুযোগও পাবে। এর আগে চীনের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় সেনা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের সাথেও তারা সম্পর্ক জোরদার করছে চীনকে মোকাবেলার জন্য। এরপর তাইওয়ানে মার্কিন সেনারা পা রাখলে চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার বন্দোবস্ত হতে আর কিছুই বাকি থাকবে না।এছাড়া এশিয়া প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রভাব বেড়ে যাবে বহুগুন। কাজেই চীন এত কিছু হতে দেবে কিনা সেই প্রশ্ন আসবে।
তাইওয়ান নিয়ে চীন - যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনায় রাশিয়ার উদাহরণ বার বার সামনে আসছে। রাশিয়া যে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালিয়েছে তার মূলে রয়েছে নিজের সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র যাতে ইউক্রেনে সমরাস্ত্র মজুদ করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে চান ভøাদিমির পুতিন। তার হাতে অন্য কোন বিকল্পও ছিলো না। কারণ রাশিয়াকেও চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার আয়োজন করছে যুক্তরাষ্ট্র। আর পুতিন সেটা হতে দিতে চান না বলেই যুদ্ধে নেমেছেন। বিশ^ ইতিহাসে এমন ঘটনা আরো আছে।
কিউবার মিসাইল সঙ্কট নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। ১৯৬২ সালে গোপনে কমিউনিস্ট শাসনের দেশ কিউবায় মিসাইল স্থাপন করতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে টার্গেটে রাখাই ছিলো এর উদ্দেশ্য। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের কাছে বিষয়টি ধরা পড়লে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কিউবার সমুদ্রসীমায় কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ পাঠায় ওয়াশিংটন। একই সময় ওই অঞ্চলে ছিলো একটি সোভিয়েত সাবমেরিন। ওই সময় সরাসরি যুদ্ধের খুব কাছে চলে গিয়েছিলো দুই পরশক্তি। এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তার ভূখ-ের কাছে মিসাইল মোতায়েন করতে দেয়নি রাশিয়াকে।
কাজেই চীনও যে তাইওয়ান সঙ্কটে যে কোন মূল্যে জিততে চেষ্টা করবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে চীন কি সামরিক পদক্ষেপ অর্থাৎ যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে? নাকি পাল্টা কোন উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এই ইস্যুতে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে।
ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের দিন বিবিসির এক ধারাভাষ্যে বলা হয়েছে, চীন হয়তো এখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সরাসরি রাশিয়াকে সমর্থন দিতে পারে। ওয়াশিংটনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সেটাই হতে পারে তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ কূটনৈতিক পন্থা। এর পাশাপাশি তাইওয়ানে আশপাশে বাড়তে পারে সামরিক উপস্থিতি।