রাশিয়ার মহড়ায় ভারতের অংশ নেয়ার নেপথ্যে প্রথম কারণ হলো রাশিয়ার সাথে ভারতের সামরিক খাতে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এই সম্পর্কের সূচনা হয় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আত্ম প্রকাশের পরপরই। সেই থেকে দুদেশের সম্পর্ক শুধু ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। ভারত রাশিয়ার সাথে এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল সিস্টেম পাওয়ার জন্যেও চুক্তি করেছে। এছাড়া ভারত বর্তমানে রাশিয়ার যে সব সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে, সেগুলোরও স্পেয়ার পার্টসও প্রয়োজন।
বর্তমানে ভারত রাশিয়ার যে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো এসইউ থার্টি যুদ্ধবিমান, বিএম থাটি স্মার্চ হেভি মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার এবং টি-নাইনটি ট্যাংক। অন্য কোনো দেশ সমরাস্ত্রের পাশাপাশি সমর প্রযুক্তি দিতে রাজি না হলেও রাশিয়া বরাবরই ভারতকে এই সুবিধা দিয়ে আসছে। ভারত ও রাশিয়া মিলে ব্রাহমস মিসাইল তৈরিতেও কাজ করছে। ব্রাহমস নামের এই মিসাইলটির নামকরণ করা হয়েছে ভারতের ব্রক্ষ্মপুত্র এবং রাশিয়ার মসকোভা নদীর নামে। ভারত নিজেদের আভ্যন্তরীন সামরিক খাতকে শক্তিশালী করার জন্য যে মেইক-ইন ইন্ডিয়া কৌশল বাস্তবায়ন করছে সেক্ষেত্রেও এই ব্রাহমস মিসাইলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
যদিও ভারতের সাথে সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে রাশিয়ার ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়ার সাথে চীনের একটি সীমাহীন বা নো লিমিট সম্পর্ক থাকায় ভারতের কিছু কিছু মহলে রাশিয়ার ব্যাপারে অস্বস্তি রয়েছে। ভারত নিরাপত্তা পরিষদে অবস্থান তৈরিতে মস্কোর সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে চীন ও পাকিস্তান মিলে যখন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করেছে, তখনও ভারত রাশিয়ার পক্ষ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছে। তারপরও চীনের সাথে রাশিয়ার গভীরতম সম্পর্ক নিয়ে ভারত বরাবরই উদ্বিগ্ন। যদি কখনো চীন বা পাকিস্তানের সাথে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রেও রাশিয়ার সমর্থন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাঁড়াবে।
তৃতীয়ত ভস্তক টুয়েন্টি টুয়েন্টি টু মহড়ায় অংশ নেয়ার কারণে রাশিয়া ছাড়াও আরো বেশ কিছু দেশের সাথে সমরাস্ত্র নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে ভারতের। ভস্ককে আলজেরিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়া, নিকারাগুয়া, সিরিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান এবং তাজিকিস্তানও অংশ নিয়েছে। ভারতের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যেও রাশিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি দেশ।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অবরোধ জারির পর থেকে রাশিয়া থেকে ভারত বেশ সস্তায় জ্বালানী তেল কিনছে। ভারতের জন্য সস্তায় জ্বালানী পাওয়া খুবই জরুরি। কেননা দেশটি এরই মধ্যে প্রচন্ড মুদ্রাস্ফীতির চাপে রয়েছে।
মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলাও ভারতের জন্য দরকার। ভারত ব্রিকস এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানেইজেশনের সদস্যরাষ্ট্র। রাশিয়াও এই ফোরামগুলোর গুরুত্বপূর্ন সদস্য। তাছাড়া, ভারত, রাশিয়া ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই ফোরামে প্রতিবছর বৈঠকে মিলিত হন।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চাপে রেখেছে যাতে ভারত ইরান থেকে তেল না ক্রয় করে। কিন্তু ভারতকে নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমান তেল আমদানি করতে হয়। এক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর তাই ভারতকে নির্ভর করতেই হচ্ছে। আবার রাশিয়ার জন্যেও ভারত অনেক বড়ো একটি তেলের বাজার। আর ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক দেশ রাশিয়া থেকে তেল কিনতে অনীহা প্রকাশ করায় ক্রেতারাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়াও ভারতকে হারাতে চাইছে না। কিন্তু রাশিয়া থেকে তেল কেনাকে ভালো ভাবে নিচ্ছেনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ভারতের কৌশলগত সর্ম্পকে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভারত তার প্রতিরক্ষাখাতকে দেশীয় পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে। ভারত সম্প্রতি প্রথমবারের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠান দিয়ে নকশা করা বিমানবাহী রনতরী আইএনএস ভিকরান্ত কমিশন করেছে।
ভারত এতদিন যেসব সমরাস্ত্র ব্যবহার করে এসেছে তার অধিকাংশই রাশিয়া থেকে আমদানি করা। সামরিক এবং সামরিক প্রযুক্তিগত সহায়তাই ভারত ও রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্কের মূল ভিত্তি।
এর বাইরে ভারত ও রাশিয়ার সর্ম্পকে আরো কিছু কারণ আছে। আফগানিস্তানে তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত ও রাশিয়া একসাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়েছে। চীনের তৈরি বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে ভারত যতটুকু পিছিয়ে পড়েছিল সেই ঘাটতি পূরণের জন্য তারা রাশিয়ার সাথে মিলে নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর প্রজেক্ট নিয়েও কাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো ভারতকে চাপ দিয়ে আসছে যাতে তারা রাশিয়ার সাথে আর অগ্রসর না হয়। ভারতও এই আহবানে সাড়া দেয়ার ইংগিত দিয়েছে। কিন্তু তারপরও ভারত এবারের ভস্তক টুয়েন্টি টুয়েন্টি টু মহড়ায় অংশ নেয়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারী জিন পিয়েরে বলেন, রাশিয়ার সাথে যে দেশগুলো মহড়ায় অংশ নিয়েছে তাদেরকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতের এই অবস্থানে খুশী নয় তা স্পষ্ট।
রাশিয়া ও ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ভালো সম্পর্ক থাকলেও বানিজ্য খাতে এই সম্পর্কের মাত্রা খুব একটা আশাব্যাঞ্জক নয়। ২০২০ অর্থ বছরে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার সাথে ভারতের বানিজ্যের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। এই বানিজ্য ঘাটতি দুই দেশের নীতি নির্ধারকদের জন্যই মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন ভারত সফরে এসেছিলেন, তখন দুই দেশ একটি যৌথ বিবৃতি ইস্য করেছিল। তাতে বলা হয়, দুই নেতা ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
রাশিয়ার জন্য ভস্তক মহড়াটি গুরুত্বপূর্ন ছিল। তারা বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিল, ইউক্রেনে বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েনের পরও তারা এরকম একটি বড় মহড়া পরিচালনা করতে সক্ষম। ভস্তক মহড়া শেষ হওয়ার পর পরই রাশিয়া ও চীন আরেকটি নৌমহড়াও শুরু করতে যাচ্ছে। এই মহড়াটি নৌপথে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক জোরদার করার ইংগিত দিচ্ছে। তবে, জাপানের স্পর্শকাতরতার কথা চিন্তা করে ভারত এখনই রাশিয়ার সাথে কোনো নৌ মহড়ায় যেতে চাইছে না।
সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ‘রাশিয়ান ওয়ার্ল্ড’ বা রাশিয়ার বিশ্ব ধারনার ওপর ভিত্তি করে একটি মানবিক পররাষ্ট্রনীতি অনুমোদন করেছেন। এই নীতিমালা অনুযায়ী রাশিয়া যেকোনো মূল্যে রাশিয়ান ওয়ার্ল্ডের নিরাপত্তা, অখন্ডতা এবং চেতনাকে সমুন্নত রাখবে। পাশাপাশি রাশিয়া এই নীতিমালার আওতায় স্লাভিক রাষ্ট্রসমূহ এবং চীন ও ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদার করবে। আবার পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার দেশগুলোর সাথেও রাশিয়া সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইস্টার্ন ইকোনোমিক ফোরামের সম্মেলনে ভার্চুয়ালী বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আরো মজবুত করতে চায় ভারত। বিশেষ করে জ্বালানী খাতে এই দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধির এখন অনেক বেশি সুযোগ রয়ে গেছে। এরই মধ্যে ভারতের তেল কোম্পানী ওএনজিভি ভিদেশ এই বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
মোদি তার ভাষণে আরো বলেন, ভারত শুরু থেকেই সংলাপ ও কুটনীতির মাধ্যমে ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিয়ে আসছে। ইউক্রেন সংকটের শান্তিপূর্ন সমাধান নিশ্চিতে যেকোনো পদক্ষেপকে ভারত সমর্থন করবে। এবারের ভস্তক মহড়া রাশিয়া ও ভারতের সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। মোদি তার ভাষণে আরো বলেন, ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ করিডোর কিংবা চেন্নাই-ভøাদিভোস্তক মেরিটাইম করিডোর অথবা নর্দান সী রুট- যে সম্ভাবনার কথাই আমরা বলিনা কেন তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কৌশল হলো কানেক্টিভিটি। আর এই কানেক্টিভিটির ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতে এই দুই দেশের সম্পর্ক অগ্রসর হবে।
রাশিয়ার সাথে ভারতের এ ধরনের কানেক্টিভিটির আকাঙ্খা ও সামরিক সর্ম্পক পশ্চিমা বিশ্বের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যাথার কারন হয়ে উঠেছে। আগামি দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দিক থেকে ভারতের ওপর আরো চাপ বাড়বে। ইতোমধ্যে ভারত যে পশ্চিমের অবিশ্বস্ত মিত্র সে কথা জোর দিয়ে বলা শুরু হয়েছে। ভারত এখন এই উভয় সংকট কিভাবে কাটিয়ে উঠবে তা দেখার বিষয়।